খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: হারুন আহমেদ চৌধুরী, বীর উত্তম
(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা ও অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের পর্বে রইল হারুন আহমেদ চৌধুরী, বীর উত্তম'র বীরত্বগাঁথা)
মুক্তিযুদ্ধে হারুন আহমেদ চৌধুরী ছিলেন অগ্রভাগের সৈনিক। তার অসামান্য নেতৃত্বে কাপ্তাই থেকে গড়ে উঠেছিল প্রতিরোধ যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। বীর উত্তম খেতাবে তার সনদ নম্বর ১৫।
১৯৭১ সালের মার্চে ইপিআরের ৬ নম্বর সেক্টরের কাপ্তাই ১৭ নম্বর উইংয়ের সহকারী অধিনায়ক হিসেবে কর্মরত ছিলেন হারুন আহমেদ চৌধুরী। এ সময় তার পদবী ছিল ক্যাপ্টেন। ২২ মার্চ চট্টগ্রাম গেলে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম হারুন আহমেদ চৌধুরীকে বললেন, '৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অনেক বাঙালি অফিসার আছেন। তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা কর এবং বিদ্রোহ প্রসঙ্গে কথাবার্তা চালাও।'
২৩ মার্চ সেই মোতাবেক ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেসে যান হারুন আহমেদ চৌধুরী। তিনি মেসে থাকা তার কোর্সমেট ক্যাপ্টেন খালিকুজ্জামান চৌধুরী, ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, লেফটেন্যান্ট মাহফুজুর রহমান, লেফটেন্যান্ট শমসের মুবিন চৌধুরীর সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যান। এরপর তিনি এই অফিসারদের নিয়ে সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের বাসায় যান এবং রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ ক্যাপ্টেন রফিকসহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের বাসায় যান। তাদের সভায় এমপিএ আতাউর রহমান কায়সার, ডা. মান্নানসহ বেশ কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। সভায় দেশের পরিস্থিতি, পাকিস্তান থেকে সেনা আগমনসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। পাশাপাশি ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তরুণ অফিসার এবং ইপিআরের ২ অফিসারের মধ্যে সমঝোতা হয়, যদি পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালিদের উপর আক্রমণ করে, তবে তারা সবাই অধীনস্থ সেনাদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন।
২৪ মার্চ খুব ভোরে কাপ্তাই চলে যান হারুন আহমেদ চৌধুরী। যাওয়ার আগে ক্যাপ্টেন রফিকের সঙ্গে আরেকবার দেখা করেন তিনি। এ সময় তারা সিদ্ধান্ত নেন, যদি পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করে অথবা আক্রমণের ইঙ্গিত দেয় তবে তারা বিদ্রোহ করবেন এবং ক্যাপ্টেন রফিক আগে বিদ্রোহ করলে হারুন আহমেদ চৌধুরীকে খবর দেবেন। ক্যাপ্টেন রফিক ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরীকে 'ব্রিং সাম উড ফর মি' নামে একটি কোড দিলেন। এই কোডের অর্থ হলো, 'চট্টগ্রামে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তোমাকেও বিদ্রোহ করতে হবে এবং অবাঙালিদের বন্দী করে যত দ্রুত সম্ভব আমার সঙ্গে (ক্যাপ্টেন রফিক) একত্রিত হতে হবে।'
২৪ মার্চ খুব ভোরে কাপ্তাই চলে যান হারুন আহমেদ চৌধুরী। তার উইংয়ে সুবেদার মেজর ছিলেন নজমুল হক। তিনি যাবতীয় খবর ক্যাপ্টেন হারুনকে পৌঁছে দিতেন। এর আগে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে পাকিস্তানি অবাঙালি এনসিও জেসিওরা গোপনে পাকিস্তানি মেজর পীর মোহাম্মদের বাসায় শলাপরামর্শ করত। তখন থেকেই ক্যাপ্টেন হারুন বুঝতে পারলেন, পরিস্থিতি ভয়াবহ দিকে ধাবিত হচ্ছে।
২৪ মার্চ সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন ফারুক বান্দরবান থেকে উইং হেড কোয়ার্টারে যান এবং ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন জায়েদি ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরীর অনুমতি নিয়ে কাপ্তাই যান। ২৫ মার্চ রাত ১০টার দিকে ঘুমাতে যান হারুন আহমেদ চৌধুরীসহ বাকি ২ জন। এর একটু পরেই ক্যাপ্টেন হারুনের আর্দালি এসে তার রুমের দরজা ধাক্কাতে শুরু করেন এবং বলেন, 'আপনার টেলিফোন এসেছে।' ক্যাপ্টেন হারুন দ্রুত টেলিফোন অপারেটরের কাছে যান। কিন্তু ততক্ষণে লাইন কেটে গেছে। টেলিফোন অপারেটর জানালেন, চট্টগ্রাম থেকে ক্যাপ্টেন রফিক তার সঙ্গে কথা বলতে ফোন করেছিলেন। এরপর রুমে ফিরে যান ক্যাপ্টেন হারুন। ১০ মিনিট পর আবার ফোন এলে ক্যাপ্টেন হারুন ছুটে যান। এবারে ফোন করেছেন এম আর সিদ্দিকী। এম আর সিদ্দিকী তাকে বলেন, '২০ বেলুচ বেঙ্গল রেজিমেন্টে হামলা করেছে। শহরে প্রচণ্ড গোলমাল। আপনি জলদি বিদ্রোহ করুন এবং চট্টগ্রাম শহরে চলে আসুন।'
এ সময় ক্যাপ্টেন হারুন ক্যাপ্টেন রফিকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে এম আর সিদ্দিকী বললেন, 'রফিক যুদ্ধ করছেন। তিনি এখানে নেই।' ফোন কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ পর সিদ্দিকী আবার তাকে ফোন করে বললেন, 'রফিক একটি কোড ওয়ার্ড আমাকে পাঠাতে বলেছিলেন। সেটি হলো ব্রিং সাম উড ফর মি।' কোড শোনার পর মুহূর্তেই পরিস্থিতি বুঝে গেলেন ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রথমে অবাঙালিদের নিরস্ত্র করতে হবে এবং চট্টগ্রামে রওনা দিতে হবে। তিনি পোশাক পাল্টানোর সময়ে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি অফিসার জেগে যান। তারা অবাক হয়ে পোশাক পাল্টানোর কারণ জিজ্ঞেস করলে ক্যাপ্টেন হারুন বললেন, 'লাইনে কিছু গোলমাল। এখনই আমি ফিরে আসব। তোমরা ঘুমাও।'
এরপর তিনি সুবেদার মেজর নজমুল হককে ডেকে পরিস্থিতি বর্ণনা করলেন এবং বললেন, 'অস্ত্রাগারের চাবি নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। বাঁশি বাজালেই অস্ত্রাগার খুলে দেবেন।' ওই রাতে গার্ড কমান্ডার ছিল এক পাকিস্তানি। ক্যাপ্টেন হারুন তাকে ডেকে সব এনসিওকে ডাকতে বললেন। গার্ড কমান্ডার উপর তলা থেকে নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাকে বন্দী করে তার অস্ত্র কেড়ে নেন ক্যাপ্টেন হারুন। এরই মধ্যে কোয়ার্টার গার্ডের বাঙালি সৈনিকরা তার কথামতো দোতলায় সিঁড়ির মুখে পজিশন নিতে থাকে। এক সময় ক্যাপ্টেন হারুন হুইসেল দেন এবং সব বাঙালি সেনাদের নিচে নেমে আসার এবং অবাঙালিদের উপরে থাকার নির্দেশ দেন। তিনি এটিও বলেন, অবাঙালিরা যদি নিচে নামার চেষ্টা করে তবে তাদের গুলি করবে বাঙালি সৈনিকরা।
সব বাঙালিরা নিচে নেমে এলে অস্ত্রাগার খুলে দেওয়া হয় এবং বাঙালি সৈনিকরা অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নেয়। এরপর ক্যাপ্টেন হারুন উইং কমান্ডার মেজর পীর মোহাম্মদকে নিরস্ত্র করতে যান। মেজর পীর মোহাম্মদের বাসার সামনের পয়েন্টের গার্ড ছিল অবাঙালি। প্রথমে গার্ডকে নিরস্ত্র করেন ক্যাপ্টেন হারুন। এরপর পীর মোহাম্মদের বাসায় গিয়ে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলেন, 'আপনি এখন বন্দী। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আমি উইংয়ের দায়িত্ব নিয়েছি।' মেজর পীর মোহাম্মদ অস্ত্র হাতে নেওয়ার চেষ্টা করলে ক্যাপ্টেন হারুন তাকে বলেন, 'অগ্রসর হলেই মৃত্যু। ঘরে থাকুন। কোনো অসুবিধা হবে না।'
এ সময় ক্যাপ্টেন জায়েদী ও ক্যাপ্টেন ফারুক উঠে এলেন। ২ জনকেই বলা হলো, 'তোমরা এখন বন্দী। এদেশ স্বাধীন।' ক্যাপ্টেন জায়েদীকে আটক করা হলো। আর ক্যাপ্টেন ফারুক খুশি হয়ে বললেন, 'ভালোই হলো। আমি তোমার অনুগত হয়ে বাংলাদেশের সেবা করব।' রাত তখন সাড়ে ১১টা। এরপর তিনি ওয়্যারলেস দিয়ে অবশিষ্ট কোম্পানিগুলোকে অবাঙালিদের আটক করে কাপ্তাইয়ে একত্রিত করে চট্টগ্রামের দিকে রওনা দিতে বলেন। এরই মধ্যে হাজার হাজার জনতা রাস্তায় নেমে আসে। ইপিআরের কোম্পানির ৪-৫ জনকে উইং হেড কোয়ার্টারে রেখে বাকি সবাইকে নিয়ে রাত ৩টার দিকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেন ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী।
২৬ মার্চ চট্টগ্রাম শহর থেকে ৭-৮ মাইল দূরে থাকা অবস্থায় ক্যাপ্টেন হারুন দেখলেন, বেঙ্গল রেজিমেন্টের কয়েকজন সেনা পটিয়ার দিকে দৌড়াচ্ছে। তাদেরকে জিজ্ঞেস করে তিনি জানতে পারলেন, পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করেছে এবং মেজর জিয়াউর রহমানসহ ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করেছে। পরে ক্যাপ্টেন হারুন অগ্রসর হলে তার মেজর জিয়ার সঙ্গে দেখা হয়। মেজর জিয়া তাকে বললেন, 'ক্যাপ্টেন রফিক শহরে যুদ্ধ করছেন। আমরা ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট পটিয়াতে একত্রিত হব। তারপর চট্টগ্রাম শহরে এসে আবার একযোগে আক্রমণ চালাব।' মেজর জিয়া ক্যাপ্টেন হারুনকে তার সঙ্গে থাকতে বললেন। ক্যাপ্টেন হারুন থেকে গেলেন। পটিয়াতে সবাই মেজর জিয়ার নেতৃত্বে শপথ নিলেন। পরে ক্যাপ্টেন হারুন এক কোম্পানি সেনাসহ চট্টগ্রাম কলেজ এলাকায় অবস্থান নেন।
এদিকে চট্টগ্রাম শহর দখল করার পর পাকিস্তানি বাহিনীর বড় একটি দল কালুরঘাটের দিকে যাত্রা শুরু করে। ১১ এপ্রিল সকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর্টিলারি, মর্টার ও নৌবাহিনীর গান ফায়ারের সাপোর্ট নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর তুমুল আক্রমণ শুরু করে। এ সময় ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদের অবস্থান ছিল কালুরঘাট সেতুর পশ্চিম প্রান্তের ডান দিকে। তারা একসঙ্গে প্রচণ্ড প্রতিরোধ যুদ্ধও গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর বিপুল গোলাবর্ষণের এক পর্যায়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যান সম্মুখভাগে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা। ভয়াবহ আক্রমণের কারণে পেছনে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের খবর পৌঁছে দিতে পারেননি তারা। এ সময় পাকিস্তানি সেনাদের একটি বুলেট এসে লাগে ক্যাপ্টেন হারুনের পেটে। তিনি লুটিয়ে পড়েন সেতুর উপর। শমসের মবিন চৌধুরীও গুরুতর আহত হন।
গুলিবিদ্ধ হারুন আহমেদ চৌধুরীকে পটিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রথম অস্ত্রোপচার শেষে তাকে মালুরঘাট মিশনারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অস্ত্রোপচারের কয়েকদিন পর তাকে মিয়ানমারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মিয়ানমারে চিকিৎসা নেওয়ার পর তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে টেকনাফে চলে আসেন ক্যাপ্টেন হারুন। ১১ ডিসেম্বর কক্সবাজারে ভারতীয় সেনাবাহিনী চলে এলে ক্যাপ্টেন হারুন তাদের সঙ্গে যোগ দেন এবং দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান।
হারুন আহমেদ চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৫ সালের ৬ নভেম্বর সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার চারখাই ইউনিয়নের আদিনাবাদ গ্রামে। বাবার চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষাজীবন কাটে তার। ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। ১৯৬৬ সালে সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। এরপর ১৯৬৯ সালে ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি হয় তার। মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন হারুন আহমেদ চৌধুরী। পরে তিনি মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। ১৯৯০ সালে অবসর গ্রহণ করেন হারুন আহমেদ চৌধুরী, বীর উত্তম।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: নবম খণ্ড
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস: সেক্টর ১
বাংলাপিডিয়া
আহমাদ ইশতিয়াক
ahmadistiak1952@gmail.com
Comments