মুক্তিযুদ্ধ

২৭ নভেম্বর ১৯৭১: ‘পাকিস্তানের উচিত শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে আলোচনায় বসা’

১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর দিল্লিতে পাকিস্তান দূতাবাসের এক মুখপাত্র বলেন, 'ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এর সঙ্গে দেখা করেছেন ভারতে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত সাজ্জাদ হায়দার। এসময় দুই জনের মধ্যে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যকার বর্তমান উত্তেজনা নিরসনে আলোচনা হয়েছে।'

২৭ নভেম্বর দিল্লিতে ভারত সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, 'ঈদ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে পাঠানো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের শুভেচ্ছা বার্তাটির জবাব দিয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরা গান্ধী লিখেছিলেন, 'আমিও ভারতবাসীর পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট আপনাকে এবং পাকিস্তানের সব মানুষকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাই। বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভারতের উপর এখন সত্যিই দুর্বিষহ বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা মনে করি পাকিস্তানের উচিত শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে এই সমস্যা অবসানের জন্য আলোচনায় বসা।' 

২৭ নভেম্বর কলকাতার লবণহ্রদ শরণার্থী শিবিরে সাংবাদিকদের দেয়া নানা প্রশ্নের জবাবে মার্কিন ডেমোক্রেটিক পার্টির সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ এবং রিপাবলিকান সিনেটর উইলিয়াম সাক্সবি বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রে যেমন জনগণের ভোটে সরকার নির্বাচিত হয় সেরকম সরকার বাংলাদেশেও প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে তা শান্তিপূর্ণভাবে, যুদ্ধের মধ্য দিয়ে নয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তি দিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উচিৎ শান্তিপূর্ণ সমাধানে আসা। আন্তর্জাতিক শক্তি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানের জন্য ইতিমধ্যে পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তারও একটা সীমা আছে। বৈদেশিক সাহায্য বিলের কাজ শেষ করে আমরা শিগগির যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাবো।'

পাকিস্তানে এদিন

২৭ নভেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তান সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, 'ভারতে অব্যাহতভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে অস্ত্রের সরবরাহ করছে তার জন্য পাকিস্তান সরকার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছে। আমরা এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করছি। শিগগির বড় কয়েকটি চালান পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হবে। 

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন 

২৭ নভেম্বর ওয়াশিংটনে সাংবাদিকদের দেওয়া প্রশ্নের জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র চার্লস রে বলেন, 'মার্কিন সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা বলেছে। মার্কিন সরকার বরাবরের চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন এখন। কারণ পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে তা কারোই অজানা নেয়। পাকিস্তান সরকারের কাছে মার্কিন সরকার শেখ মুজিবের মুক্তির বিষয়টি তুলেছে। কারণ এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে তাকে মুক্তি দিলে হয়তো পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব। তবে সবই এখন বিবেচনাধীন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের টেলিফোনালাপ হয়েছে।' তবে সংবাদ সম্মেলনে দুই প্রেসিডেন্টের মধ্যে কী ফোনালাপ হয়েছে তা এড়িয়ে যান পররাষ্ট্র মুখপাত্র।

২৭ নভেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে দেয়া এক চিঠিতে জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহী বলেন, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে পাকিস্তান যে কোন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

২৭ নভেম্বর দিনাজপুরের হিলিতে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর ব্যাপক হামলা চালায়। এর আগে ২৫ নভেম্বর আক্রমণ শুরু করেছিল যৌথ বাহিনী। এদিন মিত্রবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর উপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি বাহিনীর পাশাপাশি এদিন ভারতীয় মিত্রবাহিনীও ট্যাংক ব্যবহার করে। রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাঠানো পাকিস্তানি বাহিনীর সব অস্ত্র সরবরাহ এবং রসদ বন্ধ করার জন্য যৌথ বাহিনী বেশ সফলও হয়। এদিন ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর হামলায় হানাদার বাহিনীর ৫টি ট্যাংক ধ্বংস হয় এবং ৮০ জনের মতো সৈন্য নিহত হয়। অন্যদিকে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ৪ সৈন্য শহীদ হন।

২৭ নভেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইসলামপুর ও চাটুইডুবিতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানের উপর ব্যাপক মর্টার হামলা চালায়। হানাদার বাহিনী এদিন এই যুদ্ধে ভারী মেশিনগান, ৮১ এমএম মর্টারের গোলা এবং ২৫ পাউন্ড ওজনের কামানের গোলা ব্যবহার করে। আগের কয়েকদিনের যুদ্ধের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ক্লান্ত থাকায় এদিন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এদিন মুক্তিবাহিনীর গোলার আঘাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ১৫টি বাঙ্কার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ১২৫ জন সৈন্য এবং ২৫০ জন রাজাকার নিহত হয়।

২৭ নভেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার মেজর গিয়াসউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা এদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পোড়াগ্রাম ক্যাম্পে আক্রমণ করে। এসময় মুক্তিবাহিনী ওঁ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। কয়েক ঘণ্টাব্যাপী চলা এই যুদ্ধে ৩০ জন হানাদার সেনা সিওহ ৫০ জন রাজাকার নিহত হয়। 

২৭ নভেম্বর ফেনীর ছাগলনাইয়াতে ৩০ জন সশস্ত্র রাজাকার মুক্তিবাহিনীর হাতে আত্মসমর্পন করে। একই দিন মুক্তিযোদ্ধারা মুন্সিরহাট থেকে বিলোনিয়া-ফেনী সড়ক পর্যন্ত এলাকা হানাদার মুক্ত করে নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠা করে। 

২৭ নভেম্বর যশোরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল মুন্সীগঞ্জে রাজাকার ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় ক্যাম্পে থাকা ৪ রাজাকারকে অস্ত্র সহ আটক করে মুক্তিবাহিনী। 

২৭ নভেম্বর রাজশাহীতে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল রাজশাহীর টেলিফোন এক্সচেঞ্জ আক্রমণ করে সারদা পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারের সঙ্গে সকল টেলিযোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। 

সূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র সপ্তম, একাদশ দ্বাদশ ত্রয়োদশ খণ্ড। 

দৈনিক ইত্তেফাক ২৮ নভেম্বর ১৯৭১ 

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ২৮ নভেম্বর ১৯৭১

দৈনিক যুগান্তর ২৮ নভেম্বর ১৯৭১ 

ahmadistiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English
Reforms vs election

Reforms vs election: A distracting debate

Those who place the election above reforms undervalue the vital need for the latter.

14h ago