মুক্তিযুদ্ধ

ব্যাটল অব গরিবপুর: যে যুদ্ধ হার মানায় সিনেমাকেও

গরিবপুরের দিকে ছুটে আসছে ভারতীয় পিটি-৭৬ ট্যাঙ্ক। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ যুদ্ধ বলা হয় খুলনার চৌগাছার বয়রার গরিবপুরের যুদ্ধকে। ব্যাটল অব গরিবপুরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে অংশ নিয়েছিল ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ৪৫ ক্যাভালরির স্কোয়াড্রন ও ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সেনারা। ভারতের বিভিন্ন সামরিক কলেজে পাঠ্য এই ব্যাটল অব গরিবপুর। এর বীরত্বগাঁথা নিয়ে বলিউডে 'পিপ্পা' নামের একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হচ্ছে।

কেন গরিবপুরের যুদ্ধ এত গুরুত্বপূর্ণ?

ব্যাটল অব গরিবপুর ছিল সত্যিকারের এক চ্যালেঞ্জের নাম। এটি মুক্তিবাহিনীর চেয়েও ভারতীয় বাহিনীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ এই হামলার মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধে প্রথমবারের মতো ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ৩ ডিসেম্বর।

এ যুদ্ধে অগ্নশ নেওয়া মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী। ছবি: সংগৃহীত

ব্যাটল অব গরিবপুর একইসঙ্গে স্থল ও বিমানযুদ্ধ ছিল। সীমান্ত এলাকায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থান গড়ে তোলার জন্য এই যুদ্ধ ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ।

গরিবপুরের অবস্থান

গরিবপুর ও বয়রা ছিল ৮ নম্বর সাব সেক্টরের অধীনে। বয়রা সাব সেক্টরে প্রথমে সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। পরে ১৮ আগস্ট মেজর আবুল মঞ্জুরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ৮ নম্বর সেক্টরের হেড কোয়ার্টার ছিল যশোরের বেনাপোলে। তবে এর একটি অংশ ছিল ভারতের কল্যাণী শহরে।      

এই অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল অপ্রতুল মুক্তিযোদ্ধা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ওয়্যারলেস সুবিধা না থাকা। বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন স্বল্প প্রশিক্ষিত। ওয়্যারলেস সুবিধা না থাকায় মুক্তিবাহিনী সংগঠিত হয়ে এই অঞ্চলে কোনো আক্রমণ করতে পারেনি। বেনাপোলে ২ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধার রিজার্ভ ফোর্স থাকলেও ওয়্যারলেস সুবিধা না থাকায় সাহায্য চাইতে পারত না মুক্তিবাহিনী।  ফলে বড় আক্রমণ বা সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করার মতো অবস্থা ছিলো না মুক্তিবাহিনীর।   তবে পাকিস্তানি বাহিনী একেবারে  নিশ্চিন্তে থাকতে পারেনি। কারণ একের পর এক গেরিলা হামলা ও চোরাগুপ্তা আক্রমণ চলছিল তাদের ওপর। বয়রা সীমান্ত অঞ্চল হওয়ায় মুক্তিবাহিনী সুবিধা পাচ্ছিল। আক্রমণ করেই তারা ভারতীয় সীমান্তে ঢুকে যেত। ফলে মুক্তিবাহিনীর এই হামলা এড়ানোর পথ খুঁজছিল পাকিস্তানি বাহিনী। নভেম্বর মাসে যখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ছিল, তখন পাকিস্তানি বাহিনী সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী  নভেম্বর মাসের শুরুতে ৫৭ ও ১০৭ নম্বর ব্রিগেডকে একত্রিত করে গোটা খুলনা ও যশোর সীমান্তে কড়া অবস্থানের দায়িত্ব দেয়। এর মধ্যে ৫৭ ব্রিগেডকে খুলনায় এবং  ১০৭ ব্রিগেডকে যশোরের দায়িত্ব দেওয়া হয়।  খুলনায় থাকা ৫৭ ব্রিগেডকে বেশ কয়েকটি রেজিমেন্টে ভাগ করে বয়রা ও চৌগাছা সীমান্তে বসানো হয়। পাঞ্জাব রেজিমেন্ট সাতক্ষীরা অংশে নিযুক্ত হয় ১৫ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট। ঝিকরগাছার দায়িত্ব দেওয়া হয় ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টকে। যশোর ক্যান্টনমেন্টে রিজার্ভ রাখা হয় ২১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে।

গরিবপুরের যুদ্ধে অংশ নেওয়া পাকিস্তানি স্যাবর জেট এফ ৮৬ ও ভারতীয় জিনাট যুদ্ধ বিমান। ছবি: সংগৃহীত

তবে বয়রা অঞ্চলটি বেশ দুর্গম হওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনী কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থাই গড়ে তোলেনি। তারা ভেবেছিল, আগের মতো হয়তো চোরাগুপ্তা হামলা চলতে পারে। কিন্তু বড় হামলার কোনো আশঙ্কা নেই।

তবে মুক্তিবাহিনী  প্রায়ই এই অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান জানার জন্য রেকি করত। রেকি করতে গিয়ে মুক্তিবাহিনী টের পেল, এই অঞ্চলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এই এলাকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা মুক্তিবাহিনীর চর ছিলেন। তাদের মাধ্যমেও মুক্তিবাহিনী খোঁজ পায়, এই অঞ্চলে বড় আক্রমণ সম্ভব। 

বয়রা সাব সেক্টরের কমান্ডার ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা তখন বেনাপোলে গিয়ে সেক্টর কমান্ডার মেজরআবুল মঞ্জুরকে সবকিছু খুলে বলেন। এরপর শুরু হয় পরিকল্পনা। ভারতীয় বাহিনীরও সাহায্য চাওয়া হয়।

আক্রমণের দিন ২১ নভেম্বর 

২১ নভেম্বর  দিবাগত রাতে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ৪৫ ক্যাভালরির স্কোয়াড্রন ও ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সেনারা প্রথমে কাবাডাক নদী পেরিয়ে গরিবপুরের সীমানায় ঢুকে পড়ে। মিত্র বাহিনীর  ৪৫ ক্যাভালরির স্কোয়াড্রনের সঙ্গে ছিল রাশিয়ান পিটি-৭৬ ট্যাংক। সেদিন ভীষণ কুয়াশা ছিল। কয়েক হাত সামনের পথও দেখা যাচ্ছিল না। এক পর্যায়ে ট্যাংকগুলো মুক্তিবাহিনীর আব্দুস সাত্তারের দেখানো পথে এগিয়ে যায়।

এর আগে ধুলিয়ানির কাবিলপুরে কপোতক্ষ নদ পাড়ি দেওয়ার জন্য একটি অস্থায়ী সেতু বানিয়েছিল মিত্রবাহিনী। একে একে মিত্রবাহিনীর ১৭টি ট্যাংক এগিয়ে যায় সামনের দিকে। 

পাকিস্তানি বাহিনী খবর পেল যেভাবে 

২১ নভেম্বর দিবাগত রাতের শেষ দিকে যশোরে পাকিস্তান বাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের কাছে টেলিফোন আসে। টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, 'বয়রার গরিবপুরে মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি শক্ত অবস্থান নিয়ে এগিয়ে আসছে। পাকিস্তানি বাহিনীর একটি কোম্পানিকে সেখানে পাঠানো হলে মুক্তিবাহিনী আর এগোতে পারবে না।'

ফোনটি রেখেই ব্রিগেড কমান্ডার হায়াত খান ২১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ২টি কোম্পানিকে তার নেতৃত্বে বয়রা সীমান্তে যাত্রা করার আদেশ দেন। হায়াত খান যখন বয়রা সীমান্তে আসেন, তখন সেখানে ভোরের ঘন কুয়াশা।   

সকাল ৬টার দিকে হায়াত খানের নির্দেশে পাকিস্তানি বাহিনীর ২ কোম্পানি সেনা প্রথম আক্রমণ শুরু করে। মুক্তিবাহিনী বুঝতে পারে, তাদের পরিকল্পনা পাকিস্তানি বাহিনী জেনে গেছে। তবে পাকিস্তান বাহিনী তখন বুঝতেই পারেনি তাদের জন্য কী বিপদ অপেক্ষা করছে। ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান ভেবেছিলেন, মাত্র ২ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা তেমন কিছু করতে পারবেন না।

ট্যাংকের সামনে থাকা মুক্তিবাহিনী ও অপর পাশে থাকা পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে গুলিবর্ষণ শুরু হয় ভোর ৬টায়। হায়াত খান দেখতে পান, একটি ট্যাংক এগিয়ে আসছে সামনের দিকে। মুক্তিবাহিনীর কাছে ট্যাংক দেখে পিলে চমকে উঠল তার। পরে বুঝতে পারলেন, ভারতীয় বাহিনী আসছে। রাশিয়া থেকে নেওয়া পিটি ৭৬ এই ট্যাংকগুলো ছিল অত্যাধুনিক। যেখানে মানুষের পা চালানো মুশকিল, সেখানে দাপিয়ে বেড়ায় ট্যাংকগুলো। 

অবস্থা বেগতিক দেখে জরুরিভিত্তিতে অন্যদের খবর পাঠান ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান। কিছুক্ষণের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর ১৪টি অত্যাধুনিক এম-২৪ লাইট  মার্কিন শ্যাফে ট্যাংক চলে আসে। সঙ্গে আসে পাকিস্তানি বাহিনীর আর্টিলারি ইউনিটও।

এ যুদ্ধে শহীদ ৪৫ ক্যাভালরির স্কোয়াড্রনের কমান্ডার মেজর দলজিৎ সিং। ছবি: সংগৃহীত

আক্রমণ শুরু 

ভারতীয় বাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর ক্রমাগত গোলাবর্ষণে কেঁপে উঠে গরিবপুরের রণাঙ্গন। পাকিস্তানিদের গোলার আঘাতে শহীদ হন ভারতীয় ৪৫ ক্যাভালরির স্কোয়াড্রনের কমান্ডার মেজর দলজিৎ সিং। ফলে পুরো যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব এসে পড়ে ক্যাপ্টেন বলরাম সিং মেহতার ওপর। 

হঠাৎ ক্যাপ্টেন বলরাম সিং মেহতা খেয়াল করলেন, তার পিটি ৭৬ ট্যাংকে গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনীর ৩টি এম-২৪ লাইট মার্কিন শ্যাফে ট্যাংক তখন তাদের ঘিরে ফেলেছে। কিন্তু তীব্র  কুয়াশার কারণে ভারতীয় বাহিনীর ট্যাংক ও পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ওপর নিখুঁতভাবে গোলাবর্ষণে ব্যর্থ হয়।

ভারতীয় ট্যাংকের ক্রমাগত গোলাবর্ষণে টিকতে না পেরে এক সময় ২১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে। ফলে কাজ সহজ হয়ে যায় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর। মুক্তিবাহিনীর পেতে রাখা মাইন ও ভারতীয় বাহিনীর একের পর এক গোলাবর্ষণে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাকিস্তানিদের অত্যাধুনিক এম ২৪ লাইট শ্যাফে ট্যাংক। নাকাল হয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। 

এক পর্যায়ে পিছু হটে পাকিস্তানি বাহিনী। এরপর ফের চৌগাছা থেকে সংগঠিত হয়ে ফিরে আসে। ফিরে আসার সময় তারা নতুন কৌশলে গরিবপুরের জগন্নাথপুর গ্রাম দিয়ে প্রবেশ করে। তারা সেখানে অবস্থানরত ভারতীয় ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের চার্লি কোম্পানির উপর আক্রমণ চালানো শুরু করলে ১৪ পাঞ্জাব ব্যাটেলিয়নের প্রচুর ক্ষতি হয়।

এ সময় পাকিস্তানী বাহিনী বয়রা গ্রামে গণহত্যা চালায়। কিন্তু মুক্তিবাহিনী গেরিলারা তাদের ওপর উপর চতুর্মুখী আক্রমণ শুরু করে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনীর আর্টিলারি ও ট্যাংক ধ্বংস হয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অন্য কোম্পানিগুলোর আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে তারা।

যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজি বলেন, 'এই যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবে পাকিস্তানী বাহিনী।' তিনি ঢাকা থেকে এই যুদ্ধের উপর নজর রাখছিলেন।  

যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু করে। কিন্তু ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বিত হামলায় তাতেও তারা সুবিধা করতে পারেনি। সকাল ১০টার দিকে সম্পূর্ণ গরিবপুর নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। এসময় গরিবপুরে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার নেতৃত্বে গুলি চালাতে চালাতে দত্তপুকুরে ঢোকে। তখন বুড়িন্দিয়া ও দত্তপুকুর ছেড়ে পিছু হটে পাকিস্তানি বাহিনী।

বহু চেষ্টার পরও মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর হামলার মুখে সামনে এগোতে না পেরে ২২ নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী পাশের এলাকার পাকিস্তানি বাহিনীকে জরুরিভিত্তিতে বিমান হামলা চালাতে বলে। দুপুর ৩টার দিকে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর ৩টি স্যাবর এফ ৮৬ যুদ্ধ বিমান হামলা চালায় মিত্র বাহিনীর অবস্থানের ওপর। কিন্তু ভারতীয় বাহিনী এ সময় আক্রমণ শুরু করে।

গরিবপুর যুদ্ধের ডগফাইটে অংশ নেওয়া ভারতীয় বিমান বাহিনীর ৫ অফিসার। ছবি: সংগৃহীত

২২ নভেম্বর    

এদিন সকাল ৯টার দিকে তেজগাঁওয়ে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ৪টি এফ ৮৬ স্যাবর যুদ্ধ বিমান ফের ভারতীয় বাহিনীর ওপর বোমা হামলা শুরু করে। 

তারা বারবার ভারতীয় সীমানা অতিক্রম করে বোমা নিক্ষেপ করায়, এক পর্যায়ে ভারতীয় বিমানবাহিনীও বিমান হামলার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন কলকাতার দমদম বিমানবন্দর থেকে ৪টি জিনাট যুদ্ধ বিমান পাকিস্তানি স্যাবর জেটগুলোকে ধাওয়া করে। সে সময় স্যাবর জেটগুলো পালিয়ে যায়। কিন্তু দুপুর ৩টা নাগাদ প্রায় ৪টি স্যাবর জেট ফের ভারতীয় বিমানবাহিনীর রাডারে ধরা পড়ে।  তখন ভারতীয় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট অ্যান্ড্রু ম্যাসির নেতৃত্বে এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট গণপতি, ফ্লাইং অফিসার ল্যাজারেস ও সোয়ারেজের  পরিচালনায় ৪টি জিনাট যুদ্ধ বিমান স্যাবর জেটের অবস্থান চিহ্নিত করে ফের ধাওয়া করে। বলে রাখা ভালো, স্যাবর জেট ছিল জিনাট যুদ্ধ বিমান থেকে উন্নত। এ ছাড়া, স্যাবর জেটে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী এইম ৯ সাইডউইন্ডার মিসাইলও সংযুক্ত করেছিল। 

এরপরও ভারতীয় বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট অ্যান্ড্রু ম্যাসি উপায় বের করেন। তিনি স্যাবর জেটকে ধোঁকা দিতে দুটি করে বিমান ভাগ করেন। প্রথমেই রাখেন অ্যান্ড্রু ম্যাসি ও সোয়ারেজের যুদ্ধ বিমান। এরপর রাখেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট গণপতি ও ফ্লাইং অফিসার ল্যাজারেসের যুদ্ধ বিমান। অর্থাৎ ২ সারিতে একজন করে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এবং একজন ফ্লাইং অফিসার রাখেন তিনি। কিন্তু একই কৌশল নেয় পাকিস্তানি বিমানবাহিনীও। তারাও ২ ভাগে বিভক্ত হয়।

প্রথমে অ্যান্ড্রু ম্যাসি ও সোয়ারেজ জিনাট যুদ্ধ বিমান নিয়ে স্যাবর জেটের দিকে এগিয়ে যান। এতে স্যাবর জেটবিমানগুলো পালাতে গিয়ে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট গণপতি ও ফ্লাইং অফিসার ল্যাজারেসের যুদ্ধ বিমানের সামনে পড়ে। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট গণপতি ফ্লাইং অফিসার ল্যাজারেসকে বার্তা দিয়ে হামলা করার নির্দেশ দেন। স্যাবর জেটে শেল এসে লাগতেই আগুন ধরে যায়। জেট ২টির ২ পাইলট বিমান থেকে প্যারাসুট নিয়ে লাফিয়ে পড়েন। কিন্তু সীমান্তের একদম কাছে হওয়ায় ২জনই ধরা পড়েন ভারতীয় বাহিনীর কাছে। জেট ২টিও বিধ্বস্ত হয় ভারতীয় ভূখণ্ডে।  

এদিকে আরেকটি স্যাবর জেট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট অ্যান্ড্রু ম্যাসির জিনাট যুদ্ধ বিমানের একদম পেছনে চলে আসে। তখন ফ্লাইং অফিসার ল্যাজারেস স্যাবর জেটের পিছনে চলে গেলে জেটটি ডাইভ দিয়ে পালিয়ে যায়। 

আরেকটি স্যাবর জেটের সঙ্গে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট অ্যান্ড্রু ম্যাসির মুখোমুখি লড়াই শুরু হয়। ওই জেটের পাইলট ছিলেন উইং কমান্ডার চৌধুরী। তিনি অ্যান্ড্রু ম্যাসির চেয়েও অভিজ্ঞ ছিলেন। অ্যান্ড্রু ম্যাসির আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখে উইং কমান্ডার চৌধুরী শেল নিক্ষেপ করেন। অ্যান্ড্রু ম্যাসিও শেল নিক্ষেপ করেন। তা জেটের বাম পাশে লাগলে বিমান নিয়ে পালান পাকিস্তানি উইং কমান্ডার।

অ্যান্ড্রু ম্যাসির জিনাট যুদ্ধবিমানটি জেটটিকে ধাওয়া শুরু করে। কিন্তু অ্যান্ড্রু ম্যাসি বুঝতে পারেন, কোনো কারণে শেল নিক্ষেপ করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া, তিনি ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানের আকাশসীমায় ঢুকে পড়েছেন। তখন তিনি ফের দমদম বিমানবন্দরে নিরাপদে ফিরে আসেন।

ফলাফল 

২৪ নভেম্বর পর্যন্ত থেমে থেমে চলেছিল এই যুদ্ধ। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ১৪টি এম-২৪ লাইট মার্কিন শ্যাফে ট্যাংক ও ২টি স্যাবর এফ৮৬ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়।  অন্যদিকে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ৫টিপিটি-৭৬ ট্যাংক বিধ্বস্ত হয়। যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর মোট ১৯ জন শহীদ হন এবং ৩৩ জন আহত হন। পাকিস্তানি বাহিনীর শতাধিক সেনা হতাহত হয়। 

তথ্যসূত্র:

এগারোটি সেক্টরের বিজয় কাহিনী/ মেজর রফিকুল ইসলাম

লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে/ মেজর রফিকুল ইসলাম 

The Burning Chaffees/ Brig. B S Mehta 

আহমাদ ইশতিয়াক 

ahmadisiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English
changes in Bangladesh media industry

Allegiance shifts, so do faces at the helm

Bangladesh’s media industry has seen some major shake-ups, with more than two dozen outlets shuffling leadership positions following the July mass uprising last year.

19h ago