গোলটেবিল বৈঠক

অযথা হর্ন বন্ধে আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতার বিকল্প নেই

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকার বাসিন্দাদের শ্রবণশক্তি কমে যাওয়ার বড় কারণ হর্নের আওয়াজ। যানবাহন চালকদের অযথা হর্ন বাজানোর কারণে ঢাকার শব্দদূষণ পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার বন্ধ হচ্ছে না। হর্ন বাজানো বন্ধে আইন ও বিধিমালা থাকলেও সেগুলোর প্রয়োগ সীমিত। হর্নের অযথা ব্যবহার বন্ধে আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতা তৈরির বিকল্প নেই।

'অকারণে হর্ন: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ক্ষতির কারণ' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। 

আজ মঙ্গলবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে গোলটেবিল বৈঠকটির আয়োজন করে প্রথম আলো ও উবার বাংলাদেশ।

বৈঠকে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক–দক্ষিণ) সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, 'শুধু আইন প্রয়োগ করে হর্ন বাজানো বন্ধে সাফল্য আসবে না। অযথা হর্ন বাজানো বন্ধে সঠিক পরিকল্পনা করে বাস্তবায়নে নামতে হবে। নাগরিকদের মানসিকতাতেও বদল আনতে হবে।'

তিনি বলেন, '২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের ৮৮ ধারা অনুযায়ী উচ্চমাত্রায় হর্ন বাজালে অনধিক তিন মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারবে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এই কর্তৃপক্ষ পুলিশ না, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ। ফলে হর্ন বন্ধে পুলিশের কার্যত হাত–পা বাঁধা।'

শব্দ দূষণ বন্ধে তেমন অগ্রগতি নেই বলে স্বীকার করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক। তিনি বলেন, 'শব্দ দূষণ বিধিমালার প্রয়োগে ব্যর্থতা রয়েছে। নীরব এলাকা ঘোষণা করলেও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। মোটরসাইকেলের ব্যবহার বেড়েছে, যা হর্নের বড় উৎস। হর্নের ব্যবহার বন্ধে সচেতনতার পাশাপাশি দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে।'    

অযথা হর্ন দেওয়ার অভ্যাস বদলাতে হলে সচেতনতা বাড়াতে হবে বলে মনে করেন উবার বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারতের প্রধান আরমানুর রহমান। তিনি বলেন, 'উবারে এক ছাতার নীচে বহু চালক রয়েছেন। অযথা হর্ন না দেওয়ার বিষয়টি উবার তার চালকদের প্রশিক্ষণে যুক্ত করেছে। হর্ন বন্ধে পুলিশ, বিআরটিএ, পরিবেশ অধিদপ্তরের মতো দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে উবার কাজ করতে আগ্রহী।'  
       
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'অযথা হর্নের কারণে কত টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়, সেটার সামগ্রিক কোনো গবেষণা নেই। তবে, শব্দ দূষণের প্রভাব সামগ্রিকভাবে ব্যপক। শব্দ দূষণের কারণে স্বাস্থ্য ব্যয়ের পাশাপাশি কর্মক্ষমতা কমে যাওয়ায় দেশের জিডিপিতে প্রভাব পড়ছে। ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ না হলে শব্দ দূষণ কমবে না। শব্দ দূষণ বন্ধে বিদ্যমান আইনের কতটা প্রয়োগ হচ্ছে, সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।'

ঢাকায় শব্দ দূষণের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, 'হর্ন না বাজিয়েও গাড়ি চালানো সম্ভব, বাংলাদেশের চালকেরা এটি বিশ্বাস করেন না। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগের সঙ্গে বাস্তবতার চরম বৈসাদৃশ্য রয়েছে। সংশ্লিষ্ট আইন, জনস্বাস্থ্যের ওপর হর্নের প্রভাবের কথা প্রচার করতে হবে।'   

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, 'শব্দ দূষণের কারণে একদিকে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে উৎপাদনক্ষমতা কমেও ক্ষতি হচ্ছে। হর্নের ব্যবহারের সঙ্গে সড়ক ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, নগর পরিকল্পনার মতো বিষয় সংশ্লিষ্ট। সামগ্রিকভাবে হর্ন বন্ধে পদক্ষেপ না নিলে, এটি সম্ভব হবে না। নীরব এলাকা ঘোষণার পাশাপাশি তা বাস্তবায়নে যা যা করা দরকার, সেগুলোর জন্য উদ্যোগ নিতে হবে।'  

মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণ ঢাকার বাসিন্দাদের মানসিক অস্থিরতা বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে জানান মনোবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল ইউ এ চৌধুরী। তিনি বলেন, 'যানবাহনের অতিরিক্ত হর্ন শিশুদের শেখার আগ্রহ কমিয়ে দেয়। গাবতলী থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত সড়কে বেশ কিছু হাসপাতাল আছে, অথচ এই সড়কটিতে উচ্চমাত্রায় হর্নের আওয়াজ থাকে।' 
  
সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফেয়ারিক পলুশন স্টাডিজের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, 'ঢাকায় এলাকাভেদে আগের বছরের চেয়ে প্রতি বছর ৭ থেকে ১০ শতাংশ করে শব্দদূষণ বাড়ছে। কিছু এলাকাকে 'নীরব এলাকা' ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু এই এলাকার আশপাশে শব্দদূষণ বেশি হচ্ছে। কোনো এলাকাকে নীরব এলাকা ঘোষণা করার ক্ষেত্রে যেসব কার্যক্রম দরকার সেগুলো না করে হঠাৎ নীরব এলাকা ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে।'

নাগরিকদের চোখের মতো নিয়মিত কানের পরীক্ষা করা জরুরি প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) মুহম্মদ শহীদ উজ জামান। তিনি বলেন, 'অন্তত একটি এলাকাকে হর্নমুক্ত করা গেলে, তা মডেল হিসেবে পরর্বতী কার্যক্রমে ব্যবহার করা যাবে। এ জন্য সরকারের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের এগিয়ে আসতে হবে। জনগণকে হর্ন ব্যবহার বন্ধে সচেতন করতে রেড ক্রিসেন্ট, স্কাউট ও বন্ধুসভার মতো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনদের কাজে লাগাতে হবে।'
   
অকারণে হর্ন বাজানো প্রাপ্ত বয়স্কদের কানে কম শেনার বড় কারণ বলে জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার মাহফুজুল হক। তিনি বলেন, 'শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া রোধে বৈশ্বিকভাবে আলোচনা হচ্ছে। অকারণে হর্ন বাজানো বন্ধে নীতিমালা বাস্তবায়ন এবং সচেতনতা বাড়াতে হবে। নিয়মিত শ্রবণশক্তি পরীক্ষা করতে হবে।'

যানজটকে হর্নের বড় কারণে বলে মনে করেন পিওর আর্থ বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মাহফুজার রহমান। তিনি বলেন, 'অযথা হর্নের কারণে নাগরিকদের ধৈর্য্য কমে যাচ্ছে। পরবর্তী প্রজন্ম যেন শব্দদূষণ ছাড়া বেড়ে ওঠতে পারে, সে জন্য হর্নের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।' 
 
হর্ন বন্ধে ট্রাফিক পুলিশদের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন চলচিত্র নির্মাতা আবু সাইয়ীদ। তিনি বলেন, 'কোনো একটি এলাকাকে পরীক্ষামূলকভাবে হর্নমুক্ত ঘোষণা করা দরকার। এলাকাটি হর্নমুক্ত করতে যা যা করা দরকার, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।'

উবার চালক জিয়াউর রহমান বলেন, 'চালকেরা হর্ন বাজাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। উচ্চ শব্দ দূষণের কারণে মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়। বাড়িতে ফেরার পরেও মেজাজ খিটখিটে থাকে। পথচারীদের সড়ক পারাপার নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। প্রতিটি গলির মুখে বড় আয়না থাকলে মোড় ঘুরতে চালকদের হর্ন বাজাতে হবে না।' 
 
বৈঠকে সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।   

Comments

The Daily Star  | English

You have crushed fascism, now strengthen democracy and press freedom

We are proud to launch our photo exhibition today, titled “36 DAYS OF JULY -- SALUTING THE BRAVEHEARTS”, to pay our special tribute to the students and the people who have freed us from the shackles of fascism.

8h ago