শহীদ বুদ্ধিজীবী মাওলানা অলিউর রহমান: ৬ দফার পক্ষে গড়ে তোলেন জনসমর্থন

শহীদ বুদ্ধিজীবী মাওলানা অলিউর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের হাতে একটি 'বিশেষ জরুরি' চিঠি লেখেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীর কাছে। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন এক শহীদ বুদ্ধিজীবী মাওলানার কথা, যাকে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর আল-বদরের সদস্যরা।

বঙ্গবন্ধু তার চিঠিতে লিখেছিলেন, ''মৌলানা ওলিউর রহমান একজন পুরানা আওয়ামী লীগার, আওয়ামী উলামায়ে পার্টির সভাপতি এবং সর্বপরি একজন আওয়ামী লীগার হিসাবে আপনার নিকট সুপরিচিত বলিয়া আমি মনে করি। বাংলাদেশের জন্য তাহার মূল্যবান অবদান 'ইসলামের দৃষ্টিতে ৬ দফা' 'যুক্তির কষ্টির পাথর ৬-দফা,'  '৬ দফা ইসলামের বিরোধী নহে' প্রভৃতি পুস্তিকাবলীর প্রকাশনা।'

তিনি আরও লেখেন, 'এই চিঠি দিয়া আপনাকে এই পরিবারের সাহায্যের জন্য প্রার্থনা জানাইতেছি যার ফলে এই পরিবার একটি উপযুক্ত এবং মোট কিছু টাকা এবং মাসিক একটি ভাতা পাইয়া নিজেদের কোন প্রকার চালাইয়া নিয়া এবং শিশুদের পড়াশোনার খরচ চালাইয়া নিতে পারে।'

মাওলানা অলিউর রহমান একজন সুপরিচিত এক হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকও ছিলেন। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রথম তালিকাতে মাওলানা অলিউর রহমানের নাম শহীদ চিকিৎসক-বুদ্ধিজীবী হিসেবে উল্লেখ করা থাকলেও স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও মেলেনি স্বীকৃতি-প্রাপ্য সম্মান।

ছবিতে অসহযোগ আন্দোলনের সময় আওয়ামী ওলামা পার্টির উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া সংবর্ধনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে মাওলানা অলিউর রহমানকে দেখা যাচ্ছে (ডান থেকে তৃতীয়)।

স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে আজ আরও এক ১৪ ডিসেম্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরে আরও অজস্র শহীদ বুদ্ধিজীবীর মতো তারও পরিবারের দাবি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির।

মাওলানা অলিউর রহমানের জন্ম ১৯৩২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সিলেট সদর উপজেলার টুকেরবাজার ইউনিয়নের মইয়ারচর গ্রামে। হজরত শাহজালাল (র.)-এর সহযোগী হজরত কামাল উদ্দিন শাহ-এর বংশধর শাহ হাবিবুর রহমান খোরাসানী (রহ) ও আজিবুন্নেছার সন্তান মাওলানা অলিউর রহমান ১৩ ভাইবোনের মধ্যে ছিলেন সবার বড়।

অত্যন্ত কষ্টের মধ্যে পড়াশোনা করে ১৯৪৯ সালে আলিম এবং পরবর্তী বছর উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৫১ সালে ফাজিল পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে তৃতীয় ও ১৯৫৩ সালে দাওরায়ে হাদিস বিষয়ে টাইটেল পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে তৃতীয় হন। 

মাওলানা অলিউর রহমানের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৫৩ সালে বরিশালের আহমদিয়া মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে। ১৯৫৪ সালে সিলেট ফিরে এসে সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। যা ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত চালিয়ে যান তিনি।

চাকরি ছেড়ে ১৯৬০ সালে তিনি চলে যান ঢাকায়। বেশ কিছুদিন বাংলা একাডেমির উর্দু ও আরবি অনুবাদক ও গবেষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেসময় তাফসিরকারক হিসেবেও সারাদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের করাচি থেকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা সনদ পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করে ঢাকার জিনজিরায় 'আরোগ্য কুঠির' নামে হোমিও চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে তোলেন।

ব্যক্তিগত জীবনে তার পরিবারে ছিলেন স্ত্রী তরিকুন্নেসা ও দুই সন্তান। যার মধ্যে ছেলে মোহাম্মদ জুনায়েদ খোরাসানী সিলেটের আব্দুস সাত্তার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন।

ভাষা আন্দোলনে মাওলানা অলিউর 

১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে ভাষার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালালে শহীদ হন সালাম-বরকতরা। সিলেটের গোবিন্দচরণ পার্কও তখন তমদ্দুন মজলিস আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে উত্তাল।

চাচা অধ্যাপক সফিউর রহমান খোরাসানীর সঙ্গে সে সভায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেন মাওলানা অলিউর। তার প্রচেষ্টায় সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায় অর্ধদিবস হরতালও পালন করা হয়।

রাজনৈতিক জীবন ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সখ্যতা 

১৯৬০ সালে ঢাকায় স্থায়ী হওয়ার পর মাওলানা অলিউর লেখালেখি ও তাফসিরের পাশাপাশি রাজনৈতিক চর্চাও শুরু করেন। প্রথমে তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী 'উত্তেহাদুল উলামা' সংগঠনে যোগ দিয়ে প্রাদেশিক সহসভাপতি ও ঢাকার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান। কিন্তু জামাতের সাথে আদর্শিক দ্বন্দ্ব দেখা দিলে তিনি পদত্যাগ করেন।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ঘোষণা করলে মাওলানা অলিউর রহমান এই ৬ দফার মধ্যে বাঙালির বঞ্চনামুক্তির দলিল দেখতে পান। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদী ৬ দফার বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করলে তিনি মওদুদীকে চিঠি লিখে বাঙালিদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টানোর আহবান জানান। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদেরও চিঠিতে এই আহবান জানান তিনি।

৬ দফা দাবির আন্দোলনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হয় মাওলানা অলিউর রহমানের। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি গঠন করেন 'আওয়ামী উলামা পার্টি'। দলটি প্রথম থেকেই প্রকাশ্যে ৬ দফার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে কাজ শুরু করে।

উলামা পার্টির প্রতিষ্ঠায় ৪টি উদ্দেশ্য ছিলো—আলেম সমাজকে অর্থনৈতিক দুর্গতি থেকে রক্ষা করে অধিকার সচেতন করা, পাকিস্তানে স্বতন্ত্র ধর্ম দপ্তর প্রতিষ্ঠা, পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে ধন-সম্পদের সুষম বণ্টানের পরিপ্রেক্ষিতে ৬ দফার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া এবং সমাজকে শোষণ ও কলুষ মুক্ত করা।

৬ দফার সপক্ষে জনসমর্থন গড়তে ও জামায়াতে ইসলামীর প্রোপাগান্ডা প্রতিহত করতে তিনি 'শরীয়তের দৃষ্টিতে ৬ দফা' নামে এটি পুস্তিকা লিখেন। এ ছাড়া তার লেখা '৬ দফা ইসলামের বিরোধী নহে', 'যুক্তির কষ্টির পাথর ৬ দফা', 'স্বতন্ত্র ধর্ম দপ্তর: একটি জাতীয় প্রয়োজন এবং জয় বাংলা ও কয়েকটি স্লোগান প্রসঙ্গে', ইত্যাদি পুস্তক আলেমদের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও ৬ দফা নিয়ে জামায়াতের দেওয়া ভুল ধারণা ভাঙতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বঙ্গবন্ধুর লেখা চিঠির কপি। ছবি: সংগৃহীত

'ধর্মের নামে ওরা ধার্মিককে করেছে হত্যা'

১৯৭২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকায় মাওলানা অলিউর রহমানকে নিয়ে একটি উপ-সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়— 'ধর্মের নামে ওরা ধার্মিককে করেছে হত্যা' শিরোনামে। সেখানে লেখক মাহফুজুল হক মাহফুজ লেখেন কীভাবে স্বাধীনতার দুই দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় মাওলানা অলিউর রহমানকে।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে মাওলানা অলিউর ছিলেন ঢাকার লালবাগের হাজী সাহাবুদ্দিনের বাড়িতে। ১০ ডিসেম্বর শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করতে মসজিদে গেলে স্থানীয় এক জামায়াত নেতা তাকে চিনতে পেরে কথা বলেন। নামাজ শেষ করে বাসায় এলেও তাকে নজরে রাখা হয়।

পরদিন ভোরে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়। সব বুদ্ধিজীবীদের যেভাবে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেভাবেই মাওলানা অলিউর রহমান ও হাজী সাহাবুদ্দিনকে তুলে নিয়ে যায় আল-বদর বাহিনী। 
রাতের বেলা রায়েরবাজার ঝিলের পাড়ে ইটের স্তুপের মধ্যে পাথর চাপা দিয়ে রেখে এবং দিনেরবেলা কুঠুরিতে আবদ্ধ রেখে দিনরাত নির্যাতন চলতে থাকে মাওলানার ওপর। 

১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১। বেয়নেট চার্জ করে খুঁচিয়ে চোখ উপড়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় মাওলানা অলিউর রহমানকে। হাজী সাহাবুদ্দিনকে ছেড়ে দিলে তিনি ফিরে এসে এ নৃশংসতার কথা জানান সবাইকে। কিন্তু মাওলানা অলিউরের মরদেহ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি কোথাও।

মাওলানার ছোট ভাই, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটর অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তৎকালীন ইন্সট্রাক্টর (পরবর্তীতে অধ্যাপক) সফিউর রহমান খোরাসানী ভাইয়ের মরদেহের অনেক খোঁজ করেন। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও ছাপান। কিন্তু মাওলানার আর কোনো খবর বা মৃতদেহের সন্ধান পাননি তার পরিবার। 

মেলেনি স্বীকৃতি, অপেক্ষায় পরিবার 

বাংলা একাডেমি প্রকাশিত রশীদ হায়দারের 'স্মৃতি ৭১'-এর দশম খণ্ডে (পুনর্বিন্যাসকৃত চতুর্থ খণ্ড) মাওলানা অলিউর রহমানের আত্মত্যাগের কথা উল্লেখ আছে।

বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজের সম্পাদনার বই 'মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ'-এ উল্লেখ রয়েছে মাওলানা চিকিৎসক অলিউর রহমানের নাম।

১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রথম বুদ্ধিজীবী তালিকায়ও রয়েছে মাওলানা অলিউর রহমানের নাম। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও তিনি পাননি যথাযথ সম্মান ও স্বীকৃতি।

গতবছর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রস্তুতের কাজ শুরু করেছে। গত ২৫ মার্চ প্রথম ধাপে ১৯১ জন বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রকাশ করে মন্ত্রণালয়। তারপর থেকে যেন থমকে আছে এর অগ্রগতি।

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে মাওলানা অলিউর রহমানের ছেলে মোহাম্মদ জুনায়েদ খোরাসানী তার পিতার সম্পর্কিত সব তথ্য জানিয়ে এখনো শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়ার বিষয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, 'শহীদ বুদ্ধিজীবীদের গেজেটভুক্ত করে মূল্যায়নের যে উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়, তাতে আমার পিতা চিকিৎসক মাওলানা অলিউর রহমানসহ সব শহীদ বুদ্ধিজীবীরা স্বীকৃতি পেলে তাদের পরিবার স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে হলেও শান্তি পাবেন।'

Comments

The Daily Star  | English

2 killed, 1 injured in clash at Meghna sand quarry

Two people were shot dead and one injured in a clash at a sand quarry on the Meghna river, at the bordering area between Munshiganj and Chandpur this evening

41m ago