পোশাক শিল্পের প্রবৃদ্ধি অর্জনে চাই শিল্প-শিক্ষার ঘাটতি মোচন

স্টার ফাইল ছবি

আশির দশকের গোঁড়ার দিকে স্বল্প পরিসরে একটি অপ্রচলিত রপ্তানি খাত হিসেবে বাংলাদেশের পোশাক খাতের যাত্রা শুরু  হয়। মাত্র ১২ হাজার ডলার রপ্তানি আয় দিয়ে শুরু করা পোশাক শিল্প আজ বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে রেখে চলেছে অনবদ্য অবদান। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৩ শতাংশ অর্জিত হয় তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে।

'মেড ইন বাংলাদেশে' খচিত পোশাক সারাবিশ্বের মানুষ পরে। তৈরি পোশাক বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। পোশাক খাত দেশে প্রায় ৪৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে এবং ৩২ বিলিয়ন ডলারের অধিক রপ্তানি আয়ের উৎস। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যে শিল্প এত অবদান রেখে চলেছে, সেই শিল্পের উন্নয়নে সার্বিক উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা থাকবে—এমনটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাস্তব চিত্রটা ঠিক তেমন নয়, যেমনটা হওয়া উচিত ছিল। শ্রমঘন শিল্প হিসেবে পোশাক শিল্পের জন্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি যেমন: শ্রমিক, ডিজাইনার, মার্চেন্ডাইজার, পণ্য উন্নয়নকারী ও ব্যবস্থাপক প্রয়োজন হয়। কিন্তু, দেশে পোশাক শিল্পের জন্যে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার এখনো যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।

পোশাক শিল্প আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি বললে অত্যুক্তি হবে না। অথচ আমাদের দেশের স্কুল ও কলেজগুলোর পাঠ্যক্রমে পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্ট কোনো পাঠ্যসূচি বা অধ্যায় নেই। অধিকন্তু দেশের মোট ৩৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে মাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে টেক্সটাইলের ওপরে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে। হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টেক্সটাইল বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর উচ্চশিক্ষা লাভের ব্যবস্থা রয়েছে। বস্ত্র ও ফ্যাশন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে বিজিএমইএ ২০১২ সালে বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি (বিইউএফটি) প্রতিষ্ঠা করে। টেক্সটাইল ও ফ্যাশন বিষয়ক উচ্চশিক্ষার জন্যে এটি বাংলাদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যেটি কেবল পোশাক শিল্পের জন্যে শিক্ষিত ও দক্ষ জনবল তৈরি করার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

কিন্তু, আমাদের তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যে পাঠদান করা হচ্ছে, তার সঙ্গে পোশাক শিল্পে কাজ করার জন্যে ও এ শিল্পকে ভবিষ্যতে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে ধরনের জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন—তার সঙ্গে বিরাট অমিল বা ফারাক রয়েছে। এর প্রমাণ আমাদের সামনেই রয়েছে। আমাদের দেশের বহু তরুণ পড়াশোনা শেষ করে পোশাক শিল্পে কর্মসংস্থানের জন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্যদিকে বহুসংখ্যক বিদেশি আমাদের পোশাক শিল্পে উচ্চ বেতনে কর্মরত। এর মানে হচ্ছে পোশাক শিল্পে চাহিদার বিপরীতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ লোকবলের অভাব রয়েছে।

এ ধরনের বাস্তবতা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ভবিষ্যতের জন্যে ভালো ইঙ্গিত বহন করে না। তবে, বেশ কিছু উপায়ও রয়েছে, যা অবলম্বনের মাধ্যমে আমরা একটা সময় এ অবস্থা থেকে উত্তরণ করতে পারব। তবে, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যে দ্রুত কোনো সমাধান নেই। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রয়োজন সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) ও শিল্পের অভ্যন্তর থেকে সহায়তা এবং পর্যাপ্ত বিনিয়োগ।

এর জন্যে প্রথমেই আমাদের দেখতে হবে যে, মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ে পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্ট কী কী বিষয় পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এ শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা বিবেচনায় বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় পোশাক শিল্পের ওপর শিক্ষামূলক অধ্যায় সন্নিবেশন করা অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত। পোশাক শিল্পে সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার গঠনের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। শিক্ষা পাঠ্যক্রমে এ বিষয়টি তুলে ধরা সম্ভব, যাতে দেশের শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে জানার সুযোগ পায় এবং পোশাক শিল্পে তাদের ক্যারিয়ার গঠনের জন্যে নিজেদের প্রস্তুত করতে পারে।

এ প্রক্রিয়ায় সরকার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে ও বিনিয়োগ করার বিষয়ে আগ্রহী হতে হবে। পোশাক শিল্পের নেতাদেরও এ উদ্যোগে জড়িত হওয়া প্রয়োজন। কেননা তাতে পাঠ্যক্রমে শিক্ষার্থীদের জন্যে পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্ট সঠিক পাঠ্যসূচি প্রণয়ন ও সংযোজন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। একে দেশের পোশাক শিল্পের ভবিষ্যতের জন্যে বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। কেননা এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে শিক্ষার্থীরা পোশাক শিল্পে কাজ করার জন্যে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে সক্ষম হবে। ফলে পোশাক শিল্পের চাহিদানুযায়ী প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ মধ্যম পর্যায়ের কর্মী তৈরি হবে। যা এ শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করবে।

এ প্রক্রিয়ায় পাশাপাশি 'ইনকিউবেশন সেন্টার' স্থাপন করতে হবে। 'ইনকিউবেশন সেন্টার' মডেলটি উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যাপক প্রচলিত ও ব্যবহৃত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্থাপিত ইনকিউবেশন সেন্টারগুলো থেকে বিশ্বমানের শিক্ষা ব্যবস্থা, ইনকিউবেশন, শিল্পোদ্যোগ, উদ্ভাবন ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনার সুযোগ রয়েছে। এ ধরনের প্রকল্প নেটওয়ার্কিং ও স্টার্ট-আপ ব্যবসার সুযোগ তৈরি করছে। এর মাধ্যমে অভিজ্ঞ পেশাদারদের তত্ত্বাবধানে তরুণ উদ্যোক্তারা ব্যবসার ক্ষেত্রে তাদের জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ পাচ্ছেন। এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা তরুণ শিল্পোদ্যোক্তাদের প্রচলিত ব্যবসার ধারার বাইরে উদ্ভাবনী ব্যবসায়িক ধারা ও কৌশল নিয়ে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। কাজেই সরকার, পোশাক শিল্প ও অন্যান্যদেরকে আমাদের দেশে এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার বিষয়ে আগ্রহী ও উদ্যোগী হতে হবে।

আমাদের দেশে ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপনে হয়তো বেশ সময় লাগবে। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ ও পোশাক শিল্পের মধ্যে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে, যা দেশে ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। পোশাক শিল্পে তরুণ প্রজন্মের জন্যে সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার গঠনের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। পোশাক শিল্পকে এ বিষয়টি তরুণদেরকে অবহিত করার উদ্যোগ নিতে হবে।

অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এমন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে গ্র্যাজুয়েটরা পোশাক শিল্প সম্পর্কিত শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পান। সেক্ষেত্রে পোশাক শিল্পের মৌলিক বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। যেখানে কারখানার উৎপাদনের বিভিন্ন ধাপ ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের যেমন: পোশাক কর্মী, মার্চেন্ডাইজার, ডিজাইনার, পণ্য উদ্ভাবনকারী ইত্যাদির কাজ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া যেতে পারে। ফলে শিক্ষার্থীরা এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত পেশাগুলোর ধরন সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারবে এবং এখানে তাদের ক্যারিয়ার গড়ার বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

আগামীতে পোশাক শিল্পকে বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্যে আমাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় পোশাক শিল্প নিয়ে শিক্ষা বিষয়ক যে ঘাটতি রয়েছে, তা পূরণ করতে পারলে আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তা সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

মোস্তাফিজ উদ্দিন: ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Climate finance: COP29 draft proposes $250b a year

COP29 draft deal says rich nations should pay the amount to fight climate change

1h ago