বাতাসের গুণগত মান নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন গাইডলাইন

বাংলাদেশের জন্য আরও কঠিন চ্যালেঞ্জ
ছবি: স্টার ফাইল ছবি

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গতকাল বাতাসের গুণগত মান পরিমাপের মানদণ্ড 'এয়ার কোয়ালিটি গাইডলাইনস (একিউজিস)' আরও কঠোর করায় বাংলাদেশে নিরাপদ বায়ু নিশ্চিত করা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নতুন নীতিমালায় বায়ু দূষণকারী ৩টি মূল উপকরণের গ্রহণযোগ্য মাত্রা কমানো হয়েছে। এই উপাদানগুলো হচ্ছে পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) ২ দশমিক ৫, পিএম ১০ ও নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড (এনও২)।

পিএম বা পার্টিকুলেট ম্যাটার বলতে আমরা বুঝি বাতাসে ভেসে বেড়ানো কঠিন ও তরল পদার্থের মিশ্রণ, যা অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া খালি চোখে দেখা যায় না। এগুলো খুব সহজে নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে। বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদানের সমন্বয়ে পিএম তৈরি হতে পারে। পিএম ২.৫ এর ব্যাস ২.৫ মাইক্রণের কম হয় এবং পিএম ১০ এর ব্যাস ১০ মাইক্রণের মতো হয়ে থাকে।

আগে বাতাসে ক্ষতিকর উপকরণের যে পরিমাণ ঘনত্ব থাকলে আমরা স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে থাকতাম, নতুন মানদণ্ড তার চেয়ে কম ঘনত্বে বাড়তি ঝুঁকির কথা বলছে।

বায়ুদূষণ হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি), ফুসফুসের ক্যান্সার ও শিশুদের মধ্যে একিউট লোয়ার রেসপিরেটরি সংক্রমণসহ অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ সালে একিউজিস নীতিমালা প্রকাশের পর স্বাস্থ্যের ওপর বায়ু দূষণের প্রভাব নিয়ে নতুন অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রায় প্রতিটি 'একিউজির মাত্রা কমিয়েছে'। প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, বায়ুর মানের নতুন মানদণ্ডে নির্ধারিত দূষণের মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেলে জনস্বাস্থ্যের ওপর বড় আকারের ঝুঁকি নেমে আসবে।

২০২০ সালের বিশ্বের দূষিত বাতাসের দেশের তালিকার শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ এবং দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় ঢাকা দ্বিতীয় স্থানে ছিল। ২০২১ এর মার্চে আইকিউএয়ারের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা যায়।

পরিবেশ অধিদপ্তরের (ডিওই) পরিচালক (ঢাকা বিভাগ) মো. জিয়াউল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা সব সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অর্জন করতে চাই। যদি মানদণ্ড আরও কঠোর হয়ে যায়, তাহলে আমাদের জন্য সেটি অর্জন করা আরও কঠিন হবে। কারণ আমরা প্রচুর পরিমাণে অবকাঠামোগত কার্যক্রম ও শিল্পায়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমরা দেশের জিডিপি'র প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেষ্টা করছি।'

তিনি জানান, তারা বায়ু দূষণ কমানোর জন্য কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন, যেমন ধীরে ধীরে ইটের ভাটার সংখ্যা কমিয়ে আনা এবং দালান নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব ইটের ব্যবহার বাড়ানো।

বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ডিওই'র তৈরি একটি খসড়া নীতিমালা ইতোমধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো হয়েছে এবং আগামী মাস থেকে এটি বাস্তবায়িত হতে পারে, জানান তিনি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, দেশের নীতিমালাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালার সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।

রিজওয়ানা বলেন, 'বাংলাদেশীদের ফুসফুস মার্কিনদের ফুসফুস থেকে ভিন্ন নয়। আমি সরকারের উদাসিনতা ও ব্যর্থতার কারণে নিজের আয়ু কমাতে রাজি নই।'

বিষয়টির গুরুত্ব অনুযায়ী নীতিমালার পরিবর্তে বায়ু দূষণ প্রতিরোধে আইন তৈরি করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

নীতিমালা প্রকাশ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. টেড্রস আধানম গেব্রিয়াসুস বলেন, 'বায়ু দূষণ সকল দেশের জন্য একটি স্বাস্থ্য-ঝুঁকি, কিন্তু এটি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে সবচেয়ে কঠিনভাবে আঘাত করে।'

তিনি বলেন, 'বাতাসের মানের নতুন নীতিমালা একটি তথ্য-প্রমাণ ভিত্তিক ব্যবহারিক উপকরণ, যার মাধ্যমে বায়ুর গুণগত মানের উন্নয়ন করা যাবে।'

তিনি মানুষের দুর্ভোগ কমাতে এবং জীবন রক্ষা করতে সব দেশ ও পরিবেশ আন্দোলনকারীদের নতুন নীতিমালা অনুসরণ করার আহ্বান জানান।

নতুন নীতিমালা সুপারিশ করেছে বার্ষিক গড় পিএম ২.৫ এর ঘনত্বকে প্রতি ঘনমিটারে ১০ মাইক্রোগ্রাম (২০০৫ এর মানদণ্ড) থেকে কমিয়ে ৫ মাইক্রোগ্রামে নামিয়ে আনতে। পিএম ১০ এর ক্ষেত্রে সুপারিশ হচ্ছে ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে ২০ মাইক্রোগ্রাম থেকে কমিয়ে ১৫ মাইক্রোগ্রামে নামিয়ে আনার।

বাংলাদেশের বাতাস

২০২০ সালে পিএম ২.৫  এর গড় বার্ষিক ঘনত্ব ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৭৭ দশমিক ১ মাইক্রোগ্রাম। দেশের বাতাসে সবচেয়ে বিপজ্জনক এই উপাদানটির পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ করা পরিমাণের চেয়ে ৭ গুণেরও বেশি ছিল।

নতুন মানদণ্ড অনুযায়ী, এর মাত্রা নিরাপত্তা সীমার চেয়ে ১৪ গুণ বেশি।

বায়ুর মান সংক্রান্ত তথ্যের প্ল্যাটফর্ম আইকিউএয়ার বলছে, ঢাকার এয়ার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স স্কোর সেপ্টেম্বর ২০, ২১ ও ২২ এ ছিল যথাক্রমে ১১৩, ১০৮ এবং ১১৩।

একিউআইয়ের এই সূচকের অর্থ হলো বাতাসের মান গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি। একিউআই স্কোর ৫১ থেকে ১০০ হলে বাতাসের মান 'গ্রহণযোগ্য' বলে ধরে নেওয়া হয়।

প্রভাব

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, পিএম ২.৫ এর কারণে সারা বিশ্বে যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার ৮০ শতাংশই প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে যদি প্রস্তাবিত একিউজি'স অনুযায়ী বায়ু দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনা যায়।

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সবচেয়ে বেশি সুফল পাওয়া যাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকা অঞ্চলে।

এই একিউজি'র বাস্তবায়ন করা হলে বড় জনসংখ্যা ও পিএম ২.৫ সমৃদ্ধ দেশগুলোতে রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা কমে আসবে এবং তারা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন।

পার্টিকুলেট ম্যাটার মূলত তৈরি হয় বিভিন্ন খাতে জ্বালানী পোড়ানোর কারণে যেমন যাতায়াত, বিদ্যুৎ, আবাসন, শিল্প ও কৃষি।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

You have crushed fascism, now strengthen democracy and press freedom

The Daily Star Editor Mahfuz Anam's appeal to the ‘new generation leaders’

9h ago