শহীদ ড. সিরাজুল হক খান: এক আলোকিত জীবনের অকাল অবসান
আপনি যদি গুগলে 'যুদ্ধের সময় পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড' লিখে সার্চ করেন, তাহলে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোর বর্ণনা সম্বলিত ওয়েবপেইজের লিংকই দেখা যায় সেখানে। ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১—পরাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত ও সহিংস একটি দিন, যে দিনটিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে প্রতি বছর পালন করা হয়। এর বাইরে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু লিংক ছাড়া তেমন কিছু গুগলে খুঁজে পাওয়া যায় না, কারণ এ ধরনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণের মাধ্যমে, পরিকল্পিতভাবে একটি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে খোঁড়া করার জঘন্য উদ্দেশ্য নিয়ে এরকম নির্বিচার গণহত্যার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর নেই বললেই চলে।
এ নারকীয় দিনটির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে শুধুমাত্র ২৫ মার্চের ভয়াল, কালরাতকে। ১৪ ডিসেম্বরের পাশাপাশি ২৫ মার্চে শহীদদেরও স্মরণ করা হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে।
এই দুটো দিনে কী হয়েছিল, বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বরে? যা হয়েছিল, তা হচ্ছে একটি পৃথিবীর ইতিহাসের যে কোনো সময়কালের বিবেচনায় একটি দেশের বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ওপর সবচেয়ে কাপুরুষোচিত ও বর্বর হামলা, যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে 'শিক্ষা দেওয়া' ও 'দুর্বল করে দেওয়া।' একে গণহত্যা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। হাজার হাজার নিরীহ বুদ্ধিজীবীদের তাদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় রাজাকার, আল বদর ও আল শামস বাহিনীর সদস্যরা। মুখে মুখোশ পড়া এই নির্দয় অস্ত্রধারীরা পরবর্তীতে একে একে হত্যা করেন দেশের সূর্য সন্তানদের।
মৃতদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, লেখক, সাংবাদিক, কবি ও অন্যান্য অনেক সৃজনশীল ও ইতিবাচক মানসিকতার মানুষ।
এখন বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত, যে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার ও শান্তি কমিটি এই গণহত্যার পুরো বিষয়টিকে সুপরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন করেছিলেন। এটি কোনো যুদ্ধ জয়ের কৌশল ছিল না। এটি ছিল একটি বেপরোয়া ও শেষ মুহূর্তের উন্মাদনা। পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ পেয়ে তারা দীর্ঘমেয়াদে জয়ী হতে চেয়েছিল। এটা সেই যুদ্ধ, যে যুদ্ধে আমাদের জিডিপি তাদের চেয়ে পিছিয়ে থাকে, আমাদের নারীরা শিক্ষার আলো না পায়, গরীবরা ৩ বেলা খেতে পায় না আর নবীনরা প্রৌঢ় হতে পারে না এবং আমাদের নবজাতকরা বড় হতে পারে না। এটি হচ্ছে সেই যুদ্ধ, যেখানে আমরা পেছাতেই থাকি এবং আমাদের পরাজয় অনিবার্য হয়ে যায়। অন্তত তারা তাই ভেবেছিলেন।
সেদিনটি যুদ্ধ চলাকালীন অন্য যে কোনো দিনের মতোই ছিল। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ড. সিরাজুল হক খান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোড সংলগ্ন স্টাফ কোয়ার্টারের বাসভবনে তার সহকর্মী ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করছিলেন। আলোচনায় ছিল নিরাপত্তার জন্য ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে একই ধরনের উপদেশ পেয়ে থাকলেও, যুদ্ধের পুরো ৯ মাসে তিনি ও তার পরিবার স্টাফ কোয়ার্টারের ১৬ নং দালানের বাসভবন ছেড়ে যাননি। সবাই যখন শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছিল নিরাপত্তার জন্য তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ কোয়ার্টারের বাসভবনে থেকে বিভিন্নভাবে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য ও সহযোগিতা দিয়ে গিয়েছেন।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর, রাজাকার, আলবদর বাহিনীর হাতে অপহৃত এবং নিহত হওয়ার আগপর্যন্ত ড. সিরাজুল হক খান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্রের শিক্ষা প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক।
সারা জীবন তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চায় এবং তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। তিনি স্কুল টেক্সট বুক বোর্ডের বেশ কিছু ইংরেজি, বাংলা এবং ইতিহাস বই লিখেছিলেন। কথিত আছে যে 'গণি মিয়া একজন কৃষক। তিনি তার মেয়ের বিবাহ দিতে গিয়ে অনেক টাকা কর্জ করিয়া ফেলিলেন' গল্পটিও ওনারই লেখা।
শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. সিরাজুল হক খানের জন্ম ১৯২৪ সালের পহেলা জানুয়ারি, ফেনী জেলার ফুলগাজী থানার সাতকুচিয়া নামে ছোট এক গ্রামে।
ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখা ও জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে অপরিসীম আগ্রহ। প্রায়শই ঘরে আলোর অভাবে তাকে রাস্তার দাঁড়িয়ে পড়তে দেখা যেত।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন খুবই সুশৃঙ্খল ও নীতিবান। নিজের আদর্শগুলোকে ছেলে-মেয়েদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাইতেন সবসময়। ভোরে নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন এবং প্রতিদিন সকালে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দৈনিক পত্রিকা পড়তে বসতেন কাজে যাওয়ার আগে। বিকেলে মাগরিবের আজানের আগেই সবাইকে ঘরে ফিরতে হতো। বাসায় যারা কদাচিৎ দেরি করে ফিরতেন, তারা অনিবার্যভাবে তিরস্কারের শিকার হতেন।
বাসায় একটি সাদা কালো টেলিভিশন ছিল, কিন্তু সন্তানদের অনুমতি ছিল না টিভি দেখার। শুধুমাত্র রাতের সংবাদ দেখার ব্যাপারটি সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। সেসময়টিতেই তিনি পুরো পরিবারকে সাথে নিয়ে সময় কাটাতেন।
ন্যায়নীতির ক্ষেত্রে তিনি কখনো আপোষ করেননি। ১৯৪৩ সালে বি.এ পাস করার পর সরকারের কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ বিভাগে ইনস্পেক্টর হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। কিন্তু এই চাকরিতে তার বেশিদিন থাকা হয়নি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছ থেকে অবৈধ অর্থ লেনদেন এবং ঘুষ সংক্রান্ত প্রস্তাব পেয়ে অত্যন্ত রাগান্বিত এবং অপমানিত বোধ করেছিলেন তিনি।
১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এড ডিগ্রি নেন। সে বছরেই মার্কিন সরকারের একটি বৃত্তি পেয়ে কলোরাডো স্টেট কলেজে ডক্টর অব এডুকেশন প্রোগ্রামে যোগ দেন। তিনি ১৯৬৭ সালে ডক্টর অব এডুকেশন ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৬৮ সালের ১১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।
উচ্চতর শিক্ষা শেষে দেশে এসে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কিছু করবেন এ ব্যাপারটিতে সংকল্পবদ্ধ ছিলেন ড. সিরাজুল হক খান। অনেকেই তাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে বিদেশে ভাল ক্যারিয়ার এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে। সেখানে থেকে গেলে তার নিজের এবং পরিবারের জন্য ভালো হবে। কিন্তু তিনি কারো কথা শোনেননি।
ড. সিরাজুল হক খান ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চিন্তার ধারক ও বাহক এবং বামপন্থী রাজনীতির প্রতি সহানুভূতিশীল। শুরু থেকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন এবং সেই চেতনা তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন তার পরিবারের মাঝেও।
তার ছেলে মো একরামুল হক খান সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, 'আমার বাবা অন্য একটি ফ্ল্যাটে ছিল সে সময়। যখন তারা (রাজাকার বাহিনী) দরজায় ধাক্কা দেয়, আমার ছোট চাচা দরজা খুলে দেন।'
পেশায় স্থপতি একরামুল হক খান জানান, প্রথমে তার চাচা শামসুল হক খান অজ্ঞাতনামা, মুখোশধারী ব্যক্তিদের জানান সেখানে সিরাজুল নামে কেউ থাকে না। কিন্তু এক পর্যায়ে তাদের জেরা ও প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে তিনি উল্লেখ করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক সেখানে থাকেন, তবে তিনি সে মুহূর্তে ভিন্ন একটি ফ্ল্যাটে আছেন।
পরবর্তী ৭-৮ সদস্যের মুখোশধারী দলটি ড. সিরাজুল হক খানের চোখ বেঁধে থাকে একটি লাল রঙের 'ইপিআরবি' (বর্তমানে বিআরটিসি) লেখা মাইক্রোবাসে করে ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে দলের সদস্যদের 'আল বদর' বাহিনীর সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
তার স্ত্রীর বানানো চা ও সকালের ওষুধ না ছোঁয়া অবস্থায় পড়ে থাকে। সেদিনের পর ড. সিরাজুলকে তার ১০ সদস্যের পরিবারের কেউ আর কখনো জীবিত অবস্থায় দেখেননি।
পরবর্তীতে তার লাশ উদ্ধার হয় মীরপুরের বধ্যভূমি থেকে। তার সন্তানরা কঙ্কালে পরনের কাপড়ের ছেঁড়া অংশ ও হাতের ঘড়ি দেখে তাকে শনাক্ত করেন।
ড. সিরাজুল হক খানকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের খুব কাছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়।
এভাবেই একটি গৌরবান্বিত, আলোকোজ্জ্বল ও অসাধারণ জীবন অকালে ঝরে যায় এবং শুরু হয় ড. সিরাজুলের বাকি ৯ সদস্যের বেঁচে থাকার সংগ্রাম এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা।
তার মতো আরও অনেক পরিবারের গল্পগুলো একইরকম, যারা তাদের মূল জীবিকা অর্জনকারী ব্যক্তিদের হারিয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। সরকার কিছুটা সাহায্য সহায়তা করেছে, তবে তা কখনোই যথেষ্ট ছিল না। এমন কী এসব সুবিধা পেতেও অনেককে অনেক রকম হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।
ড. সিরাজুল হক খানের স্ত্রী বেগম সুরাইয়া খানমকে আজীবন তার ৮ সন্তানকে লালন পালন করে বড় করার জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে। তার স্বামীর মৃত্যুর সময় তাদের সবচেয়ে বড় ছেলে মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে এবং সবচেয়ে ছোট ছেলে তখনো ভাই বোনদের কোলে কোলে বড় হচ্ছে। দুই বড় সন্তানের ঘাড়ে চাপে তাদের বাকি ভাই বোনদের পড়ালেখা করিয়ে বড় করার এবং পুরো পরিবারের জন্য এটি ছিল একটি দীর্ঘ ও কঠিন যাত্রা।
মূলত স্পষ্টবাদিতা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দৃঢ় অবস্থানের কারণেই তার নাম চলে গিয়েছিল রাজাকার, আলবদর বাহিনীর হত্যা তালিকায়।
পরবর্তীতে বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খানকে ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড দেয় ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। এই দুজনের বিরুদ্ধে অন্যতম সাক্ষী ছিলেন, ড সিরাজুল হক খানের জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রয়াত ড এনামুল হক খান। কয়েক দশক ধরেই চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ব্রিটেনে এবং আশরাফুজ্জামান খান যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন।
Comments