সহযোদ্ধার চোখে বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর
আজ ১৪ ডিসেম্বর বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের ৫০তম শাহাদাত দিবস। চাঁপাইনবাবগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করতে ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন তিনি।
সহযোদ্ধাদের চোখে বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও অকুতোভয় যোদ্ধা। স্বাধীন দেশ নিয়ে তার স্বপ্নও ছিল অনেক। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র ২ দিন আগে তিনি শাহাদাতবরণ করেন।
বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের সঙ্গে ওই যুদ্ধে যারা ছিলেন তাদের একজন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কালুপুর গ্রামের বজলুর রশিদ সোনু।
মরদেহ উদ্ধারের পর তা শিবগঞ্জ হয়ে সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে দাফনের কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই সহযোদ্ধা ৫০ বছর পর সেই স্মৃতি তুলে ধরেন দ্য ডেইলি স্টার'র কাছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুর রশিদ সোনু জানান, ১০ শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে যুদ্ধ শুরু হলে তিনি জেলার তেলকূপি সীমান্ত অতিক্রম করে এপ্রিল মাসে পশ্চিমবঙ্গের মালদার এনায়েতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে রিক্রুটিং ক্যাম্পে যান। সেখানে ১ সপ্তাহ থাকার পর তাকে শিলিগুড়ি পাঠানো হয়।
এরপর ১ মাস অস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে তাকে দিনাজপুরের বালুরঘাটে পাঠানো হয়। যুদ্ধের জন্য সেখান থেকে পাঠানো হয় মালদহর মোহদিপুর ক্যাম্পে। তিনি জেলার বিভিন্নস্থানে যুদ্ধে অংশ নেন।
তিনি বলেন, 'ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় মে মাসে। তিনি সাধারণ মানুষের মতো লুঙ্গি-গেঞ্জি পরতেন। থাকতেন মুক্তিবাহিনীর অন্য সবার সঙ্গে। খাওয়া-দাওয়াও করতেন একই। একজন কমান্ডার হিসেবে ছিলেন সফল। সফল ছিলেন গেরিলা যুদ্ধেও। তার একটাই স্বপ্ন ছিল। তা হলো মাতৃভূমিকে মুক্ত করার স্বপ্ন।
'ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর একদিন সবাইকে ক্যাম্পে বললেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করতে কে কে যাবে। সেদিনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা তার নেতৃত্বে বারঘরিয়ার লক্ষ্মীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অস্থায়ী ক্যাম্পে অবস্থান নিই।'
'১৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর প্রায় ৫০ জন মুক্তিসেনা নিয়ে কয়েকটি নৌকায় আকন্দবাড়িয়া ঘাট দিয়ে মহানন্দা নদী পার হয়ে শহরের রেহাইচরে অবস্থান নেন। বাকিরা বারঘরিয়ায় অবস্থান নেন।'
'মহানন্দার দক্ষিণ পাশে বর্তমান সেতুর কাছে পাকিস্তান সেনাদের ঘাঁটি ছিল' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'সেখানে ১৪ ডিসেম্বর খুব ভোরে হানাদার বাহিনীর বাঙ্কার ধ্বংস করা হয়। দিনভর যুদ্ধে পাকিস্তানিরা পিছু হটে। কিন্তু, সন্ধ্যার দিকে এক পর্যায়ে চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ঘটনাস্থলেই শহীদ হন।'
'আমরা তার মরদেহ সেখান থেকে মহানন্দা পার করে শিবগঞ্জ নিয়ে যাই। পরদিন ১৫ ডিসেম্বর শিবগঞ্জ হাসপাতালে প্রথম জানাজা ও পরে দ্বিতীয় জানাজা শেষে সোনা মসজিদ চত্বরে মুক্তিযুদ্ধের আরেক বীরযোদ্ধা শহীদ মেজর নাজমুল হকের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।'
বজলুর রশিদ সোনু জানান, বিজয়ের মাত্র ২ দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর একাত্তরের এই দিনে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। বরিশালের টগবগে তরুণ এই সামরিক কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর সব সময় মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার কথা ভাবতেন।
শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ১৯৪৫ সালের ৬ মার্চ বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার রহিমগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালে মুলাদী মাহবুদজান উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন।
বরিশাল বিএম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করার পর ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হন। ওই বছরই তিনি ক্যাডেট হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।
প্রশিক্ষণ শেষে ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে কমিশন লাভ করে তিনি ১৭৩ মুলতান ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়নে যোগদান দেন। প্রায় ৬ মাস পর তাকে রিসালপুর মিলিটারি কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বদলি করা হয়।
১৯৭১ সালে কারা কোরামে কর্মরত থাকাকালে ১৫ দিন ছুটি নিয়ে রিসালপুরে ফিরে যান। একদিন পর শিয়ালকোট সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন এবং পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার মোহদীপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগ দেন। তাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে যুদ্ধের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তিনি ছিলেন ৭ নং সেক্টরের মোহদীপুর সাব-সেক্টর কমান্ডার। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন লে. কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান।
Comments