অজানা এক শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে

এই পুকুরপাড়েই ঘুমিয়ে আছেন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা

পুকুরপাড়ের পাশেই ছোট খাল। দুয়ের মাঝে খানিকটা উঁচু পাড়। এই পুকুরের পাড়েই একটি কবর। ফেনী-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে এই জায়গাটির নাম খোনার পুকুর। গ্রামের নাম দক্ষিণ সেকান্দরপুর।

এখানেই ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প

গ্রামের বাসিন্দারা কেবল জানেন, পুকুর পাড়ের এই কবরটি চির নিভৃতে ঘুমিয়ে থাকা অজানা এক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার। কিন্তু কী নাম সেই মুক্তিযোদ্ধার, কোথায় ছিল তার বাস, কীভাবেই বা তিনি শহীদ হলেন জানেন না গ্রামবাসীদের কেউ।

দাগনভূঁইয়ার আতাতুর্ক উচ্চ বিদ্যালয়ে ছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প ও টর্চার সেল

স্বাধীনতার ৫০ বছরেও নাম না জানা এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম বা ঠিকানা কেউই জানতে পারেননি। বহু অনুসন্ধানের পর অবশেষে জানা গেল সেই মুক্তিযোদ্ধার নাম- পরিচয়, বীরত্বগাঁথা আর আত্মত্যাগ।

কী করে এখানে শেষ ঠিকানা হয়েছিল শহীদ মুক্তিযোদ্ধার?

মুক্তিযুদ্ধের ২৯ নভেম্বর সোমবার দিবাগত রাত। আনুমানিক রাত ৩টা। পরপর বেশ কয়েকটি গুলির তীব্র আওয়াজ শুনতে পেলেন গ্রামবাসী। গুলির শব্দে খোনার পুকুর সংলগ্ন একটি বাড়ির বাসিন্দারা চমকে উঠলেন। যদিও এটি তখন প্রায় নিয়মিত ঘটনা। কিন্তু তীব্র আওয়াজ শুনে মনে হয়েছিল কাছেই কোথাও গোলাগুলি হচ্ছে।

২ গ্রামবাসী দরজা হালকা ফাঁক করে দূর থেকে দেখতে পেলেন রাস্তায় কয়েকটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক খোনার পুকুরের পাড়ে।

পরদিন সকালে গুলির খোসা খুঁজতে গিয়ে সেই বাড়ির ১০ বছরের ফখরুল রাস্তার ধারে এসে দেখতে পেল খোনার পুকুর থেকে খানিকটা দূরে রাস্তার পাশে খালের পাড়ে ঝোপের মধ্যে স্বল্প পানিতে পড়ে আছে পেছনে দুহাত বাঁধা একটি লাশ। চোখ, মুখ এসিড দিয়ে ঝলসানো। সারা গায়ে চরম পাশবিক নির্যাতন আর আঘাতের চিহ্ন।

ডেইলি স্টারের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় সেদিনের সেই বালক ফখরুল ইসলামের সঙ্গে। সেদিনের সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বললেন, 'প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর আমি গুলির খোসা খুঁজতে বের হতাম। তো রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছি। আগের রাতে গুলি হয়েছে তাই আমি গুলির খোসা খুঁজতে লাগলাম। এমন সময় দেখি একটি লাশ পড়ে আছে।'

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হাফেজ আহমদের স্ত্রী খুরশিদা বেগম

'শরীরে খেজুর কাটা দিয়ে ছিদ্র করা। ঝলসে দেওয়া হয়েছে পুরো মুখমণ্ডল, বুকে, পাঁজরে, পেটে গুলির চিহ্ন। তখন আমি গুলির খোসা খোঁজা বাদ দিয়ে বাড়িতে গিয়ে সবাইকে এ কথা বলি।'

সর্ববামে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ওবায়েদ উল্লাহ্‌ ও সর্বডানে প্রত্যক্ষদর্শী ফখরুল ইসলাম

'খবর শুনে স্থানীয় লোকজন ভিড় করতে থাকে। পরদিন দুপুরের দিকে লোকজন বুঝতে পারলো এই লাশ কোনো মুক্তিযোদ্ধারই হবে। কোনো জায়গা থেকে তাকে ধরে এনে নির্যাতনের পর এখানে গুলি করে হত্যা করেছে পাকিস্তানিরা। এরপর কেটে যায় কয়েক ঘণ্টা কিন্তু এভাবে তো আর লাশটি পড়ে থাকতে পারে না। লাশ দাফন করতে হবে।'

'কিন্তু তার জন্য চাই অনুমতি। রাস্তা দিয়ে তখন পাকিস্তানি বাহিনীর ট্রাক যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক। পাকিস্তানি বাহিনী লোকের জটলা দেখলেই বেপরোয়া গুলি চালায়। অন্যদিকে এই লাশ মুক্তিযোদ্ধার জানতে পারলে তো আরও বিপদ।'

তখন স্থানীয় রামনগর ইউনিয়নে রাজাকার কমান্ডার ছিলেন হাশিম মৌলভী। খোনার পুকুরের পার্শ্ববর্তী বাড়ির বাসিন্দা শামসুদ্দিন ভুঁইয়া হাশিম মৌলভীর কাছে গিয়ে বিস্তারিত সব খুলে বলে লাশ দাফনের অনুমতি চাইলেন। কিন্তু হাশিম মৌলভী সাফ জানালেন এই যুবক দেশদ্রোহী এবং কাফের! এর লাশ কবর দেওয়ার জন্য কোনো সাহায্য তিনি করবেন না।

উপায়ন্তর না দেখে বিকেলে শামসুদ্দিন ভূঁইয়া থানার মিলিটারি ক্যাম্পে গিয়ে অনুমতি চাইলে তাকে ফেনীতে নিয়ে যাওয়া হলো। কারণ পাকিস্তানি বাহিনীর আঞ্চলিক দপ্তর তখন ফেনীতে।

এদিকে ফেনীতে নেওয়ার কথা শুনে তার পরিবারে অজানা আশঙ্কায় কান্নার রোল। সবাই ভেবেছিল তাকেও বুঝি ধরে নিয়ে যাওয়া হবে। তিন ঘণ্টা পর সন্ধ্যার দিকে লাশ দাফনের অনুমতি নিয়ে ফিরে আসেন শামসুদ্দিন ভূঁইয়া।

কিন্তু সন্ধ্যা ৬টার মধ্যেই কারফিউ শুরু হয়। শেষমেশ রাত ৯টার দিকে স্থানীয়রা মসজিদের ইমামকে এনে জানাজা পড়ান।

ফখরুল আলম এই প্রতিবেদককে বলেন, 'পাকিস্তানি মিলিটারির গাড়ি চলে যাওয়ার পর আমরা আমাদের কাচারির একটি ভাঙ্গা চৌকিকে খাটিয়া বানিয়ে আমার মায়ের সাদা এক টুকরা কাপড় দিয়ে কাফন পরিয়ে রাত ১১টার দিকে হারিকেন জ্বালিয়ে দাফন করলাম।'

পরবর্তীতে আশির দশকের শেষের দিকে স্থানীয় যুবকদের একটি সংগঠন কবরটি ইট দিয়ে বাধাই করে চিহ্নিত করে দিয়েছিল। আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে স্থাপন করে একটি স্মৃতিফলকও।

আগস্ট, ২০১৭: এক রহস্যের অর্ধ-উন্মোচন

২০১৭ সালের আগস্ট মাসের কোনো এক সকাল। খোনারপুকুর পাড়ে সফেদ শ্মশ্রুমণ্ডিত এক বৃদ্ধ অজানা সেই মুক্তিযোদ্ধার কবর জিয়ারত শেষে দাঁড়ালেন। পেছন থেকে হাত চেপে ধরলেন সমবয়সী আর একজন মানুষ। দুজনের মধ্যে চললো খানিক আলাপচারিতা। মুক্তিযুদ্ধের সময় দুজনেই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তবে দুজন যুদ্ধ করেছেন ভিন্ন দুই স্থানে।

আলাপচারিতার এক পর্যায়ে স্থানীয় গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস উদ্দিন এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বিষয়ে খোঁজ নিতে বললেন। শুনে জিয়ারত করতে আসা মুক্তিযোদ্ধা ওবায়েদ উল্লাহ্‌ জানান এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা তার অধীনেই যুদ্ধ করেছেন।

১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর সকালে পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েছিলেন এই মুক্তিযোদ্ধা। তবে সেই তরুণ মুক্তিযোদ্ধার নামটি মনে করতে পারছেন না তিনি। তবে সেই তরুণ মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বের কারণেই তাকে ভুলতে পারেননি।

মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের কোথাও এটা মনে ছিল। যুদ্ধ শেষের মাসখানেকের মধ্যে সেই মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতেও গেছেন তিনি। তবে গ্রামের নাম বা ঠিকানা আর কিছুই মনে নেই ওবায়েদ উল্লাহর, বলছিলেন মুক্তিযোদ্ধা গিয়াসউদ্দিন।

সেকান্দরপুর গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা গিয়াসউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধ করেছেন ২ নম্বর সেক্টরে। তিনি ছিলেন বিএলএফ মুজিব বাহিনীর জোন বি থ্রির কমান্ডার।

সেই মুক্তিযোদ্ধার শেষ পর্যন্ত কী হলো কীভাবে জানলেন এই প্রশ্নের জবাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা ওবায়েদ উল্লাহ্‌ তাকে বলেন, 'ওকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর সেদিন দুপুরে আমি দুজন মানুষকে ঠিক করলাম। যারা ওর কী হয় শেষপর্যন্ত তা জানাবে আমাদের।'

'দাগনভূঁইয়া বাজারের লোকজনের কাছেও শুনেছিলাম। আর তাকে এখানে যে ফেলে গেছে তা শুনেছি দাফনের পরদিন দুপুরের দিকে।'

কে এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা? কী করে মুক্তিযুদ্ধে যাত্রা শুরু হয়েছিল তার?

বীর মুক্তিযোদ্ধা গিয়াসউদ্দিন উপজেলা কমান্ডার হওয়ার কারণে বেশ কয়েকবার তরুণ ওই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় জানার নানা চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু পারেননি।

গিয়াসউদ্দিন ভূঁইয়া ডেইলি স্টারের এই প্রতিবেদকে ওবায়েদ উল্লাহ্‌র সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দেন। ওবায়েদ উল্লাহ্‌ কমান্ডারের সঙ্গে দেখা হয় চলতি বছরের মার্চে। তিনি থাকেন নোয়াখালীর সেনবাগে। সেনবাগের সেবারহাট বাজারে কথা হয় তার সঙ্গে।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি তখন ২ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ত্রিপুরার মেলাঘরে। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের কথা। আমরা ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হয়ে ফেনীর সীমান্তবর্তী নানা জায়গায় অপারেশন শেষে, বিলোনিয়া মুক্ত করে তখন মেলাঘরে পৌঁছেছি। মেলাঘরে এই তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গেই আমার দেখা হয়েছিল।'

'নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আমাকে যখন রাজনগর সাব সেক্টরের অধীনে এফএফ গ্রুপের বি জোনে প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে নোয়াখালীর সেনবাগে দায়িত্ব দেওয়া হয় তখন এই ছেলেটি আমার দলে যুক্ত হয়েছিল। আমরা সেনবাগের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকটি অপারেশন করেছিলাম।'

'নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে নোয়াখালীর সেনবাগ বাজার পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে। নোয়াখালী রোডের পাশে পাকিস্তানিরা রাজাকারদের সহযোগিতায় খেজুর ও মান্দার গাছের ডাল, বাঁশের সূচালো কঞ্চি পুঁতে রেখেছিল যেন মুক্তিযোদ্ধাদের সড়কের কাছে ঘেঁষতে বেগ পেতে হয়।'

'আমাদের সেকশনের ক্যাম্প ছিল সেনবাগ বাজার থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে উত্তর মোহাম্মদপুর গ্রামের সেকান্দর ব্যাপারী বাড়ির কাচারিতে। ২৪ নভেম্বর আমাদের কমান্ডার রুহুল আমিন ভূঁইয়া ঠিক করলেন এবারের অপারেশন হবে সেনবাগ বাজারে।'

'কারণ প্রতিনিয়ত ফেনী নোয়াখালী সড়ক থেকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছিল নিরীহ মানুষদের। আর সেনবাগ বাজার দখলে আনতে না পারলে এই অঞ্চল মুক্ত করা অসম্ভব। সেদিনই জরুরিভিত্তিতে সেকশন কমান্ডার শেখ আহমদকে জানানো হয়।'

২৫ নভেম্বর বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় পজিশন নিয়ে রাস্তা দিয়ে চলমান পাকিস্তানিদের জিপে মুর্হুর্মুহু গোলাগুলির মধ্য দিয়ে আক্রমণ শুরু করল মুক্তিযোদ্ধারা। পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকটি দল সেনবাগ বাজারে অবস্থান নেয়। তখন মুক্তিযোদ্ধারা নীরব হয়ে যায়।

ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই চতুর্মুখী আক্রমণে নামে প্রায় এক ব্যাটালিয়ন মুক্তিযোদ্ধা। তখন পাকিস্তানি সেনারা বেগমগঞ্জের দিকে পালিয়ে যায়। এটিই ছিল সেই তরুণ মুক্তিযোদ্ধার শেষ অপারেশন।

২৭ নভেম্বর ১৯৭১, আত্মত্যাগের এক অবিশ্বাস্য ইতিহাস

দিনটি ছিল শনিবার। সকাল ৯টা। প্রতিদিনের মতো পায়ে হেঁটে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান জানার জন্য নিয়মিত টহলে বেরিয়েছিলেন। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল হানাদার সেনারা।

সেনবাগের কল্যান্দি বাজারের কাছে ৭নং মোহাম্মদপুর ইউনিয়ন বোর্ড অফিসের কাছাকাছি এসে হঠাঞ করে ইউনিয়নের বোর্ড অফিস লক্ষ্য করে এক নাগাড়ে গুলি চালায় পাকিস্তানি বাহিনী।

মুক্তিযোদ্ধা ওবায়েদউল্লাহ্‌ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাস্তার চারপাশ তখন জনশূন্য। ভয়ে মানুষ পালাতে শুরু করে। পাকিস্তানি সেনারা ট্রাক থেকে নেম গ্রামে ঢুকে ওদু (ওহিদুল হক) চেয়ারম্যানের বাড়িতে ঢুকে গুলি করে চেয়ারম্যানের ভাইয়ের বৌ এবং বড় ছেলেকে হত্যা করে। এরপর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এই পাশবিক নির্যাতন সইতে না পেরে তখনই আমাদের ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা পজিশন নিয়ে গুলি করতে শুরু করে।'

'কিন্তু পাকিস্তানিরা সংখ্যায় বেশি থাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজন দ্রুত সেকান্দর ব্যাপারী বাড়ির মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে খবর দেন। তখন ৫ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি তুমুল যুদ্ধ করছিল। পাকিস্তানিরা আবারো এগিয়ে এলে মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি খানিকটা পিছু হটে। অকুতোভয় সেই তরুণ মুক্তিযোদ্ধা একটানা গুলি করতে করতে এগিয়ে যান।'

'নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যর প্রতিশোধ নিতেই গুলি করতে করতে সামনে এগিয়ে যায়। এক পর্যায়ে তাকে ধরে ফেলে পাকিস্তানি বাহিনী। এসময় ক্যাম্প থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধারা এসেই ফায়ার করতে শুরু করলে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক যুদ্ধ হয়।'

'সেসময় ৭ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। একপর্যায়ে আমাদের সঙ্গে টিকতে না পেরে ওরা চলে যায়। সঙ্গে নিয়ে যায় তাদের সেনাদের লাশ আর সেই অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাকে।'

পরে জেনেছি তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় দাগনভূঁইয়ার আতাতুর্ক হাই স্কুলে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে। সেখানে পৈশাচিক ও নির্মম নির্যাতন চালানো হয় তার ওপর। সেদিন নিজেদের বাড়ির সামনে থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছিল ইমাম হোসেন নামের আরেক তরুণকেও। যদিও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা না পেয়ে তাকে ছেড়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী।

এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় দাগনভূঁইয়ার সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী ইমাম হোসেন বলেন, 'আমি আর সেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম পাশাপাশি। প্রথমে তার পুরো শরীরে গজারির লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। এরপর পায়ের গিরায় পিটিয়ে ভেঙ্গে ফেলা হয় হাড়। প্লাস দিয়ে টেনে তুলে ফেলা হয় নখ। তারপর খেজুর গাছের কাঁটা দিয়ে সারা শরীরে খুঁচিয়ে নির্যাতন চালানো হয়।'

'যন্ত্রণায় বেশ কয়েক দফা জ্ঞান হারিয়েছিলেন সেই মুক্তিযোদ্ধা। টানা দেড় দিন নির্যাতনের পর সারা শরীরে কালি মাখিয়ে খেজুর কাঁটায় বিদ্ধ করে পুরো দাগনভূঁইয়া বাজারে ঘোরানো হয় তাকে। এরপর ক্যাম্পে এনে তার উপর পুনরায় নির্যাতন চালিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী।'

২৯ নভেম্বর দিবাগত রাতে হত্যার উদ্দেশ্যে তাকে রাজাকারদের হাতে তুলে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। রাজাকারেরা তার উপর আরেক দফা নির্যাতনের পর মুখমণ্ডলে এসিড ঢেলে দিয়েছিল।

সেদিন শেষ রাতে ফেনী নোয়াখালী আঞ্চলিক সড়কের পাশে সেকান্দরপুর খোনারপুকুরের খালপাড়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে ফেলে যায় পাকিস্তানি বাহিনী।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধার ঠিকানার খোঁজে

আমরা জেনেছিলাম তরুণ এই মুক্তিযোদ্ধাকে পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু তার পরিবার কি জানে তাদের প্রিয় স্বজনের শেষ ঠিকানা কোথায় হয়েছে? জানে তার আত্মত্যাগের অবিস্মরণীয় ইতিহাস? শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্ধান পেতে আমরা চালাতে লাগলাম অনুসন্ধান।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ওবায়েদউল্লাহ্‌ আর আমি নোয়াখালীর বিভিন্ন রণাঙ্গনের বেশ কয়েক কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে চেষ্টা চালাতে লাগলাম তার স্বজনেরা কোথায় আছেন। কেবল একটিই সূত্র তা হলো মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ওবায়েদউল্লাহ্‌র বলেছেন সেই মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে।

কিন্তু বেগমগঞ্জের কোথায় তা জানা নেই। তিনি বললেন, 'আমি নিজের কর্মব্যস্ততা ও নানা অসুবিধায় ভুলে গিয়েছি প্রায়। তবে মুক্তিযুদ্ধের পর আমি তাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাড়িটা কোথায় তা আর মনে নেই।'

বেগমগঞ্জ থানাজুড়ে বেশ কয়েকদিন অনুসন্ধান চালালাম। পেলাম বেশ কয়েকজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে। কিন্তু কেউই সেই মুক্তিযোদ্ধার পরিবার নয়। তারা যুদ্ধ করেছেন দেশের নানা প্রান্তে তাদের দাফন হয়েছে।

বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আমরা দেখা করলাম। কিন্তু খোঁজ মিলল না। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ওবায়েদ উল্লাহ্‌ খোঁজ নিলেন তার জীবিত সহযোদ্ধাদের মাঝেও। কিন্তু বেশিরভাগই গত ৫০ বছরে মারা যাওয়ায় আমরা পেলাম না খোঁজ।

একপর্যায়ে আমাদের হাল ছেড়ে দেয়ার জোগাড়। একদিকে নামই জানা নেই আমাদের। একপর্যায়ে একদিন হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধা ওবায়েদ উল্লাহ্‌ বললেন, '২০০৫ সালে বেগমগঞ্জ থানা ভেঙে সোনাইমুড়ি উপজেলা হয়েছিলো। আমরা সোনাইমুড়িতেও দেখতে পারি।'

এরপরই আমরা নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলাতেও খোঁজ নিতে শুরু করলাম। বহু অনুসন্ধানের পর সন্ধান পাওয়া গেল একটা সূত্রের। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ওবায়েদ উল্লাহ্ পড়তে লাগলেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। কিন্তু বেশিরভাগই শহীদ হয়েছেন নানা জায়গায়। নেই এই যুদ্ধে শহীদ হওয়ার নাম।

তালিকার এক পর্যায়ে দেখা মেলে হাফেজ আহমেদ নামের এক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার। কিন্তু তার সমাধি অজানা। এমন আর নাম নেই সেখানে। ওবায়েদ উল্লাহ ধারণা করলেন ইনিই হবেন সেই তরুণ মুক্তিযোদ্ধা। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার কাশীপুর গ্রামে। আমাদের গন্তব্য তখন নোয়াখালীর সোনাইমুড়ির কাশীপুরে।

কাশীপুর বাজারে গিয়েও আরেক ঝক্কি। নাম বলার পর কেউই চেনেন না এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে। মুক্তিযোদ্ধা ওবায়েদ উল্লাহ যাকে পান তাকেই জিজ্ঞেস করেন। পথচারী থেকে দোকানদার, ক্রেতা বিক্রেতা থেকে রিকশাওয়ালা কেউই বাদ যায় না।

সবচেয়ে করুণ হলো শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও প্রবীণ লোকেরাও অনেকে চেনেন না তাকে। বেশ কয়েক জায়গায় বলার পর অবশেষে এক দোকানে জিজ্ঞেস করতে দোকানি শুনে বললেন, 'বসেন একটু।'

এরপর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ওবায়েদ উল্লাহ্‌র কাছে বিস্তারিত শুনে তিনি বললেন তার দোকানে কাজ করতেন একটি ছেলে। কিন্তু ও এখন কাজ করে চট্টগ্রামে। ওই হলো শহীদ হাফেজ আহমদদের বাড়ির। ঠিকানা পাওয়া গেল। আমরা দুজনে গেলাম সেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে।

তাদের বাড়িতে গিয়ে জানা গেল তার দুই ভাইয়ের এক ভাই মারা গেছেন আরেক ভাই থাকেন দুবাইতে। আরও জানা গেল এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বিবাহিত। তার স্ত্রী এখনো জীবিত। কয়েক বাড়ি পরেই থাকেন তিনি। আমরা ছুটলাম তার কাছে।

ফিরে যাই ৫০ বছর আগে

১৯৭০ সাল। কাশীপুরের গ্রামেরই মিয়াজি বাড়ির খুরশিদা বেগমের সঙ্গে বিয়ে হয় দৌলত ব্যাপারী বাড়ির যুবক হাফেজ আহমদের। বিয়ের পর বাড়িতে স্ত্রী, বাবা মা, তিন ভাই তারা। বাবার সঙ্গে খেতে না গেলে বাড়িতে খাওয়া জোটে না। অভাবের সংসার, চারদিকে কেবল হাহাকার। কখনো নিজেদের জমি চাষের সঙ্গে বর্গা দেয়া জমি চাষ করতেন তারা। এক প্রকার চলছিল সংসার।

হাফেজ আহমদের বিয়ের মাত্র ছয় মাসের মাথায় শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে একদিন বাবা মা ও স্ত্রীর অগোচরে বাড়ি থেকে পালালেন হাফেজ। কারণ স্ত্রী এই অবস্থায় তাকে যুদ্ধে যেতে অনুমতি দেবেন না।

প্রথমে তিনি গেলেন স্থানীয় কাশীপুর বাজারে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। কিন্তু ট্রেনিংপ্রাপ্ত না হওয়ায় অনেকের সঙ্গে পায়ে হেঁটে ফেনী পেরিয়ে ত্রিপুরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কেবল একবার বাড়িতে এসেছিলেন হাফেজ আহমদ।

নভেম্বর মাসের শেষার্ধে শহীদ হওয়ার কিছুদিন আগে এক রাতের কথা। খুরশিদা বেগম তখন ছিলেন তার বাবার বাড়িতে। বাড়িতে এসে বাবা মাকে দেখে ও পরবর্তীতে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিলেন হাফেজ।

রাত কাটিয়ে সকাল সকালই বাড়ি ছেড়ে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন, কে জানতো এই যাওয়াই তার শেষ যাওয়া। আজো সেই দৃশ্য চোখে ভাসে খুরশিদা বেগমের।

হাফেজ আহমদ ধরা পড়ার খবর খুরশিদা বেগম পেয়েছিলেন অনেক পরে। মুক্তিযুদ্ধের কিছুদিন পর মুক্তিযোদ্ধা ওবায়েদউল্লাহ্ই পৌঁছে দিয়েছিলেন সেই খবর। অনিশ্চিত জেনেও তিনি অপেক্ষা করে গেছেন বহুদিন।

স্বামীর শহীদ হওয়ার খবরে শোকে পাগলপ্রায় খুরশিদা বেগম একপ্রকার আঁকড়ে রেখেছিলেন শ্বশুরবাড়ি আর স্বামীর সব স্মৃতি। বিবাহিত জীবনে তাদের কোনো সন্তানসন্ততি ছিল না। হাফেজ আহমদ শহীদ হওয়ার পরের বছর মারা গিয়েছিলেন হাফেজ আহমদের বাবা, আর আড়াই বছর পর মারা যান তার মাও।

কয়েক বছর স্বামীর ভিটেতে থাকার পর একসময় বাধ্য হয়েই শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে খুরশিদা বেগম ঠাঁই নেন বাবার বাড়িতে। কোনো কূলকিনারা না দেখে একসময় তার বাবা তার বিয়ে দেন। খুরশিদা বেগমের দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছিল একই গ্রামে।

খুরশিদা বেগমের সবসময়ই আশা ছিলো, স্বামীর কবরের সন্ধানটা হয়তো তিনি এদকিন পাবেন। কিন্তু স্বামীর কবরের সন্ধান পাননি কখনোই। মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে এসেও খুরশিদা বেগম তখনো পর্যন্ত জানতেন না তার স্বামীর ভাগ্যে আদৌ দাফন জুটেছে কিনা।

ভেজা চোখে তিনি বললেন, 'তার কবরটা যেন একবার দেখার সুযোগ হয় আমার! আর মানুষ যেন জানতে পারে তার আত্মত্যাগের কথা।'

ahmadistiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English
Reforms vs election

Reforms vs election: A distracting debate

Those who place the election above reforms undervalue the vital need for the latter.

4h ago