শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: এ অপূরণীয় ক্ষতি শুধুই ব্যক্তিগত নয়
১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর পুরো লালমনিরহাট শহরজুড়ে নেমে আসে শোক ও আতঙ্ক। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী কয়েকজন উর্দুভাষী বিহারির সহায়তায় রেলস্টেশনের কাছে কয়েক শ মানুষকে হত্যা করে। ছোট্ট এই জেলা শহরের বাঙালিরা আতঙ্কে তখন সীমান্তবর্তী গ্রামের দিকে ছুটে যায়।
এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত রেলওয়ে চিলড্রেন পার্ক স্কুলের সহকারী শিক্ষক মোস্তফা হাসান আহমেদ তার সাপটানা পাড়ার বাড়ি ছেড়ে যাবেন কি না, তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন।
তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সেলিমা আহমেদের পক্ষে স্থান পরিবর্তন কঠিন ছিল। গণহত্যার মাত্র ৬ দিন পর তিনি কন্যা সন্তান জন্ম দেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকায় হাসান তার পাঁচ সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে স্বপন ও এক মেয়ে সাকিকে জেলার কাকিনায় তাদের মামাবাড়িতে পাঠিয়ে দেন।
১৯ এপ্রিল তিনি পরিবারের বাকি সদস্যদের নিয়ে বেশ দূরে মোগলহাটে তার পৈতৃক বাড়িতে চলে যাবেন বলে ঠিক করেন।
সেদিন সকালে তারা বাসার সবাই নাস্তা শেষ করে মোগলহাট যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ঠিক তখন পরিবারের নতুন সদস্য নাজনীন সাথীকে দেখতে আসেন তার 'দাইমা' (ধাত্রী), যিনি সাথীর প্রসবের সময় সাহায্য করেছিলেন।
এলাকায় 'বড় আপা' বলে পরিচিত লালমনিরহাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সেলিমা তার মেয়ের দাইমাকে কিছু খাবার ও উপহার দেন। সাথী তখন চুপচাপ বিছানায় শুয়ে ছিল। তার ২ ভাইবোন কুসুম ও মৌসুমও সেখানে খেলছিল।
হাসান কাঁঠাল পাতা ছিড়ে উঠানে ছাগলকে খেতে দিচ্ছিলেন।
ঠিক তখনই একদল বিহারি অস্ত্র নিয়ে বাড়িতে ঢুকে। তারা হাসানকে আটক করে, আর সেলিমাকে ঘিরে ধরে। কিছুক্ষণের মধ্যে ওই দাইমা পালিয়ে যান।
অস্ত্রধারীদের একজন হাসানকে বলেন, 'আমাদের সঙ্গে চলো। মেজর সাহেব তোমাকে ডেকেছেন।'
কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা হাসানকে নিয়ে বাড়ির পাশের মাঠের দিকে চলে যায়। তখন তার সাড়ে ৩ বছর বয়সী ছেলে মৌসুম 'আব্বা' বলে চিৎকার করতে থাকে, আর তার স্ত্রী জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। অব্যক্ত ভয়ে কাঁপছিলেন সেলিমা।
হাসান ওই লোকদের সঙ্গে মাঠের অপর প্রান্তে পৌঁছে পকেট থেকে একটি নামাজের টুপি বের করে পরলেন। তারপর পেছন ফিরে তাকালেন তিনি।
'মা বলেছিলেন, ওই চাহনিই বলে দিচ্ছিল যে তাকে চিরদিনের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর ফিরে আসেননি বাবা', বলছিলেন নাজনীন সাথী। সেই ছোট্ট শিশু নাজনীন এখন একজন লেখক ও সাংস্কৃতিক কর্মী।
মা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে ১৯৭১ সালে ১৯ এপ্রিল তার বাবাকে তুলে নেওয়া ও তার পরের ঘটনাগুলো শুনে বড় হয়েছেন তিনি।
দ্য ডেইলি স্টারকে সাক্ষাৎকারে নাজনীন বলেন, 'বাবাকে চিনি তার ছবি, হাতে লেখা কিছু চিঠি ও পরিচিতজনদের ছোট-ছোট স্মৃতি দিয়ে। বাবা একজন আত্মমর্যাদাপূর্ণ সজ্জন এবং রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন বলে তারা আমাকে বলেছেন।'
ধারণা করা হয়, লালমনিরহাটে বুদ্ধিজীবী হত্যা পরিকল্পনার প্রথম শিকার শিক্ষক হাসান। তবে এই উপসংহারে পৌঁছাতে জেলার যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন নাজনীন।
যুদ্ধের ৯ মাস ধরেই বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করতে সামরিক অভিযান অব্যাহত রেখেছিল পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী। আর তা শেষ হয়েছিল ১৪ ডিসেম্বর। দিনটি এখন শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
আসন্ন পরাজয় বুঝতে পেরে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী স্থানীয় সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে নতুন দেশের ভবিষ্যৎ ধ্বংসের পরিকল্পনা করে। তারা অনেক মেধাবী ও স্বনামধন্য ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে নির্যাতন ও হত্যা করে।
যুদ্ধের শুরুর দিকেই হাসানকে টার্গেট করা হয়। এর কারণও ছিল সহজ। পরিবারের সদস্যদের মতে, তিনি তার ছাত্রসহ অন্যান্যদের যুদ্ধে যেতে উৎসাহ দিতেন, যা অবাঙালিদের ক্ষিপ্ত করে তোলে।
তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে জড়িত না থাকলেও শহরের সব প্রগতিশীল রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। তিনি নিয়মিত রেডিওতে খবর শুনতেন এবং স্থানীয়দের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতেন।
১৯২৮ সালে লাকসামের ফেনুয়াতে জন্মগ্রহণ করেন হাসান। ভারতের আলিপুরদুয়ারের ম্যাকউইলিয়াম উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। সেখানে ম্যাট্রিকুলেশন শেষ করে তিনি ফিরে আসেন এবং রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক শেষ করেন। এরপর ১৯৫৫ সালে বিয়ে করেন।
হাসান প্রথমে পাটগ্রামের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে রাজস্ব সংগ্রহ কর্মকর্তা (আরসিও) হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তিনি ৭ বছর কাজ করেন। এরপর ১৯৬৩-৬৪ সালে তিনি লালমনিরহাটে ফিরে আসেন এবং চিলড্রেন পার্ক স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন।
যুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসে হানাদার বাহিনী লালমনিরহাটে প্রবেশ করে এবং অবাঙালিদের সহায়তায় নৃশংসতা চালায়।
সেদিনের পরের সংগ্রাম
১৯ এপ্রিল সকালে হাসানকে তুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেলিমা তার ৩ সন্তানের সঙ্গে ৮ দিনের নাজনীনকে বুকে জড়িয়ে বাসা থেকে বের হন।
নাজনীন বলেন, 'এরপর আমার মায়ের অকল্পনীয় সংগ্রাম শুরু হয়।'
তিনি প্রতিবেশী কাজী সাহেবের বাসায় যান। খবর শুনে কাজী সাহেব আন্দাজ করতে পারেন কী ঘটতে যাচ্ছে।
ঠিক তখনই তারা দেখতে পান একদল বিহারি তাদের প্রতিবেশী রেলওয়ে কর্মকর্তা রোকন উদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে।
সময় নষ্ট না করে কাজী সাহেব সেলিমার পরিবারসহ নিজের পরিবারকে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু, তার আগেই বিহারিদের দল ওই বাড়িতে এসে হাজির হয়।
'কাজী সাহেব, আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে', দলের একজন বললেন।
বিপদ ওঁৎ পেতে আছে বুঝতে আর দেরি হয় না সেলিমার। তিনি নিজেই দ্রুত রওনা হন। আর শুরু করেন এক অভিযাত্রার। তার সঙ্গে যোগ দেন আরও ২ নারী ও তাদের সন্তানরা।
তিনি মোগলহাটে হাসানের পৈতৃক বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যেতে যেতে দেখলেন পথের পাশের ঘরগুলো আগুনে পুড়ছে, লোকজন প্রাণ বাঁচাতে দৌঁড়াচ্ছে। তিনিও দ্রুত চলতে থাকেন।
এক পর্যায়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল তাদের পথরোধ করে। সৈন্যরা তাদের জিজ্ঞাসা করে তারা কোথায় যাচ্ছে। তবে তাদের সঙ্গে কোনো যুবক না থাকায় তাদের যেতে দেয়। সারাদিন হাঁটার পর অবশেষে মোগলহাটে পৌঁছান সেলিমা।
নাজনীন বলেন, 'একজন নারী যিনি মাত্র ৮ দিন আগে সন্তান জন্ম দিয়েছেন, তিনি কীভাবে এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিলেন তা কল্পনা করুন। তিনি সেদিন প্রায় ১৭-১৮ মাইল পথ হেঁটেছিলেন।'
কয়েকদিন শ্বশুর বাড়িতে থাকার পর, সেলিমার দেবর তাদের গরুর গাড়িতে করে মোগলহাটের উত্তর-পশ্চিমে গন্ধমারুয়া নামে আরেকটি প্রত্যন্ত গ্রামে পাঠিয়ে দেন।
তিনি সেখানে কয়েক সপ্তাহ কাটিয়ে কাকিনায় বাবার বাড়িতে যান। যেখানে তিনি জানতে পারেন যে বিহারিরা তাদের মাস্টারপাড়ার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে।
এরপর সেলিমা তার বাবা ও ভাইদের সহায়তায় তার স্বামীকে খুঁজতে থাকেন। তার ছবি নিয়ে নানা জায়গায় যান। তিনি তার বাবার সঙ্গে রংপুর সেনানিবাসে গিয়েছিলেন। কিন্তু, হাসানকে কোথাও পাওয়া যায়নি।
এরপর জুলাইয়ে তিনি লালমনিরহাট শহরে ফিরে আসেন। বোরকা পরে তিনি বেশ কয়েকজন বিহারির বাড়িতেও গিয়েছিলেন। কিন্তু, কোনো সন্ধান পাননি। তবে, তিনি ওই বাড়িগুলোতে অস্ত্রের স্তূপ দেখেন।
নাজনীন বলেন, 'কিছু মানুষ বলেছিলেন যে আমার বাবাকে হয়তো অন্য কোথাও আটকে রাখা হয়েছে এবং পরিস্থিতি শান্ত হলে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে। মা ৯ মাস অপেক্ষা করেছিলেন এবং দেশ স্বাধীনের পরও বাবা ফিরে আসেননি।'
অবশেষে ১৯৭২ সালে সেলিমা লালমনিরহাট শহরে ফিরে এলে এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে জানতে পারেন বিহারিরা যেদিন তাকে তুলে নিয়ে যায়, সেদিনই তাকে লালমনিরহাট বয়েজ স্কুলের পেছনে নিয়ে হত্যা করে।
২০০০ সালে মারা যান সেলিমা।
নাজনীন বলেন, 'যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও মা একাই আরেকটি যুদ্ধ করেন। আসলে, সব শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের গল্প একই রকম।'
আবেগ ও গর্বভরা কণ্ঠে তিনি বলেন, 'শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস যেহেতু প্রতি বছর আসে, আমি মাটির কৃতী সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বুদ্ধিজীবীদের কবরস্থান ও স্মৃতিসৌধে যাই।'
'বাবার কবর নেই। মনে হয় সারা বাংলাদেশেই তার কবর। গোটা দেশটাই কি শহীদদের কবরস্থান নয়?'
অনুবাদ করেছেন মুনীর মমতাজ
Comments