দালাল প্লাস: বড় প্রতিশ্রুতি, বড় প্রতারণা

তাদের আছে বিশাল ডিসকাউন্ট অফার। অফারের নাম — টর্নেডো, টাইফুন, কালবৈশাখী, তুফান। মোবাইল ফোন, ফ্ল্যাট, গাড়ি থেকে শুরু করে কী বিক্রি করে না তারা।

৪৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় এবং ৩০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ নিয়েছে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম দালাল প্লাস।

অথচ, অসংখ্য গ্রাহক অভিযোগ করছেন যে তারা সময়মতো পণ্য পাননি। অনেকে মাসের পর মাস অপেক্ষায় আছেন।

অগ্রিম টাকা নিয়ে সময় মতো পণ্য ডেলিভারি না দেওয়া স্থানীয় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের তালিকা দেশে দীর্ঘতর হচ্ছে। সেই তালিকারই আরেকটি নাম দালাল প্লাস।

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা টাঙ্গাইলের সুলতান হামিদ করোনা মহামারিতে কাজ হারিয়ে রিসেলার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

যারা অনলাইনে পণ্য কেনেন এবং নিজেদের মুনাফা রেখে গ্রাহকদের কাছে বিক্রয় করেন তারাই রিসেলার। দেশের ই-কমার্স কমিউনিটিতে রিসেলার শব্দটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

৫০ শতাংশ ছাড়ের আশায় দালাল প্লাসে ৪৬টি দামী স্মার্টফোন অর্ডার করেছিলেন হামিদ। এর জন্য অগ্রিম পরিশোধ করেন ৫০ হাজার টাকা।

পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে ধার করে এবং টিউশনি করে এই অর্থ জোগাড় করেছিলেন তিনি।

হামিদ দ্য ডেইলি স্টারকে গত রোববার বলেন, 'অর্ডার করার পর তিন মাস কেটে গেছে। দালাল প্লাস কয়েকবার ডেলিভারির তারিখ দিয়েছে কিন্তু পণ্য হাতে আসেনি।'

'খুব খারাপ সময় যাচ্ছে আমার।'

বিভিন্ন সময়ে দালাল প্লাস বিভিন্ন ব্র্যান্ডের গাড়ি ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ে বিক্রির অফার দিয়েছে।

গত এপ্রিলে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে মোটরসাইকেলে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেয় দালাল প্লাস।

গাজীপুরের বাসিন্দা মো. মুক্তাদির গত ২৮ জুন দালাল প্লাসে ওয়ালটন ব্র্যান্ডের রেফ্রিজারেটর অর্ডার করেন। ৫০ শতাংশ ছাড়ে পণ্যটি পাওয়ার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত তা হাতে পাননি তিনি।

অগ্রিম টাকা দেওয়ার হতাশা প্রকাশ করে মুক্তাদির বলেন, 'আমি অনেকবার তাদের ফোন করেছি এবং ডেলিভারির দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ইমেইল করেছি। খুব শিগগির পণ্য পাওয়ার আশা দিয়ে তারা বারবার ডেলিভারির তারিখ পরিবর্তন করছে।'

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে গত ২৫ সেপ্টেম্বর দালাল প্লাসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম রাব্বি আল-মামুনের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

গত রোববার প্রতিষ্ঠানটির ধানমন্ডি অফিসে যায় দ্য ডেইলি স্টারের একজন প্রতিবেদক।

অফিসের ভেতরে যাওয়ার পর সেখানকার একজন কর্মচারী প্রতিবেদকের বিজনেস কার্ড চেয়ে নেন। তিনি ওই প্রতিবেদককে চলে যেতে বলেন এবং জানান, তার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পরবর্তীতে যোগাযোগ করা হবে। এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির কেউ যোগাযোগ করেনি।

অফিসটিতে প্রতিবেদক অন্তত ১২ জনেরও বেশি গ্রাহককে একটি রুমে অপেক্ষা করতে দেখেছেন। তারা এসেছিলেন সময়মতো পণ্য না পাওয়ার কারণ জানতে।

এ পর্যন্ত কতো অর্ডার পেয়েছে, তার মধ্যে কতগুলো ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে, কিছু ডেলিভারিতে কয়েক মাস পর্যন্ত কেন লাগছে? গ্রাহকদের দেরিতে পণ্য ডেলিভারি সম্পর্কিত সমস্যার বিষয়টি দেখার জন্য প্রতিষ্ঠানটি নিয়োজিত কর্মকর্তাকে এসব প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, দালাল প্লাসের বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগ জমা পরেছে এবং এখন পর্যন্ত মাত্র ৬টি অভিযোগের সমাধান করা হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এবং ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান হাফিজুর রহমানের মন্তব্য জানার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

তবে, মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা বলেন, প্ল্যাটফর্মটির বিষয়ে তদন্ত শুরু করা এখনও বাকি।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, দালাল প্লাসের বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে কোনো অনুরোধ পাইনি।

তিনি বলেন, 'আমরা কোম্পানির বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ পেয়েছি, তাই আমরা কিছু সরকারি সংস্থার কাছ থেকে এর সম্পর্কে তথ্য চেয়েছি।'

দালাল প্লাসের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে দেওয়া সম্প্রতি এক পোস্টে গ্রাহকদের কিছু চেক বাউন্স হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছে।

সেখানে বলা হয়েছে, গ্রাহকদের চিন্তার কিছু নেই, শিগগির তারা তাদের অর্থ বা পণ্য পাবে।

পেমেন্ট গেটওয়ের 'নতুন নীতি'কে এই দেরির জন্য দায়ী করছে তারা। তাদের দাবি, এই নীতির জন্যই অতিরিক্ত সময় নিতে বাধ্য হচ্ছে তারা।

দালাল প্লাস বলছে, তাদের একটি বড় অংকের অর্থ একটি পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে আছে। সেটি তারা গত তিন থেকে চার মাস আগে ব্যবহার করা বন্ধ করে দিয়েছে। নতুন ডেলিভারি ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ার কারণে, তাদের বর্তমান পেমেন্ট গেটওয়েতে প্রচুর টাকা আটকে আছে।

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সদস্যও নয় দালাল প্লাস।

ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, 'দালাল প্লাসের সন্দেহজনক কার্যকলাপ সম্পর্কে জানিয়ে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি পাঠিয়েছি। তারা যেহেতু ই-ক্যাবের সদস্য না, তাই বিষয়টি এখন আর আমাদের এখতিয়ারে নেই।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা দালাল প্লাস সম্পর্কে অনেক গ্রাহকের অভিযোগ শুনেছি। আমাদের সদস্য না হওয়ায় আমরা তাদের সতর্কবাণী দিতে পারি না। সরকারি সংস্থার এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Govt relieves Kuet VC, Pro-VC of duties to resolve crisis

A search committee will soon be formed to appoint new candidates to the two posts

2h ago