মানসিক সমস্যা মানেই ‘পাগল’ হওয়া নয়

ছবি: সংগৃহীত

সারার (ছদ্মনাম) বয়স যখন ১৫-১৬ বছর, তখনই তার মধ্যে সিজোফ্রেনিয়ার কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যেমন: হেলুসিনেশন, অত্যধিক রাগ, অভিমান এবং আত্মহত্যা প্রবণতা। ক্রমে পরিবারের লোক এবং আত্মীয়-স্বজন সবাই একে জেদ ও অসদাচরণ বলে মনে করতে শুরু করেন। সারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এবং একসময় সম্পূর্ণ সিজোফ্রেনিক হয়ে পড়ে।
 
তরুণী সারা যেদিন ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে, সেদিন ওর পরিবার বুঝতে পারে কতটা ভুল তারা করেছে। এই ভুলের মাশুল সারার বাবা-মাকে সারাজীবন দিয়ে যেতে হবে। মনোচিকিৎসকরা বলেন, আমাদের দেশে মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করার পর বা এই সিনড্রোম দেখা দিলে তবেই ডাক্তারের কাছে যায়। অথচ প্রথম থেকে নজর দিলে সহায়তা দেওয়া সহজ হয়।

শহরে বড় হওয়া সারার জীবনের যখন এই পরিণতি হয়, তখন গ্রামের বধূ জাহেদার পরিণতি কতটা খারাপ হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। জামালপুরের একটি গ্রামের ব্যবসায়ী পরিবারে জাহেদার বিয়ে হয়েছিল। স্বামী ছিলেন অভিবাসী শ্রমিক। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে পারিবারিক নির্যাতন, ভাসুরের যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে জাহেদার মধ্যে নানা ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। ওর বাবার বাড়ি থেকেও কোনো সাহায্য পায়নি জাহেদা। সবাই, এমনকি ওর স্বামীও ভুল বুঝতে শুরু করেছিল। পরে স্থানীয় এনজিও'র সহায়তায় জাহেদা যখন মানসিক সহায়তা পেতে শুরু করে, তখন যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। জাহেদার সংসার ততদিনে ভেঙে গেছে।

বাংলাদেশে গ্রাম বা শহরে এরকম বহু নারী-পুরুষ আছেন, যারা নিজেরাই নিজেদের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে বুঝতে পারেন না। পরিবার, সমাজ তাদের ভুল বুঝে এবং প্রায় একঘরে করে ফেলে। পরিবার ও সমাজ থেকে দূরত্ব তৈরি হওয়ার ফলে এই মানুষগুলো একসময় পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। মানসিক সমস্যাকে আমাদের মতো দেশে কোনো সমস্যা হিসেবে মনেই করা হয় না। শারীরিক সমস্যাকে যতটুকু গুরুত্ব দেওয়া হয়, মানসিক সমস্যাকে এর এক শতাংশও গুরুত্ব দেওয়া হয় না। 

এর প্রমাণ এই খবর, দেশের ৪ কোটি মানুষ মানসিক সমস্যায় ভুগছে, অথচ স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয়ের মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয় হয় মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য। অর্থাৎ ১০০ টাকা খরচ হলে মানসিক স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হয় মাত্র ৫০ পয়সা। এ ছাড়া, আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না মানসিক সমস্যা কী এবং কীসে এর সমাধান? তাই দেশের প্রাপ্তবয়স্কদের ১৯ শতাংশ ও অপ্রাপ্তবয়স্কদের ১৩ শতাংশ কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত। 

'মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ উদ্যোগ' শীর্ষক এক আলোচনায় বলা হয়েছে যে, বিপুল সংখ্যক মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত হলেও খুব কম মানুষ চিকিৎসা নেয়। সর্বশেষ জরিপ বলছে, মানসিক রোগে আক্রান্ত ৯২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি কোনো চিকিৎসা নেয় না। অন্যদিকে, অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে চিকিৎসা না নেওয়ার হার ৯৪ শতাংশ।

এই বিপুল সংখ্যক মানুষের চিকিৎসা না নেওয়ার প্রধান কারণ দুটি। এক, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে মানুষের সচেতনতার অভাব এবং লোকলজ্জার ভয়। অন্যটি দেশের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য জনবলের ঘাটতি ও প্রতিষ্ঠানের অভাব। যেমন ধরা যাক, সাদেক (ছদ্মনাম) সাহেবের কথা। তিনি একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হলেও দারুণভাবে সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত ও শুচিবায়ুগ্রস্ত। সবাইকে নানা কারণে সন্দেহ করেন। এই নিয়ে সংসারে, কর্মক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝি লেগেই আছে। বন্ধু-বান্ধবরা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিলেও শুধু লোকলজ্জার ভয়ে সাদেক সাহেব সেখানে যেতে ইচ্ছুক নন। সবচেয়ে বিপদের কথা যে, উনি স্বীকারই করেন না যে তার আচরণে কোনো সমস্যা আছে। 

মানসিক সমস্যা এমন একটি সমস্যা, যেটিকে ছোট করে দেখার বা উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। কোনো ব্যক্তি যদি শিশুকালে, কৈশোরে বা তারুণ্যে সামান্যতম মানসিক সমস্যার ভেতর দিয়ে যেতে থাকেন, তাহলে সেসময় থেকেই আমাদের সচেতন থাকা ও পরামর্শ নেওয়া দরকার। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে বাংলাদেশে মানসিক অসুস্থতা মোকাবিলায় কোনো সাপোর্ট সেন্টার তৈরি হয়নি। ব্যক্তি ও পারিবারিক দিক থেকেও নানা ধরনের বাধা আছে। এ দেশে যেকোনো মানসিক সমস্যাকে 'পাগল' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আর সে কারণেই লোকে মানসিক সমস্যাকে এড়িয়ে চলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাস্থ্য বলতে একজন মানুষের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক এই ৩ অবস্থার সমন্বয়কে বুঝায়। 

সমাজে চলতে গেলে মানুষকে নানা ধরনের চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে জীবনে সমস্যার কোনো শেষ নাই। পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, মনস্তাত্ত্বিক ও মনোদৈহিক সমস্যার ভেতর দিয়ে যেতে হয় মানুষকে। ধর্ষণ, অপমৃত্যু, দুর্ঘটনা, ছিনতাই, বিষণ্ণতা, বিচারহীনতা, দুর্নীতি, আত্মহত্যা, বিবাহ বিচ্ছেদ, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের মতো আরও অনেক অনেক অঘটন আমাদের চারিদিকে ঘটতে থাকে। ঘটনার বিষয় হয়ত ভিন্ন কিন্তু আফটার শক সিনড্রোম বেশীরভাগ একই ধরনের হয়ে থাকে।
 
করোনার মতো ভয়াবহ মহামারির প্রভাব এখনো আমাদের জীবন থেকে যায়নি। করোনায় যারা কাজ হারিয়েছেন, তারা অনেকেই কাজ খুঁজে পাননি, যারা ব্যবসায় লস করেছেন, তারা আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি, যেসব স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে, সেগুলো এখনো খুলেনি। যারা উদ্বাস্তু হয়েছেন, তারা নিজের ভিটায় ফিরে আসতে পারেননি। এরমধ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে বহুগুণ। প্রতিদিন সংসার চালাতে গিয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষ মুখ থুবরে পড়ছে। এগুলো সবই মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান। এ ছাড়া, দেশের অসংখ্য নারী ও শিশু এসময় ভয়াবহভাবে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং এর প্রভাব বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।

শিশুরা স্কুলে যেতে না পারায় গত ২ বছর যে ক্ষতির মুখে পড়েছে, তাতে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সাংঘাতিক রকম বিপদের মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের যে শিশুরা করোনার কারণে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে এবং লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে, এদের প্রায় সবাই মানসিক ট্রমার মধ্যে দিয়ে জীবন পার করতে বাধ্য হচ্ছে।

সেভ দ্য চিলড্রেন মনে করে, ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও খাদ্যাভাব এবং সহিংসতা ও নিপীড়নের ঝুঁকির মধ্যে অনেক মা-বাবা তাদের কন্যা সন্তানকে তুলনামূলক অনেক বেশি বয়সীদের সঙ্গে বিয়ে দেবেন। এ বিয়েগুলো মেয়েদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করবে এবং বিষন্নতাসহ নানা জটিলতার ঝুঁকি বাড়াবে। এসবের কারণে মানসিক স্বাস্থ্য আরও অনেক বেশি হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে নিঃসন্দেহে। বাংলাদেশে মানসিক সমস্যাকে সবসময়ই পাগলের চিকিৎসা বলে মনে করা হয়। জীবনযাত্রা আধুনিক হলেও এসব দিক দিয়ে আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। মানসিক রোগ নিয়ে লোকে হাসি-ঠাট্টা করে।
 
বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো)। এই আত্মহত্যার বড় একটি কারণ বিষণ্ণতা এবং অত্যধিক আবেগ, যা মানসিক অসুস্থতার প্রমাণ বহন করে। যেকোনো মানুষকে সাহস, সংকল্প ও ধৈর্য দিয়ে মানসিক রোগের মুখোমুখি হতে হয়। আমরা পরিবারের সদস্য, বন্ধু ও সহকর্মী হিসেবে এই লড়াইয়ে তাদের পাশে থাকতে পারি। সরকারের উচিত মানসিক স্বাস্থ্য সেবাকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার অংশ করা।
 
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, কল-কারখানা, হাসপাতালের মতো স্থাপনাগুলোতে তাদের নিজস্ব উদ্যোগে মেন্টাল সাপোর্ট দেওয়ার জন্য একদম ছোট পরিসরেও যদি এমন কার্যক্রম শুরু করতে পারে, তাহলে এই কাজের সুফল পাবে মানুষ। বিশেষ করে সেসব ছাত্র-ছাত্রীরা যেন তাদের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের জায়গা পায়, মানসিক সাপোর্ট খোঁজার জায়গা পায়। মানুষ যদি নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে না পারে, তাহলে সে একজন নেগেটিভ মানুষে পরিণত হতেই পারে। 

মানুষের এমন কিছু নিজস্ব কথা বা সমস্যা থাকে যা স্বজন, বন্ধু বা পরিচিত জনের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় না। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলতে হলে এমন একজন অপরিচিত মানুষের দরকার হয়, যার কাছে কোনো কিছু লুকাতে হয় না বা ভালো-মন্দ সাজতে হয় না। ভুলে গেলে চলবে না যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ পৃথিবীতে রোগের বোঝার ১ নম্বর কারণ হবে বিষণ্ণতা, আর সেসময় বছরে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে মারা যাবে।

শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Onion price rises on supply crunch

Onion prices at retail markets in Dhaka rose by Tk 10 to Tk 15 per kilogramme (kg) over the past week, deepening the woes of low and fixed-income people..Wholesale and retail traders across the capital said a supply crunch is causing the volatility in onion prices..Nurul Alam Shikdar

25m ago