মুক্তিযুদ্ধ

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ থেকে ভুট্টোর ওয়াকআউট

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৫ ডিসেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত ও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো পোল্যান্ডের দেওয়া আত্মসমর্পণের  প্রস্তাবে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখান। এর আগে পোল্যান্ড বাংলাদেশের অবস্থা বিবেচনা করে পাকিস্তানি বাহিনীকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়। একইসঙ্গে, বাংলাদেশ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার কথা বলে।

ভুট্টো এ প্রস্তাবের জবাবে বলেন, 'আমি সারেন্ডার ডকুমেন্ট নিয়ে ফিরতে চাই না। আমি একটি আগ্রাসন সমর্থনের ডকুমেন্টকে বৈধতা দিতে পারি না। নিরাপত্তা পরিষদ সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ৪ দিন ধরে আমরা এখানে কথা বলছি। আর তারা কেবল ঢাকায় আত্মসমর্পণের প্রস্তাব তুলছে। কিন্তু কেন? কারণ তাদের লক্ষ্য ঢাকার পতন হওয়া।  কিন্তু ঢাকার পতন হলে কী হবে? যদি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের পতন হয় তবে কী হবে? পশ্চিম পাকিস্তানের পতন হলেও কী হবে? এরকম যদি হয়, আমরা নতুন পাকিস্তান গড়ব। নিরাপত্তা কমিশন সেই অনুযায়ীই এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা কী করব বা নিরাপত্তা কীভাবে ফিরে আসবে, আমাদের এখানে এসে তা বলার কথা ছিল। কিন্তু এই প্রসঙ্গে সবাই চুপ।'

ভুট্টো তার বক্তব্যের শেষ প্রান্তে এসে প্রস্তাবের কাগজ ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলেন, 'আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব। কেন আমি নিরাপত্তা পরিষদে সময় নষ্ট করছি? আমি যাচ্ছি।   জাতিসংঘে এটাই আমার শেষ আসা।'

এ সময় তিনি ও পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের সদস্যরা নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করে চলে যান।

১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট  জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজী পাকিস্তান দূতাবাসের মাধ্যমে ভারতের কাছে  যুদ্ধবিরতির আবেদন জানান। এ সময় ভারতীয় বাহিনীর শ্যাম জেনারেল মানেকশ সন্ধ্যা ৫টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকার ওপর বিমান হামলা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। ভারতীয় বাহিনীর পক্ষ থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজীকে পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়, 'পাকিস্তানি বাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করবে কি না, তা জানানোর জন্য বিশেষ বেতার কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং কোড নম্বর দেওয়া হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে শর্তহীন আত্মসমর্পণ না করা হলে ফের বিমান হামলা শুরু হবে। ভারত বা বাংলাদেশ সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশনের পূর্ণ সুযোগ দেওয়া হবে।'

ঢাকায় এদিন

১৫ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নির্দেশে এবং পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা মওলানা আবদুল মান্নানের সহযোগিতায় আলবদরের বেশ কয়েকজন তরুণ প্রখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরীকে রোগী দেখার কথা বলে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়।

১৫ ডিসেম্বর কারফিউয়ের সময় সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলের ক্লিনিক্যাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বিকে।

১৫ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর কাছে সাভার হারিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গাবতলীর কাছে অবস্থান নেয়। পরে ভারতীয় মিত্রবাহিনী সাভার থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। এ সময় কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনীও মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। এদিন রাত ২টার দিকে গাবতলী ব্রিজের কাছে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ সময় মিত্রবাহিনীর আরেকটি দল যোগ দিলে ২ পক্ষের মধ্যে রাতব্যাপী যুদ্ধ হয়।   

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

১৫ ডিসেম্বর ভারতীয় নৌবাহিনীর সহযোগিতায় সোভিয়েত রণতরীর ২০টি জাহাজ ভারত মহাসাগরে অবস্থান নিলে মার্কিন ৭ম নৌবহর দিক পরিবর্তন করে।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ  

১৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে লেফটেন্যান্ট শওকতের নেতৃত্বে গণবাহিনীর কোম্পানি, ক্যাপ্টেন গফফারের নেতৃত্বে চতুর্থ বেঙ্গলের দল ও ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে ১০ ইস্ট বেঙ্গলের যোদ্ধাদের কাছে মেজর হাদীর নেতৃত্বে হাটহাজারীতে থাকা হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে।

১৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে দশম ইস্ট বেঙ্গলের চার্লি কোম্পানির কমান্ডার লেফটেন্যান্ট দিদারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর কুমিরা ঘাঁটিতে ব্যাপক আক্রমণ চালায়। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ব্যাপক আক্রমণের মুখে এক পর্যায়ে ফৌজদারহাটে গিয়ে পৌঁছায় মুক্তিবাহিনী। এরপর মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিবাহিনী হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণের জন্য এগিয়ে যায়।

১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারীতে মুক্তিবাহিনী হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। এ সময় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হানাদার বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।

১৫ ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনী রংপুর শহর ঘিরে ফেলে। পরদিন মিত্রবাহিনীর রংপুর ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ করার কথা থাকলেও, হানাদার বাহিনী এদিন সন্ধ্যার দিকে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব দেয়।

১৫ ডিসেম্বর গাজীপুর হানাদারমুক্ত হয়। এর আগে  ১৩ ও  ১৪ ডিসেম্বর গাজীপুর সেনানিবাসে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী সম্মিলিতভাবে আক্রমণ চালালে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি বাহিনী চান্দলা চৌরাস্তায় অবস্থান নেয়। এরপর এদিন  সকালে হানাদার বাহিনী জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্ট, সমরাস্ত্র কারখানা ও  অর্ডন্যান্স ডিপো থেকে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ও যানবাহন নিয়ে ঢাকায় ফিরতে শুরু করে। খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনী গাজীপুরের ছয়দানা ও টঙ্গীতে অবস্থান নিয়ে হানাদার বাহিনীর ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এক পর্যায়ে কাশিমপুর থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনীও আর্টিলারি হামলা চালায়। এ সময় হানাদার বাহিনীর বহু সেনা নিহত হয়। একইসঙ্গে হানাদার বাহিনীর প্রচুর সমরাস্ত্র ধ্বংস হয়।

১৫ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি হানাদারমুক্ত হয়। এদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে খাগড়াছড়ি শহরের এসডিও বাংলোতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে মুক্তিবাহিনী।

১৫ ডিসেম্বর মেজর আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর কাছে কুমিল্লা ময়নামতি সড়কে অবস্থানরত ১৫০ হানাদার সেনা আত্মসমর্পণ করে।

১৫ ডিসেম্বর খুলনায় মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার এম আরেফিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল নদীপথে হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। এ সময় সড়কপথে মেজর জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে একটি দল খুলনা আক্রমণ করে খুলনার বড় একটি অংশ নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। এক পর্যায়ে মিত্র বাহিনী হানাদার বাহিনীর ফুলতলা অবস্থানের উপর বিমান হামলা চালালে হানাদার বাহিনী পালিয়ে যায়। 

১৫ ডিসেম্বর বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে ১ হাজার ৭০০ সেনা, অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

১৫ ডিসেম্বর ফরিদপুরের মধুখালির কামারখালীতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদার বাহিনীর ঘাঁটির ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। হানাদার বাহিনী ফরিদপুরের দিকে পালাতে শুরু করলে ভারতীয় মিত্রবাহিনী তাদের ধাওয়া করে। এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

১৫ ডিসেম্বর সিলেটের চিকনাগুল চা বাগান থেকে পালিয়ে যাওয়া হানাদার বাহিনীকে ধরতে হানাদার বাহিনীর ঘাঁটি খাদিমগর চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে মুক্তিবাহিনী। এসময় মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার গোলাম রসূল শহীদ হন।

১৫ ডিসেম্বর সিলেটে মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে ৪ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা সালুটিকর বিমান বন্দরের দিকে অগ্রসর হবার পথে গোবিন্দগঞ্জ ও বিশ্বনাথ দখল করে নেন। এ সময়  প্রায় ৩০০ মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নিয়ে ক্যাপ্টেন নবী রাধানগর গোয়াইঘাট আর্টিলারি সাপোর্ট ছাড়াই আক্রমণ করে দখল করে নেন। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে হানাদার বাহিনী পালাতে শুরু করে।

তথ্যসূত্র:

 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র পঞ্চম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।

দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ 

দৈনিক যুগান্তর, ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১

ছবি: নিরাপত্তা পরিষদ থেকে ওয়াকআউট করে বেরিয়ে যাচ্ছেন জুলফিকার আলী ভুট্টো 

আহমাদ ইশতিয়াক

ahmadistiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

2 killed, 1 injured in clash at Meghna sand quarry

Two people were shot dead and one injured in a clash at a sand quarry on the Meghna river, at the bordering area between Munshiganj and Chandpur this evening

1h ago