মাসে ২ কোটি টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা দক্ষ জনবলের ঘাটতি
সরকারের নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচিতে দক্ষ জনবলের ঘাটতি শিগগির পূরণ করা না হলে আগামী অক্টোবর থেকে প্রতি মাসে ২ কোটি মানুষকে করোনার টিকা দেওয়া খুবই চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করেছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।
তারা জানান, সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) জনবলকে সারা দেশে চলমান করোনার টিকাদান কর্মসূচিতে বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে, জনবল সংকটের বিষয়টি সমাধান না করে টিকাদান কর্মসূচির কলেবর বাড়ানো হলে তা করোনার টিকাদান ও ইপিআই কার্যক্রমকে বিঘ্নিত করবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
তারা স্বাস্থ্য সহকারী পদে কমপক্ষে ১১ হাজার জনকে দ্রুত নিয়োগের প্রয়োজনের কথা জানান।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা মনে করেন, বাংলাদেশে শিশুদের টিকাদানে ইপিআইয়ের ভূমিকা বিশ্ব দরবারে এক নতুন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি ১৫ হাজার ইপিআই স্বাস্থ্য সহকারীকে মাঠ পর্যায়ে করোনার টিকা দেওয়ার কাজে নিযুক্ত করা হয়।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা থেকে শুরু করে করোনার নমুনা সংগ্রহ, টিকা দেওয়ার পর তথ্য আপডেট করাসহ এই কর্মীরা নানা দায়িত্বে আছেন। সেই সঙ্গে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় প্রতি বছর আড়াই কোটি থেকে ৩ কোটি শিশুর টিকা দেওয়ার দায়িত্বও তারাই পালন করছেন।
সরকারের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল, দেশব্যাপী ১১ হাজার টিকাদান কেন্দ্রের মাধ্যমে দৈনিক সর্বোচ্চ সাড়ে ৩ লাখ মানুষকে এবং প্রতি মাসে প্রায় ১ কোটি টিকা দেওয়া। কিন্তু, টিকার সরবরাহে ঘাটতি থাকায় সে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি।
টিকার স্বল্পতার কারণে গণটিকাদান কর্মসূচি প্রায় ২ মাসের জন্য স্থগিত ছিল। গত ২৬ এপ্রিল বাংলাদেশে প্রথম ডোজের টিকা দেওয়া স্থগিত করা হয়। এর ৯ দিন পরে নিবন্ধন প্রক্রিয়াও স্থগিত রাখা হয়।
গত ১৯ জুন থেকে সরকার সীমিত আকারে প্রথম ডোজের টিকা দেওয়া শুরু করে এবং পর্যায়ক্রমে এর আওতা বাড়ায়।
গত কয়েক মাসে টিকার সরবরাহ মোটামুটি স্থিতিশীল হওয়ায় সরকার এখন আগামী কয়েক মাসে বড় আকারে টিকাদান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে আগের ঘাটতি মেটাতে চাইছে।
গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে জানান, সরকার এ বছরের শেষ নাগাদ দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৩০ লাখের বেশি মানুষের মধ্যে ৫৫ শতাংশকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
তিনি আরও বলেন, চীন থেকে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে প্রতি মাসে ২ কোটি করে সিনোফার্ম টিকার ডোজ আসবে।
প্রধানমন্ত্রী সংসদকে আরও জানান, গত ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট প্রত্যাশিত ২৪ কোটি ৬৫ লাখ ডোজ টিকার মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ ডোজ টিকা ইতোমধ্যে উপহার ও দ্বিপাক্ষিক ক্রয় চুক্তির আওতায় দেশে পৌঁছেছে।
গত সপ্তাহে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, 'প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী টিকা হাতে পেলে শুরুতে আমরা প্রতি মাসে দুই কোটি ডোজ সিনোফার্ম টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করছি।'
স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে করোনার টিকা দেওয়ার প্রক্রিয়াটির আরও পদ্ধতিগত ও কাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন, কারণ টিকা পাওয়ার জন্য নির্বাচিত জনগোষ্ঠীর মাত্র ৬ শতাংশকে এ পর্যন্ত টিকা দেওয়া হয়েছে।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে একজন ইপিআই কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে জানান, 'আমরা এখনো গণটিকাদান কর্মসূচি নিয়ে সমস্যায় আছি। কারণ, টিকা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট অনেক কম।'
তিনি জানান, ইপিআই দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার অল্প সংখ্যক উজ্জ্বল নমুনার একটি এবং করোনার টিকাদানে এই প্রকল্পের জনবল ও লজিস্টিকসের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার তাদের নিয়মিত কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) এক কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইপিআইকে বছরে আড়াই থেকে ৩ কোটি শিশুর টিকার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এখন আমাদেরকে নিয়মিত ইপিআই কার্যক্রমের পাশাপাশি আরও ২৫ কোটি ডোজ টিকা দিতে হবে। ইতোমধ্যে এই দায়িত্ব আমাদের জন্য বোঝায় পরিণত হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রায় ১৫ হাজার স্বাস্থ্য সহকারী মাঠপর্যায়ের নিয়মিত ইপিআই কার্যক্রমের দেখভাল করেন। যদিও ২০১৮ সালে স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা আরও ১১ হাজার কর্মী চেয়েছেন।'
'জনবল না বাড়িয়ে দীর্ঘ সময় ধরে করোনার টিকাদান কর্মসূচি চালানোর পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত নয়। জানি না এভাবে কেমনে চলতে পারে,' যোগ করেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম ডেইলি স্টারকে জানান তারা ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ১১ হাজারেরও বেশি স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন।
তিনি বলেন, 'হাসপাতালের কর্মীদের মাধ্যমে ইপিআই'র কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয়। আমরা ইতোমধ্যে সাড়ে ১১ হাজার স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছি। আমরা ফাইলটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি।'
তিনি আরও বলেন, নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়াটি স্থানীয় পর্যায়ে করা হবে না।
ইপিআই একই সঙ্গে কোল্ড চেইন টেকনিশিয়ানের সংকটেও ভুগছে।
ইপিআই'র কর্মকর্তারা জানান, প্রতিটি জেলায় অন্তত একজন কোল্ড চেইন প্রকৌশলী থাকা উচিৎ, কিন্তু ৩০টি জেলায় কোনো প্রকৌশলী নেই।
তিনি জানান, ঢাকায় মাত্র ৫ জন কোল্ড চেইন টেকনিশিয়ান আছেন, কিন্তু ২০ জন থাকা উচিৎ।
বাংলাদেশ হেলথ এ্যাসিস্ট্যান্ট এ্যাসোসিয়েশন কেন্দ্রীয় সভাপতি শেখ রবিউল আলম খোকন জানান, তাদের কাজের চাপ অনেক বেড়ে গেছে, কারণ এখন হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা, নমুনা সংগ্রহ, করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া থেকে শুরু করে ডেটা এন্ট্রি পর্যন্ত অনেক কাজ তাদের দায়িত্বের অংশ হয়ে গেছে।
খোকন বলেন, 'আমরা এসব কাজ আমাদের নিয়মিত ইপিআই কার্যক্রমের পাশাপাশি করে আসছি। আমাদের কাজের চাপ এখন মাত্রাতিরিক্ত।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য সচিব ডা. শামসুল হক জানান, এ মুহূর্তে যে পরিমাণ জনসম্পদ রয়েছে, তাদের মাধ্যমে মাসে সর্বোচ্চ দুই কোটি টিকা দেওয়া সম্ভব।
ইপিআই'র পরিচালক শামসুল আরো বলেন, 'যদি টিকাদান কর্মসূচির পরিধি বড় আকারে বাড়ানো হয়, তাহলে সমগ্র প্রক্রিয়াটিকে সুষ্ঠুভাবে চলমান রাখতে আমাদের আরও জনসম্পদ প্রয়োজন হবে।'
তিনি আরও বলেন, কালোবাজারে টিকা পাওয়া যাচ্ছে এবং ইপিআই টিকাদান কর্মসূচীর নিয়ন্ত্রণে না থাকলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে টিকা নেওয়ার ঘটনা বাড়তে পারে।
তিনি বলেন, 'যদি টিকাদান কর্মসূচি এককভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বে থাকে, তাহলে এ ধরণের অনৈতিক ও অবৈধ ঘটনা আর ঘটবে না। কিন্তু যদি অন্যান্য অংশীজনদের টিকাদানের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়, তাহলে এ ধরণের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।'
তিনি জানান, টিকাদান কর্মসূচীকে ঝামেলামুক্ত রাখতে একটি ডেডিকেটেড করোনাভাইরাস সেল প্রয়োজন, কারণ বিপুল পরিমাণ মানুষকে টিকা দিতে হবে।
তিনি বলেন, 'বর্তমানে আমরা করোনাভাইরাস ও ইপিআই'র নিয়মিত কার্যক্রমকে নিজেরা আলোচণা করে আলাদা করে নিয়েছি। কিন্তু এটিকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর আওতায় আনা প্রয়োজন।'
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments