যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ পদোন্নতি

নজরুল ইসলাম ১৯৯০ সালে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে প্রবেশিকা পর্যায়ের একটি পদে যোগদান করেন। নিয়োগ পরীক্ষায় তিনি ছিলেন তালিকার শীর্ষে। ১৫ বছর ধরে 'সন্তোষজনক' পারফরমেন্স সত্ত্বেও ২০০৫ সালে তিনি চাকরিতে স্থায়ী হন। নজরুল এখন সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা। চাকরি ক্ষেত্রে তার রেকর্ডও নিস্কলুষ।

উচ্চ পদের জন্য নির্বাচিত কর্মকর্তাদের তালিকায় নজরুলের অবস্থান ছিল ষষ্ঠ। নতুন পদে কর্মকর্তা বাছাইয়ের জন্য গঠিত অধিদপ্তরের নিজস্ব কমিটি চাকরির মেয়াদ ও রেকর্ডের ভিত্তিতে এই তালিকা তৈরি করে।

তালিকাটি মূলত তৈরি করা হয়েছিল ২০১৬ সালে। তবে কয়েক বছর ধরে আদালতে লড়াইয়ের পর চলতি বছরের অক্টোবর মাসে তা চূড়ান্ত হয়। কিন্তু গত মাসে অধিদপ্তর যখন পদগুলোর জন্য আদেশ দেয়, তখন চূড়ান্তভাবে হতাশ নজরুল দেখতে পান তালিকা থেকে তার নামটি কাটা পড়েছে।

২৫ নভেম্বরের ওই আদেশে অধিদপ্তর ১১২ জন সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার 'চলতি দায়িত্ব' দেয়।

নজরুল বলেন, 'আমার কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। ক্যারিয়ারে বাজে রেকর্ডও নেই। তারপরেও আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে।'

এভাবে নজরুলের মতোই পদোন্নতি প্রত্যাশী প্রায় ৭০ জন কর্মকর্তাকে নতুন পদ থেকে বঞ্চিত করেছে অধিদপ্তর। যারা ফিট লিস্টে ছিলেন। বিপরীতে পদোন্নতি পেয়েছেন তালিকার নিচের দিকে থাকা ব্যক্তিরা।

চলতি বছরের ২৮ অক্টোবর যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় পদোন্নতি সংক্রান্ত একটি আদেশ দেয়। যেখানে গ্রেডেশন তালিকার ভিত্তিতে পদোন্নতি প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে বলা হয়। তাই অধিদপ্তরের এই সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়ের আদেশেরও লঙ্ঘন। কারণ এ ক্ষেত্রে তারা যথাযথভাবে তালিকা অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ সচিবও বলেন, পদোন্নতির বিষয়ে দেওয়া আদেশ অনুসারে এটি ফিট লিস্টেই আটকে থাকা উচিত ছিল। আর নতুন পদ থেকে বঞ্চিত কর্মকর্তারা এ ক্ষেত্রে ঘুষ, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফিট লিস্টের প্রথম ১০ জনের মধ্যে থাকা এক কর্মকর্তা বলেন, 'পদোন্নতির জন্য কয়েকজন সহকর্মী আমাকে ঘুষ হিসেবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ৫ লাখ টাকা দেওয়ার জন্য প্ররোচিত করেন। কিন্তু আমি তা প্রত্যাখ্যান করি। এখন আমাকে আমার জুনিয়রের অধীনে কাজ করতে হবে। যা অপমানজনক।'

ওই কর্মকর্তাও জানান যে, কর্মক্ষেত্রে তার কোনো বাজে রেকর্ড নেই।

উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার 'চলতি দায়িত্ব'সহ নতুন এই পদ ভবিষ্যৎ পদোন্নতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। সাধারণত যখন কোনো পদ শূন্য হয়, তখন ওই পদে 'চলতি দায়িত্ব' পালনকারীরা পদটি পান।

আর একবার কেউ উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি পেলে তারা উচ্চ বেতন ও মর্যাদাসহ প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হয়ে উঠেন।

২৮ নভেম্বর অধিদপ্তর পদোন্নতি সংক্রান্ত আদেশ দেওয়ার ৩ দিন পর কিছু সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তা অনিয়মের অভিুযোগ তোলেন এবং এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বরাবর চিঠি লেখেন। এই ঘটনার ২ দিন পর পদবঞ্চিত কর্মকর্তারা ঢাকার ১ নম্বর প্রশাসনিক ট্রাইবুনালে আদেশটি চ্যালেঞ্জ করেন।

সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বরাবর লেখা চিঠির একটি কপি দ্য ডেইলি স্টার'র হাতে আছে। ওই চিঠিতে বলা হয়, '(যুব উন্নয়ন) অধিদপ্তরের বর্তমান মহাপরিচালক আজহারুল ইসলাম খান নিজেকে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে ফেলেছেন। তিনি একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। যার মাধ্যমে তিনি প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা নিয়ে চলতি দায়িত্ব দিয়েছেন। যে কর্মকর্তারা এমনকি গ্রেডেশন তালিকার নিচের দিকে আছেন।'

একাধিকবার চেষ্টা করেও এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তার ব্যক্তিগত সচিব মঞ্জুরুল হোসেন জানান, প্রয়োনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জ্যাকব চিঠিটি মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবের কাছে পাঠিয়েছেন।

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আখতার হোসেন জানান, তারাও কিছু কর্মকর্তার কাছ থেকে চিঠি পেয়েছেন, যারা পদায়নে অনিয়মের অভিযোগ করেছেন।

মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে অধিদপ্তরের ব্যাখ্যা চাইবে এবং সে অনুসারে ব্যবস্থা নেবে জানিয়ে আখতার হোসেন বলেন, 'চলতি দায়িত্ব কোনো পদোন্নতি নয়। কিন্তু নিয়ম অনুসারে গ্রেডেশন তালিকার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই ধরনের দায়িত্ব দিতে হবে।'

তিনি আরও জানান, তালিকা অনুযায়ী যোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য মন্ত্রণালয় পাবলিক সার্ভিস কমিশন বিভাগে একটি প্রস্তাব পাঠাবে।

এদিকে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আজহারুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়মের সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, 'কোনো অর্থ লেনদেন হয়নি'। এ বিষয়ে তার ভাষ্য, কাজের ক্ষেত্রে কিছু কর্মকর্তা ভালো পারফরমেন্স দেখাতে পারেননি। তারা ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তাই তাদের নতুন পদের জন্য বিবেচনা করা হয়নি।

যাদের কাজের রেকর্ড ভালো তাদের পদবঞ্চিত করার কারণ জানতে চাইলে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, 'যেহেতু এটি একটি রাজনৈতিক সরকার, তাই আমরা পদোন্নতি দেওয়ার সময় রাজনৈতিক বিবেচনার কথাও মাথায় রেখেছি।'

অধিদপ্তরে যোগ দেওয়ার আগে আওয়ামী লীগপন্থী ছাত্র সংগঠনের একটি থানা ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে আজহারুল ইসলাম বলেন, 'রাজনৈতিক বিষয়টি তেমন গুরুতর কিছু ছিল না। বরং যেহেতু তারা একটি অফিসের দায়িত্বে থাকবেন, সেহেতু তাদের পূর্ববর্তী রেকর্ড বিবেচনা করা হয়েছে।'

পদোন্নতির তালিকা থেকে ৭০ জন কর্মকর্তা বাদ পড়ার বিষয়টি স্বাভাবিক কি না জানতে চাইলে মহাপরিচালক প্রশ্নটি এড়িয়ে যান। তিনি জানান, যারা যোগ্য কিন্তু পদ পাননি, তারা শূন্য পদের প্রাপ্যতা সাপেক্ষে ভবিষ্যতে নতুন পদের জন্য বিবেচিত হবেন।

এ ছাড়া, ফিট লিস্ট অনুসরণ না করার বিষয়ে তার ব্যাখ্যা, এটা পদোন্নতির কোনো বিষয় ছিল না। ফিট লিস্ট অনুসরণ না করার কারণ হলো, এটি 'চলতি দায়িত্বের' বিষয়।

পদবঞ্চিত কর্মকর্তাদের অভিযোগ, অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মোখলেসুর রহমান 'ঘুষের বিনিময়ে পদ প্রদানের' ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছেন। পদোন্নতির আদেশে যার স্বাক্ষর আছে।

অবশ্য মোখলেসুর রহমান এই অভিযোগকে 'পুরোপুরি মিথ্যা' বলে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, চলতি দায়িত্বের পদগুলোর জন্য গ্রেডেশন তালিকা অনুসরণের প্রয়োজন নেই।

অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments

The Daily Star  | English

Have patience for election

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus yesterday said the government would issue a roadmap to the election as soon decisions on electoral reforms are made.

5h ago