১৫ বছর আগেও এই খালে সাম্পান চলত
চট্টগ্রাম শহরের পাথরঘাটায় কলাবাগিচা এলাকা থেকে শুরু হয়েছে মনোহরখালী খাল। আর এটি গিয়ে মিশেছে কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে। মাত্র ১৫ বছর আগেও এই খাল দিয়ে সাম্পান (চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী কাঠের নৌকা) চলাচল করতে পারত। কিন্তু, এখন মৃতপ্রায় অবস্থা খালটির। খালটি দখলের কারণে ড্রেনে পরিণত হয়েছে।
এছাড়া, অবৈধ দখলের কারণে ঠিক মতো পানি প্রবাহিতও হচ্ছে না। দখলকারীদের বেশিরভাগ খালের পাশে বসবাসকারী। তাদের অনেকেই সেখানে বহুতল ভবন গড়ে তুলেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা টিটু দাস বলেন, '১৫ বছর আগেও প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ এই খালের মধ্য দিয়ে সাম্পান চলাচল করতে দেখেছি। কিন্তু, ব্যাপকভাবে দখলের কারণে সেটি ড্রেনে পরিণত হয়েছে।'
পাথরঘাটার ওয়ার্ড কাউন্সিলর পুলক খাস্তগীর বলেন, 'মনোহরখালী খাল এলাকায় প্রায় আড়াই হাজার ভোটার আছে। এই খালের আশপাশের বাসিন্দারা সেখানে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে। তাই উচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব নয়।'
সরেজমিনে দেখা যায়, খালটি এখন ড্রেনে পরিণত হয়েছে। খালের ২ পাড়ে অনেক আবাসিক স্থাপনাও গড়ে উঠেছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী হুমায়ুন কবির বলেন, 'খালের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এলাকার প্রভাবশালীরা এটি ভরাট করে প্রথমে বসতবাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করেছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) দেওয়াল নির্মাণ করে খালটিকে ড্রেনে পরিণত করে ফেলেছে।'
চট্টগ্রাম শহরের শুধু মনোহরখালী খালই নয়, অন্যান্য খালেরও একই অবস্থা বলে জানিয়েছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) উপপ্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আবু ঈসা আনছারী বলেন, '১৯৯৫ সালের ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যানের জরিপে চট্টগ্রাম শহরে ৫৭টি খালের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু, এখন আছে মাত্র ৩৬টি খাল।'
তিনি বলেন, 'চট্টগ্রাম নগরে নিয়মিত জলাবদ্ধতার একটি প্রধান কারণ হলো দখল। সিডিএ'র ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান অনুযায়ী খালের সীমানা থেকে কমপক্ষে ১২ ফুটের মধ্যে কোনো কাঠামো স্থাপন করা যাবে না, বর্তমানে আমরা সেটি ১৫ ফুট অনুসরণ করছি।'
বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম ও চট্টগ্রামের নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান বলেন, 'চট্টগ্রামে ১৯৬৮-৬৯ সালের মাস্টার প্ল্যানে ৭১টি খালের অস্তিত্ব ছিল।'
তবে চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পরিকল্পনা ও নির্মাণ) মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম দাবি করেন, 'চট্টগ্রাম শহরে এখনো ৫৭টি খালের অস্তিত্ব আছে।'
নগরবাসীর প্রত্যাশা ছিল চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনঃখনন, সংস্কার ও সম্প্রসারণের মেগা প্রকল্পের সময়সীমা অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে তাদের ভোগান্তির অবসান হবে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নির্বাহী প্রকৌশলী এবং প্রকল্প পরিচালক আহম্মদ মঈনুদ্দিন বলেন, 'চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানের জন্য ২০১৭ সালের আগস্টে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) কর্তৃক ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা অনুমোদন করা হয়েছিল। প্রকল্পের আওতায় আমরা চট্টগ্রাম শহরের ৩৬টি খাল পুনঃখনন করছি।'
চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান বলেন, 'উন্নয়নের নামে সিডিএ চট্টগ্রাম শহরের খালগুলো সংকোচিত করে সেখানে দেয়াল নির্মাণ করছে। তারা খালগুলো ধ্বংস করে ফেলছে। সিডিএ চট্টগ্রাম শহরের খালগুলোকে ড্রেনে পরিণত করছে, যা নগরবাসীর জন্য আরও দুর্ভোগ বয়ে আনবে। কারণ এটি ভবিষ্যতে জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান করবে না।'
তিনি আরও বলেন, 'সিডিএ খালগুলো পুনরুদ্ধার করছে না, বরং উন্নয়নের নামে দেওয়াল নির্মাণ করে খালের প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।'
তবে, এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সিডিএ'র নির্বাহী প্রকৌশলী আহম্মদ মঈনুদ্দিন বলেন, 'চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা খালগুলোর পাশে দেওয়াল নির্মাণ করছি।'
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিসি) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন বলেন, 'দখল হয়ে যাওয়া বিভিন্ন খাল এলাকায় আমরা একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করেছি। কিন্তু, অভিযানের কয়েকদিন পর আবার দখলকারীরা সেসব জায়গা দখল করে নেয়।'
প্রকৌশলী আনোয়ার বলেন, 'যথাযথ সীমানা নির্ধারণ ছাড়াই সিডিএ কীভাবে খালগুলোতে দেওয়াল নির্মাণ করছে- এ ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না।'
Comments