সেই তালেবান আর এই তালেবানে পার্থক্য কী
আফগানিস্তানের দুই-তৃতীয়াংশ দখলে নিয়েছে তালেবানরা। রাজধানী কাবুল থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরত্বের শহর পুলে আলম দখল নিয়ে তারা রাজধানীর দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছে। তালেবানরা ক্ষমতা দখলের প্রায় দ্বারপ্রান্তে।
আফগানিস্তানে আবার তালেবান ক্ষমতা দখল করলে এর প্রভাব কী হবে? কাদের সুবিধা ও অসুবিধা হবে? বাংলাদেশের ওপরেই বা কী ধরনের প্রভাব পড়বে? দ্য ডেইলি স্টার টেলিফোনে কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ ও অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে।
তিন জনই বলেছেন, আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশের ওপর সরাসরি কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে, বাংলাদেশকে নজরদারি আরও বাড়াতে হবে।
অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, 'গত ২০ বছরে তালেবানদের অনেক শিক্ষা হয়েছে। তারা ইতোমধ্যে বলেছে যে, কোনো বিদেশি নাগরিকের ওপর হামলা করবে না এবং সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখবে। এটিই ২০ বছর আগের এবং বর্তমান অবস্থার মধ্যে পার্থক্য। তা ছাড়া এতদিন সেখানে মার্কিন সেনা থাকলেও অধিকাংশ অঞ্চল কিন্তু তালেবানদের অধীনেই ছিল এবং আফগানিস্তানের অনেক লোকজনও কিন্তু তালেবানদের সঙ্গে আছে। তাই সেখানে তেমন প্রভাব পড়ার কথা না। তবে, আমাদের আরও সময় অপেক্ষা করতে হবে।'
সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে তিনি বলেন, 'আমি মনে করি সবার আগে ভারতের ঝামেলা হতে পারে। তবে, ভারতের কূটনীতি অনেক শক্তিশালী। তারা তালেবানদের সঙ্গে অবশ্যই সম্পর্ক স্থাপন করবে বলে আমার মনে হচ্ছে। তা ছাড়া ভারত আফগানিস্তানে অনেক বিনিয়োগ করেছে। তারা চাইবে না তাদের এই বিনিয়োগ শেষ হয়ে যাক।'
'মার্কিন সরকার যেহেতু সেখান থেকে চলে গেছে, তাই ভারত একা কোনোভাবেই তালেবানের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক করতে চাইবে না বা কোনো দ্বন্দ্বে জড়াতে চাইবে না। তা ছাড়া আমেরিকাও বিভিন্নভাবে সেখানে সম্পর্ক করতে চাইবে। অন্যদিকে চীন কারো আভ্যন্তরীণ বিষয়ে তেমনভাবে হস্তক্ষেপ করে না। তবে, তারা তালেবানদের সঙ্গে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারে। ইরান, তুরস্ক যেভাবে মডেল হিসেবে তৈরি হয়েছে, আফগানও সেভাবে একটি মডেল হতে পারে। তবে, এর জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে', যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশে প্রভাব পড়ার বিষয়ে ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, 'কোনো দেশে জঙ্গিবাদের ক্ষেত্রে অবশ্যই রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। বাংলাদেশ বর্তমানে জঙ্গিবাদের বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। তাই তালেবানরা ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশে কোনো ধরনের প্রভাব পড়বে বলে আমার মনে হয় না। ২০ বছর আগে বাংলাদেশে যে ধরনের স্লোগান দেওয়া হতো, এখন আর সেভাবে দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে, বাংলাদেশকে নজরদারি আরও বাড়াতে হবে।'
অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন বলেন, 'বর্তমান তালেবান আগের তালেবান না। আর বর্তমান আফগানিস্তান আগের আফগানিস্তান না। আগে তালেবানদের মধ্যে অনেক গোঁড়ামি ছিল। এখন তা তেমন নেই। তালেবানদের অধীনে যে শহরগুলো ছিল, সেগুলোতেও আমরা কিন্তু আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন দেখেছি। তা ছাড়া সেখানে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ থাকবে। তালেবানরা ইচ্ছে করলেই যা খুশি তাই করতে পারবে না। তবে, সেখানে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব হতে পারে। সেখানে আমি কোনো স্থিতিশীল অবস্থা দেখতে পাচ্ছি না। তবে, তারা সেখানে কী ধরনের সরকার গঠন করে, তাও দেখতে হবে। আমাদের সঠিক অবস্থা জানার জন্যে আরও অপেক্ষা করতে হবে।'
তালেবানরা ক্ষমতা দখলে নিলে কাদের সুবিধা-অসুবিধা হবে, এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সবচেয়ে বড় অসুবিধা হবে আফগানিস্তানের জনগণের। যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে যে পরিস্থিতিতে ছেড়ে গেছে, আমার মনে হয় না এখানে চীন, রাশিয়া, ইরান, ভারত পাকিস্তান কোনো সুবিধা করতে পারবে। ইরানের মানুষের মতাদর্শের সঙ্গে তালেবানদের মতাদর্শ এক না। তা ছাড়া একটি অস্থিতিশীল পরিবেশে চীনও বিশেষ কোনো সুবিধা পাবে না। তবে, তারা সরকার গঠন করলে বা কী ধরনের পলিসি গ্রহণ করে, সেই পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।'
বাংলাদেশে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, জানতে চাইলে অধ্যাপক আমেনা মহসিন বলেন, 'বাংলাদেশের ওপর সরাসরি কোনো ধরনের প্রভাব পড়বে না। আমরা জঙ্গিবাদ বেড়ে যাওয়ার যে আশঙ্কা করছি, তা ঠিক না। আমাদের সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে। তা ছাড়া আমাদের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট এখন অনেক শক্তিশালী। তবে, আমাদের নজরদারি বাড়াতে হবে। আগের চেয়ে একটু বেশি সতর্ক থাকতে হবে।'
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, 'আফগানিস্তানে তালেবানরা কীভাবে ক্ষমতা দখল করছে, তার ওপর নির্ভর করে এর প্রভাব কেমন হবে। তারা যদি পরস্পরের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে, তবে সেখানে নতুন করে সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আবার সরকার গঠন করা হতে পারে। এক্ষেত্রে আশেপাশের দেশগুলোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকবে। আর তারা বন্দুকের মুখে ক্ষমতায় আসলে আন্তর্জাতিকভাবে আইসোলেশনের মধ্যে পড়বে। পরবর্তীতে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে।'
তালেবান ক্ষমতায় এলে কাদের সুবিধা ও অসুবিধা হতে পারে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ইরান ও পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবানের যোগাযোগ আছে। তারা সবাই চায় শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হোক। তবে, ভারতের সঙ্গে তালেবানদের যোগাযোগ এখনো স্বাভাবিক না।'
'যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে ইতোমধ্যে আফগান সৈন্যদের জন্যে ৮৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। তারা সেখানে আরও অনেক ব্যয় করবে। তা ছাড়া বাণিজ্য ও নিরাপত্তার খাতিরে চীন, রাশিয়া, ইরানের সঙ্গেও তালেবানদের ভালো সম্পর্ক থাকবে। তবে, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক কী পর্যায়ে থাকবে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না। সম্পর্ক খারাপও হতে পারে। আর ভারত যদি তালেবানদের মেনে নেয়, তবে ভারতের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো হতে পারে', যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশে এর প্রভাব নিয়ে জানতে চাইলে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, 'আফগানিস্তান সার্কের সদস্য। তাই এই জোটের একটি দেশ শান্তিপূর্ণ অবস্থায় থাকলে তা বাংলাদেশের জন্যে অবশ্যই ভালো হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যের সুযোগ-সুবিধা বাড়বে। আমাদের আফগানিস্তানের পরিস্থিতি বস্তুনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আগে সেখানে কী হয়েছে, তা দেখলে হবে না। বর্তমান তালেবান কিন্তু ২০ বছর আগের তালেবান না। এখন তালেবানরা বিশ্ব সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখে।'
Comments