মুক্তিযুদ্ধ

খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: শহীদ খাজা নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া, বীর উত্তম

খাজা নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া, বীর উত্তম। ছবি: সংগৃহীত

(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা ও অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের পর্বে রইল শহীদ খাজা নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া, বীর উত্তম'র বীরত্বগাঁথা)

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া ছিলেন ৪ নম্বর সেক্টরের জামালপুর সাব সেক্টরের সেকেন্ড ইন কমান্ড। পরবর্তীতে তিনি এই সাব সেক্টরের কমান্ডারও হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব ও অসীম আত্মত্যাগের জন্য তাকে বীরত্বের স্বীকৃতিসূচক বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধে একমাত্র বেসামরিক শহীদ মুক্তিযোদ্ধা যিনি বীর উত্তম খেতাব পেয়েছেন। বীরউত্তম খেতাবে তার সনদ নম্বর ১৪।

মুক্তিযুদ্ধের মার্চ মাসে খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া কর্মরত ছিলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে কন্ট্রোলার অব অ্যাকাউন্টস পদে। একই সঙ্গে পড়ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউট (আইবিএ) এর এমবিএ'তে। ২৫শে মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করার আগে ঢাকায় কর্মরত বিদেশি সাংবাদিকদের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে বেরোতে দেওয়া হয় না। উদ্দেশ্য পরদিন তাদের বিমানে তুলে দেওয়া হবে। এই বিদেশি সাংবাদিকদের মুখেই ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যার আভাস পেয়েছিলেন খাজা নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া। পরিস্থিতি প্রতিকূলে দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে না ফিরে তিনি সেদিন চলে গিয়েছিলেন পুরান ঢাকার অভয় দাস লেনের খালার বাড়িতে। সে রাতে তীব্র গোলাগুলি, অসহায় মানুষের চিৎকার আর গণহত্যায় স্তব্ধ জনপদে খালার বাড়িতে বসে তিনি কেবলই ভাবছিলেন তার বন্ধুদের কথা। ভয়াল কালরাত্রির সেই পৈশাচিকতা খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া দেখেছিলেন পরদিন।

পরদিন সকালে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য কারফিউ উঠলে খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া খালার বাসা থেকে ছুটে যান হলে বন্ধুদের দেখতে। কিন্তু সেখানে শত শত বন্ধু আর সহপাঠীদের লাশ দেখে স্থির থাকতে পারেননি তিনি। গতকাল যাদের দেখেছিলেন প্রাণোচ্ছল তাদের শরীরেই দেখতে পেলেন নির্যাতন আর পাশবিকতকার চিহ্ন। খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া তখনই স্থির করেছিলেন যে করেই হোক এর প্রতিশোধ এবং বদলা তাকে নিতে হবে। ২৬ মার্চেই খালার পরিবারকে ঢাকা থেকে কুমিল্লায় নিয়ে বাবা মার কাছে পৌঁছে দিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। এরপর তরুণদের সংগঠিত করার কাজে লেগে পড়লেন। প্রথমত তিনি কুমিল্লা শহরের তরুণদের ঢাকার পরিস্থিতি জানালেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করলেন। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে তখন পাকিস্তানি সেনাদের বেরিয়ে আসার ঝুঁকি ছিল তাই খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া কুমিল্লা শহরের করবী বাগিচাগাঁওয়ের বাড়ি থেকে তার বাবা, মা ও খালাকে তুলে নিয়ে বুড়িচংয়ের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দিলেন। এর কয়েকদিনের মধ্যে খালাতো ভাই ও এক পরিচিতকে নিয়ে ত্রিপুরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করলেন খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া।

এপ্রিল মাসে ত্রিপুরার আগরতলায় তিনি আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। এসময় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নানা কাজে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। এরপর বিএসএফের কাছে ১০ দিনের ট্রেনিং নেন খাজা নিজামউদ্দিন। একই সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনে ইন্দ্রনগরে এক মাসের প্রশিক্ষণ নেন তিনি। মে মাসে প্রশিক্ষণ শেষে তাকে পাঠানো হয় সিলেটের কানাইঘাটে। এসময় বেশ কয়েকটি দুর্ধর্ষ অপারেশন করেছিলেন খাজা নিজামউদ্দিন। এই অপারেশনগুলোর মধ্যে সিলেটের কানাইঘাট, মস্তানগঞ্জ, ভরামইদ, নক্তিপাড়া ও মণিপুর বাজার অপারেশন অন্যতম।

মুক্তিযুদ্ধের জুলাই মাসে সেক্টর গঠন হলে ৪ নম্বর সেক্টরের অধীনে জালালপুর সাব সেক্টরের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়াকে। তার অধীনে সৈন্য ছিল ৪৮৬ জন। এই সাব সেক্টরের আওতাধীন এলাকা ছিল হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া থেকে শেরপুরের নদীঘাট অঞ্চল পর্যন্ত। একবার মাকে দেখার তীব্র ইচ্ছে পেয়ে বসেছিল খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়াকে। তাই তিনি ৪ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর সি আর দত্তকে বলেছিলেন তাকে যেন কুমিল্লায় পাঠানো হয়। যুদ্ধ করার ফাঁকে তিনি একবার মাকে দেখবেন। জবাবে মেজর দত্ত বলেছিলেন, 'যুদ্ধ শেষে যেও।'

মুক্তিযুদ্ধের আগস্ট মাসে জালালপুর সাব সেক্টর থেকে কানাইঘাটের লুতাছড়া চা বাগান, মন্তাজগঞ্জ মণিপুর টিলা, জকিগঞ্জের কারবালা, রবুরচর, আটগ্রাম, আমলসিদসহ ৭টি স্থানে ৭টি ক্যাম্প গড়ে ওঠে মুক্তিবাহিনী। লুতাছড়াতে স্থানীয় অধিবাসীদের নিয়ে একটি প্রশাসনিক কমিটিও করেছিল জালালপুর সাব সেক্টর। এই ক্যাম্পগুলো স্থাপনের পর ভারতের জালালপুর থেকে জালালপুর সাব সেক্টরের হেডকোয়ার্টার বদলে নেওয়া হয় লুতাছড়াতে। খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়াকে দেওয়া হয় মন্তাজগঞ্জ ক্যাম্পের দায়িত্ব।

এসময় পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচল বন্ধের জন্য সেতুগুলো উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সেই মোতাবেক বেশ কয়েকটি ব্রিজও ধ্বংস করা হয়। গেরিলা অপারেশনে সাফল্য ও রণকৌশল দেখিয়েছিল খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া ও তার বাহিনী। এক রাতে সিলেটের টেলিফোন টাওয়ার ধ্বংসেও চূড়ান্ত সক্ষমতা দেখায় তার বাহিনী।

মুক্তিযুদ্ধের ৩ সেপ্টেম্বর খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া কানাইঘাটের নক্তিপাড়া গ্রামের কালাহাজীর বাড়িতে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কানাইঘাটের কটালপুর ব্রিজ মুক্ত করার পরিকল্পনা করেন। ঠিক হয় ৪ সেপ্টেম্বর ধ্বংস করা হবে এই ব্রিজ।

সেইরাতে তারা এই অপারেশনে বের হন। অপারেশনের অগ্রভাগে ছিলেন খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া। রাতের অন্ধকারে ছোট একটি মুক্তিযোদ্ধা দল নীরবে ডিনামাইট সংযুক্ত করলেন ব্রিজে। এরপর ডিনামাইট বিস্ফোরিত হলো ভয়াবহ শব্দে। পাশেই ওঁত পেতে ছিল পাকিস্তানি বাহিনী। টের পাওয়া মাত্রই বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে লাগলো। চতুর্দিক থেকে অনেকটা ঘেরাও করে ফেলেছে তাদের পাকিস্তানি বাহিনী। এসময় খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া একদিকে যেমন সাব মেশিনগান চালাচ্ছেন ঠিক তেমনিভাবে নির্দেশ দিচ্ছেন সহযোদ্ধাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। এক পর্যায়ে তার সহযোদ্ধারা তুমুল গুলি বর্ষণের মধ্যে হতাশ হয়ে পড়ে। কারণ একদিকে দলটি ছিল ছোট এবং পাকিস্তানি বাহিনীর দলটি ছিল খাজা নিজামউদ্দিনের মুক্তিযোদ্ধা দলের ১০ গুণ বড়। কিন্তু অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সহযোদ্ধারা যখন দম হারিয়ে পিছু হটতে গেল হঠাৎই এলএমজিম্যানের হাত থেকে এলএমজি কেড়ে নিয়ে গুলি চালাতে লাগলেন খাজা নিজামউদ্দিন। দলনেতার অনুপ্রেরণা ও তেজস্বী সাহস দেখে ভীষণ অনুপ্রাণিত হয় বাকি সহযোদ্ধারা। তারা গুলি চালাতে থাকেন। তখনো অনবরত গুলি চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। হঠাৎ গুলি এসে লাগে খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়ার গায়ে। কিন্তু তিনি গুলি চালানো থামাননি। গুলিবিদ্ধ হয়েও একটানা গুলি চালিয়ে যেতে লাগলেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি এসময় সহযোদ্ধাদের বললেন, তার লাশ যেন ফেলে না আসা হয়।

এসময় আরেকটি গুলি এসে লাগে খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়ার শরীরে। আর পারলেন না খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া। ঢলে পড়লেন বাংলার মাটিতে শেষবারের মতো। শহীদ হলেন খাজা নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া। দীর্ঘ ৬ ঘণ্টা যুদ্ধের পর সেদিন পাকিস্তানিরা পিছু হটেছিল।

মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া এতোটাই অসীম নেতৃত্বের অধিকারী ছিলেন যে কানাইঘাটের স্থানীয়রা সবাই সামরিক বাহিনীর অফিসার হিসেবেই মনে করতো। আর তাই ক্যাপ্টেন নিজাম নামেই সম্বোধন করতো সবাই। শহীদ খাজা নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়াকে সমাহিত করা হয়েছিল সিলেটের তিন আউলিয়ার মাজারের পাশে।

খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়ার জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার মালাপাড়া গ্রামে। সরকারি কর্মকর্তা বাবার চাকরির সুবাদে খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া পড়াশোনা করেন বিভিন্ন জেলায়। ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রামের জে এস সেন ইন্সটিটিউট থেকে এসএসসি, ১৯৬৬ সালে এইচএসসি পাশ করার পরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগে। ১৯৬৯ সালে ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে স্নাতক পাশ করেন তিনি। একই বিভাগ থেকেই পরের বছর স্নাতকোত্তরে পরীক্ষা দেন খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া।

১৯৬৯ সালে নিজের সম্পাদিত 'কালচক্র' পত্রিকায় খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া লিখেছিলেন,

"প্রিয়তমাসু

আমার সময়ের রাজ্যে

তোমার সংগীত ঐকতান তোলে

মিছিলের উচ্চকিত ধ্বনির মতো

আমার নিভৃত জাগ্রত করে

আমি শুনি, কান পেতে শুনি।"

সূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র দশম খণ্ড।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর ৪

বাংলাপিডিয়া

'নিশ্চিত সংগ্রামের শপথ/ শহিদ বীর উত্তম খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া স্মারকগ্রন্থ

ahmadistiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

Sweeping changes in constitution

Expanding the fundamental rights to include food, clothing, shelter, education, internet and vote, the Constitution Reform Commission proposes to replace nationalism, socialism and secularism with equality, human dignity, social justice and pluralism as fundamental principles of state policy.

3h ago