শিল-পাটার ঐকমত্য ও গরু খোঁজার কার্যবিধি

১৯৮৩ সন। ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে আইন প্রশিক্ষণের জন্য যোগদান করলাম তৎকালীন সিভিল অফিসার্স ট্রেনিং একাডেমিতে। ফৌজদারি কার্যবিধি পড়াতে আসলেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জেড এ শামসুল হক। ভূমিকা বক্তব্যেই বললেন, ‘আলপিন থেকে গোয়ালের গরু, যাই হারিয়ে যাক না কেনো, এই সিআরপিসি খুললে সব খুঁজে পাবে।’ এরপর ৩৮ বছর কেটে গেছে। এর মাঝে নতুন নতুন কত আইনই না এসেছে দেশে। কিন্তু গুরুর কথার সেই গরু এখনো খুঁজে পেলাম না।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোটার প্রায় ১২ কোটি

১৯৮৩ সাল। ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে আইন প্রশিক্ষণের জন্য যোগদান করলাম তৎকালীন সিভিল অফিসার্স ট্রেনিং একাডেমিতে। ফৌজদারি কার্যবিধি পড়াতে আসলেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জেড এ শামসুল হক। ভূমিকা বক্তব্যেই বললেন, 'আলপিন থেকে গোয়ালের গরু, যাই হারিয়ে যাক না কেনো, এই সিআরপিসি খুললে সব খুঁজে পাবে।' এরপর ৩৮ বছর কেটে গেছে। এর মাঝে নতুন নতুন কত আইনই না এসেছে দেশে। কিন্তু গুরুর কথার সেই গরু এখনো খুঁজে পেলাম না।

কদিন আগে আসন্ন নির্বাচন কমিশন গঠনকল্পে দেশের ৫৩ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিবৃতি পড়ে শামসুল হক স্যারের কথাটা আবার মনে পড়ল। আর মাত্র ৫ মাস পরই শেষ  হয়ে যাবে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ। এই প্রেক্ষিতেই  দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে এই বিবৃতি দিয়েছেন। এতে তারা 'সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে' যথাযথ আইন প্রণয়নপূর্বক 'যোগ্যতার মানদণ্ডের ভিত্তিতে সৎ, নির্দলীয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে' কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছেন। এদিকে দেশের অন্যতম প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বলেছে নতুন আইন নয়, বরং ঐকমত্যের ভিত্তিতে কমিশন গঠন করতে হবে। আসন্ন বিদায়ী নির্বাচন কমিশনের প্রধানও ঐকমত্যের কথাই সমর্থন করছেন।

এই বাস্তবতায় পরিস্থিতি যে ঐকমত্যের দিকেই এগুবে তা অনুমান করা যেতেই পারে। যারা নতুন আইনের কথা বলছেন, আর যারা ঐকমত্যের কথা বলছেন, তাদের সকলেরই জ্ঞান গরিমার কাছে আমি যে এক নস্যিতুল্য, তা স্বীকার করতে কোন দ্বিধা নেই। তারপরেও বাংলাদেশের মাঠ প্রশাসনে ২ দশকের কাজ এবং জাতিসংঘের অধীনে অর্ধ ডজনেরও বেশি নির্বাচনে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত থাকার অভিজ্ঞতার আলোকে কয়েকটি কথা না বলে পারছি না।

আমাদের দেশে নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত যেসব আইন ও বিধি রয়েছে তার সবগুলোতেই সুস্পষ্টভাবে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে নির্বাচন পরিচালনার বিধিবিধান বিধৃত আছে। এসবের কোনোটাতেই বলা নেই যে, একজনের ভোট আরেকজন দিতে পারবে কিংবা নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তারা নিজেরা ব্যালটে সিল মারতে পারবে। তবুও ভোটের সময় চুরি হয়, হয় জাল ভোটের উৎসব। আর নির্বাচনী কর্মকর্তারা সব দেখেও না দেখার ভান করেন। তাহলে প্রশ্নটি আইনের নয় - ব্যবস্থার;  যোগ্যতার নয়- সত্যের প্রতি দৃঢ়তার। আর আইন, সততা- সবই ব্যবস্থানির্ভর, ব্যবস্থানিরপেক্ষ নয়। তাই ব্যবস্থা না পাল্টিয়ে শুধু আইন প্রণয়ন করলেই যে সব ঠিক হয়ে যাবে, তা ভাবার কোন কারণ নেই।

প্রসঙ্গত স্মর্তব্য, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের যাত্রা শুরু ১৯৭২ সনের ৭ জুলাই। যার প্রধান ছিলেন ডাকসাইটে বিচারপতি এম ইদ্রিস। সেই থেকে দেশ বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে নিয়ে মোট ১২টি কমিশনকে দেখেছে। এইসব কমিশনের অধীনে যে সব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার মাঝে ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ এর নির্বাচন ২টি ছাড়া অন্য সব কটি নির্বাচনই ব্যাপক কারচুপি এবং অনিয়মের অভিযোগে বিদ্ধ হয়েছে। এর শুরুটা অবশ্য স্বাধীনতার পর  ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচন থেকেই। ব্যাপক অনিয়ম আর ইন্টিমিডেশনে স্বাধীনতা-উত্তর এই প্রথম নির্বাচন কলঙ্কজনকভাবে কালিমালিপ্ত হয়। এমনও শোনা যায় যে, কুমিল্লার দাউদকান্দি আসনে জাসদের রশিদ ইঞ্জিনিয়ারকে বিজয়ী ঘোষণার পরেও হেলিকপ্টারে করে ব্যালট বাক্স ঢাকায় নিয়ে এসে ভোট পুনর্গণনা করে খন্দকার মোশতাককে চূড়ান্ত বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। প্রসঙ্গটি এ জন্যই উল্লেখ করছি যে,  যেসব দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে সেসব দেশ ছাড়া অন্য দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতার বাইরে গিয়ে কাজ করার কোনো ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই।  ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালে অপেক্ষাকৃত সুন্দর নির্বাচনের যে কৃতিত্ব আমরা নির্বাচন কমিশনকে দিচ্ছি, তা আসলে ওই সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতারই ফসল। এই ২টি নির্বাচনে কমিশন যে নিরপেক্ষতা দেখিয়েছিল, তাও ছিল 'বাই চান্স' নিরপেক্ষ। পাঠক,  মনে আছে নিশ্চয়ই, ১৯৯০-৯১ সালে দেশে ৩টি রাজনৈতিক  জোট  ছিল।  আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোট এবং বাম দলগুলোর জোট। এই ৩ জোটের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ত্বাধীন জোট নিশ্চিত  ছিলো যে নির্বাচনে তারাই জিতবে। বিএনপি ভেবেছিল তারা না জিতলেও জয়ের  কাছাকাছি থাকবে। আর বাম জোটের হার-জিত নিয়ে কোন হিসাবই ছিল না। এই ৩ জোটই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে এমন চাপে রেখেছিল যে, তাদের অসৎ হওয়ার কোন সুযোগই ছিল না। অনেকটা পদার্থবিদ্যার সেই সূত্রের মতো - কোনো বস্তুকে যদি চতুর্দিক থেকে সমান চাপ দেওয়া যায় তাহলে সেটি স্থিরাবস্থায় থাকবে। সে কারণেই তৎকালীন রউফ কমিশন নিরপেক্ষ থাকতে পেরেছে। ৯৬ এর নির্বাচন ৯১ এর মতো না হলেও সার্বিক বিবেচনায় সেটাও ছিল  একটি  গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।  তবে নির্বাচনের অব্যবহিত আগে সেনাবাহিনীতে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, সে সময় সরকারপ্রধান  হাবিবুর রহমান সাহেব যদি তার প্রশাসনিক দৃঢ়তা না দেখাতে পারতেন, তাহলে নির্বাচনটি এত সহজ হতো না।

প্রসঙ্গত আমি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত কয়েকটি নির্বাচনের কথা উল্লেখ করব। ব্যক্তিগতভাবে আমার সুযোগ  হয়েছিল  জাতিসংঘের অধীনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন দেশে অন্তত ৯টি নির্বাচনে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করার। এই ৯টির মধ্যে মাত্র ২টি নির্বাচনকে সত্যিকার অর্থেই 'ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার' বলব। এর একটি হলো ১৯৯৩  সালের কম্বোডিয়ার নির্বাচন। অন্যটি ১৯৯৯ সালের পূর্ব তিমুরের নির্বাচন। অন্য ৭টি নির্বাচনের মধ্যে ২০০৪ ও ২০০৫ সালে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচনকে আংশিক গ্রহণযোগ্য বলা যেতে পারে। এ জন্যই প্রসঙ্গটি টানছি যে, বাংলাদেশের  বর্তমান প্রেক্ষাপটে  এগুলো থেকে কিছুটা হলেও শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে। ১৯৯৩ সালে কম্বোডিয়ায় যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তার সম্পূর্ণ দায়িত্বই ছিল জাতিসংঘের। সেসময়ে ওখানকার জাতিসংঘ মিশনের নাম ছিল 'ইউনাইটেড নেশনস ট্রানজিশনাল অথরিটি ইন কম্বোডিয়া' বা 'ইউএনটিএসি'। নাম দেখেই বোঝা যায় জাতিসংঘ  ওখানে 'তত্ত্বাবধায়ক সরকারের' ভূমিকা পালন করেছে। যার প্রধান ছিলেন জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের বিশেষ প্রতিনিধি ইয়াসুসি আকাসি। একইভাবে পূর্ব তিমুরের জাতিসংঘ মিশনটির নাম ছিল 'ইউনাইটেড নেশনস ট্রানজিশনাল এডমিনিস্ট্রেশন ইন ইস্ট তিমুর'।  এটিও ছিল একটি  তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মতো। সে কারণেই নির্বাচন  কমিশন  সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পেরেছিল। কিন্তু আফগানিস্তানের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। ওখানে জাতিসংঘের ভূমিকা ছিলো 'সহযোগিতার', কোনো অথরিটি ছাড়া। তাই প্রথম ২টি নির্বাচন (২০০৪/২০০৫) কিছুটা গ্রহণযোগ্য হলেও, এর পরের প্রায় সবগুলোই ছিল  প্রশ্নবিদ্ধ।  দুর্নীতি,  ভোট কারচুপি,  ব্যালট স্টাফিং, সবই ছিলো  সত্য (যা পরে তালেবানের ক্ষমতা দখলের পথকে সুগম করেছে)। 

এই উদাহরণগুলো এ জন্যই উল্লেখ করছি যে, যেখানে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কোনো অথরিটি থাকে না এবং তাকে কাজ করতে হয় দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক সরকারের অধীনে, সেখানে স্বর্গ থেকে ফেরেশতা এনে বসালেও কোনো কাজ হবে না।

এবার ঐকমত্যের প্রশ্নে আসা যাক। ঐকমত্য খুবই ভালো জিনিস। কিন্তু কিসের ঐক্য? শুধু কয়েকজন ব্যক্তিকে পছন্দের ঐক্য? নাকি আরও কিছু? একটা সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে প্রাথমিক শর্তাদি রয়েছে, সেগুলোতে ঐকমত্য না হলে শুধুমাত্র ব্যক্তি পছন্দের ঐক্য দিয়ে কোনো লাভ হবে না।

কারণ, একটা  কথা মনে রাখতে হবে, যত সুন্দর  আইন আর সুন্দর  মানুষের সমন্বয়েই কমিশন গঠন করা হোক না কেন- মাঠের নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তাকে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতেই হবে। আর, সেই প্রশাসনের লোকেরাই যদি সরকার তথা সরকারি দলের ভয়ে ভীত থাকে, তাহলে সরকারি দল যে বিশেষ সুবিধা পাবে, তা তো বলাই বাহুল্য।  এ প্রসঙ্গে মনে করা যাতে পারে, যে কর্মকর্তারা ১৯৮৬'র  ভোট চুরির নির্বাচন পরিচালনা করেছিলেন, তারাই ১৯৯১ এ এসে সৎ হয়ে গেছেন। আবার তারাই ২০১৪ কিংবা ২০১৮'র মধ্যরাতের কলঙ্কিত নির্বাচন পরিচালনা করেছেন। তাই আইন আর ঐকমত্যে দিয়ে কোনো দিনই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। যতদিন নির্বাচনে কালো টাকা আর পেশীশক্তির প্রভাব থাকবে, ততদিনই সাধারণ জনগণ শিল-পাটার ঐকমত্যের মাঝখানে পড়ে পিষ্ট হবে। হারানো গরুও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না কার্যবিধির বইয়ে।

মোশতাক আহমেদ: সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা, পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স অফিসার, আফগানিস্তান

moshtaque@gmail.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Impact of esports on Bangladeshi society

From fringe hobby to national pride

For years, gaming in Bangladesh was seen as a waste of time -- often dismissed as a frivolous activity or a distraction from more “serious” pursuits. Traditional societal norms placed little value on gaming, perceiving it as an endeavour devoid of any real-world benefits.

17h ago