মালিকদের চাপে ‘লাল’ থেকে ‘কমলা’য় জাহাজ ভাঙা শিল্প, লাগবে না ইআইএ
মারাত্মক পরিবেশ দূষণকারী জাহাজ ভাঙা শিল্পের মালিকদের চাপে অবশেষে নতি স্বীকার করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর (ডিওই)। চট্টগ্রামের জাহাজ ভাঙা শিল্প এখন আর সর্বোচ্চ দূষণকারী 'লাল' শ্রেণির নয়। বরং তুলনামূলক কম দূষণকারী 'কমলা' শ্রেণির শিল্প। শ্রেণি পরিবর্তনের ফলে এখন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড স্থাপনের আগে পরিবেশগত সমীক্ষা বা ইআইএ করার প্রয়োজন হবে না।
একটি জাহাজ তার শেষ জীবনে নিজেই একটি বর্জ্যে পরিণত হয়। জাহাজে অ্যাসবেসটস, ভারি ধাতু, খনিজ তেল, জাহাজের তলা ও ব্যালাস্ট ওয়াটার, পলিসাইক্লিক অ্যারোমাটি হাইড্রোকার্বন, পলিক্লোরিনেটেড বাইফিনাইল, স্লাজ অয়েল ও অর্গানোটিনসহ বেশ কিছু বিপজ্জনক পদার্থ থাকে। এ সব পদার্থের সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলে তা পরিবেশ এবং মানুষের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
গত ১০ অক্টোবর ডিওইর এক সভায় জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রেণি কমলা (খ) তে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ডিওইর মহাপরিচালক মো. আশরাফ উদ্দিনের সই করা এ সিদ্ধান্তের কপি দ্য ডেইলি স্টারের হাতে এসে পৌঁছেছে।
তবে এ সিদ্ধান্তের বিষয়টি এখনও প্রকাশ করা হয়নি।
লাল শ্রেণিভুক্ত শিল্পের ক্ষেত্রে পরিবেশগত নির্দেশনা মেনে চলার সর্বোচ্চ বাধ্যবাধকতা থাকে। শিল্প এলাকার মাটি, পানি, বাতাস ও মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর শিল্প স্থাপনের প্রভাব সম্পর্কিত বিস্তারিত বর্ণনা করে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট বা ইআইএ) করতে হয়।
ইআইএ করা হলে একটি শিল্পের দূষণের প্রভাব কমানোর বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি রূপরেখা পাওয়া যায়।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৭ অনুযায়ী 'কমলা' শ্রেণিভুক্ত শিল্পের জন্য কোনো ইআইএ প্রয়োজন হয় না।
কমলা (খ) শ্রেণিতে আছে বহুতল ভবন নির্মাণ, অ্যালুমিনিয়াম সামগ্রী, প্লাস্টিক, টাইলস ও পারফিউম উৎপাদন শিল্প।
কমলা (ক) শ্রেণির শিল্পগুলো হলো-ক্রীড়া সরঞ্জাম তৈরির কারখানা, কৃষি-সামগ্রী উৎপাদন, চিরুনি, রুটি ও বিস্কুট উৎপাদন।
ভারত ও পাকিস্তানে জাহাজ ভাঙা শিল্প 'লাল' শ্রেণিভুক্ত।
একটি শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের সম্ভাব্য দূষণ পরিস্থিতি জানার প্রয়োজন হলেও, শ্রেণি পরিবর্তন হওয়ায় এ শিল্প মালিকদের আর ইআইএ তৈরি করা লাগবে না।
বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৮০০ জাহাজ ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সেগুলো হয় ভেঙে ফেলতে হয়, কিংবা সেগুলোকে রিসাইক্লিং করতে হয়।
জাহাজের বর্জ্যের দূষণ থেকে বাঁচতে সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব ও অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী উপায় হিসেবে রিসাইক্লিং করাকেই ধরা হয়।
১৯৭০ সালের আগে জাহাজ ভাঙা শিল্প ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে। কিন্তু, ওই দেশগুলোতে সামাজিক ও পরিবেশ আইন কঠোর হয়ে যাওয়ার পরে, এ শিল্প উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে স্থানান্তরিত হয়। বিশেষ করে যে সব দেশে আইন ও আইনের প্রয়োগ তুলনামূলক দুর্বল।
বর্তমানে বাতিল হয়ে যাওয়া জাহাজের প্রায় ৭০ ভাগ চলে আসে দক্ষিণ এশিয়ায়। এগুলোর স্থান হয় ভারতের আলাংয়ে, পাকিস্তানের গাদানিতে এবং আমাদের দেশের চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে।
২০০৯ সালে আমাদের হাইকোর্ট এক রায়ে পরিচ্ছন্নতার সনদ না থাকলে কোনো জাহাজকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রবেশের অনুমতি না দিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। এ সনদের মাধ্যমে একটি জাহাজের বর্জ্য পরিষ্কার করা আছে বলে নিশ্চিত হওয়া যায়।
সীতাকুণ্ড উপকূলীয় এলাকায় দেশের সর্ববৃহৎ জাহাজ ভাঙা শিল্প গড়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাংক ২০১০ সালে এক গবেষণায় ওই এলাকার মাটিতে সীসা, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, পারদ, অ্যাসবেসটস ও নানান ভারি ধাতুর উপস্থিতি পেয়েছে।
ওই গবেষণায় বলা হয়, ২০১০ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে সীতাকুণ্ড উপকূলীয় এলাকার মাটি ও পানিতে ৭৯ হাজার টন অ্যাসবেসটস, ২ লাখ ৪০ হাজার টন পলিক্লোরিনেটেড বাইফিনাইল, ৭৮ হাজার টন জৈব তরল বর্জ্য, ৭৭৫ টন অজৈব বর্জ্য এবং ২ লাখ ১০ হাজার টন ওজোন ক্ষয়কারী পদার্থ জমা হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মারাত্মক পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী এ শিল্পের শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য মালিকরা দীর্ঘদিন ধরে চাপ দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু, তা সফল হচ্ছিল না।
এর আগের ডিওই মহাপরিচালক রফিকুল ইসলাম চৌধুরী জাহাজ ভাঙা শিল্পের দূষণের তীব্রতার কারণে মালিকদের এমন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি চলতি বছর এপ্রিলে করোনায় মারা যান।
পরিবেশ আইন অনুযায়ী, 'লাল' শ্রেণিভুক্ত শিল্পের ক্ষেত্রে পরিবেশগত ছাড়পত্র দেয় ডিওই সদর দপ্তর। 'কমলা' শ্রেণির শিল্প স্থাপনের অনুমতি ও ছাড়পত্র অধিদপ্তরের আঞ্চলিক অফিস থেকেই নেওয়া যায়।
ডিওই মহাপরিচালক মো. আশরাফ উদ্দিন কপ-২৬ এ যোগ দিতে গ্লাসগোতে থাকায়, এ বিষয়ে তার মন্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
যোগাযোগ করা হলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের (অঞ্চল) পরিচালক মফিদুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শ্রেণি পরিবর্তনে অধিদপ্তর এখন শিপইয়ার্ড মালিকদের দ্রুত সেবা দিতে পারবে। মালিকরা এখন ঝামেলা ছাড়াই সেবা পাবেন।'
'তবে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে,' যোগ করেন তিনি।
শ্রেণির এ পরিবর্তনে জাহাজ ভাঙা শিল্পের বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'কোনোভাবেই ডিওই এই শিল্পের শ্রেণি পরিবর্তন করতে পারে না। বিশ্বের যে সব দেশে জাহাজ ভাঙা শিল্প আছে, তারা কেউ এমন করেনি।'
তিনি আরও বলেন, 'ডিওই শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে পরিবেশ আইন যে নিশ্চিত করতে পারে না, এটা তারই প্রমাণ।'
রিজওয়ানা বলেন, 'সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের মালিকদের মধ্যে গোপন চুক্তি আছে। পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করেই জাহাজ ভাঙা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা দেয় সেই চুক্তি।'
জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিপব্রেকার অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা দীর্ঘদিন ধরে এর শ্রেণি পরিবর্তন চেয়েছিলাম। অবশেষে তা পেয়েছি।'
তিনি আরও বলেন, 'এখন আমরা ঝামেলা ছাড়াই ডিওইর সেবা পাব। আগে, অনুমোদন পেতে দীর্ঘ সময় লাগত। সেই সঙ্গে জমা দিতে হতো অসংখ্য কাগজপত্র।'
তার দাবি, তারা এখন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে হতাহতের ঘটনা ও দূষণ কমানোর বিষয়ে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন।
Comments