পোশাক শিল্পে দাতাদের অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিতে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট কৌশল
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/garments_1.jpg)
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এমন বহু বৈশ্বিক দাতা সংস্থা রয়েছে যারা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থের যোগান দেওয়ার সামর্থ্য রাখে।
অনেক প্রকল্প দাতা সংস্থাগুলোর অর্থ ছাড়া হয়তো গ্রহণ করাই সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। অনেক ক্ষেত্রে সাপ্লাই চেইনে সাসটেইনেবিলিটি সংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে এসব প্রতিষ্ঠান অর্থায়ন করে থাকে। কেননা এসব প্রকল্পে বিনিয়োগের অর্থ ফেরত আসতে দীর্ঘ সময় লাগে। আর সাসটেইনেবিলিটি সংক্রান্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থ পাওয়াটা সাপ্লায়ারদের বা পণ্য উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারীদের পক্ষে সহজ নয়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, দাতা সংস্থার সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে বহু প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে যুক্ত থাকে। ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতা, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিত্ব, সরবরাহকারী এবং স্থানীয় পর্যায়ের আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দাতা প্রতিষ্ঠান নিজেই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকে। বাংলাদেশে উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের নিমিত্তে দাতা প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নকে আমরা স্বাগত জানাই।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি এসব আর্থিক সহায়তাকে আরও ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারি না? বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নিমিত্তে দাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ আরও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে ও সুচারুভাবে সদ্ব্যবহার করা যায় কি? দাতা সংস্থার বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সুফল লাভের জন্য আমাদের কি একটু ভিন্নভাবে চেষ্টা করা উচিৎ নয়?
বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর মহামারির প্রভাবের ব্যাপকতার প্রেক্ষিতে এই প্রশ্নগুলো যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে বেশি প্রাসঙ্গিক এবং প্রযোজ্য। কাজেই বাংলাদেশের স্বার্থে বৈদেশিক অর্থায়নের প্রতিটি অর্থের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশে দাতা সহায়তার যে চিত্র রয়েছে সেটা অনেকটা বিক্ষিপ্ত। কেননা এখানে বিভিন্ন দাতা সংস্থা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে এবং কে কোনটার সঙ্গে সম্পৃক্ত তার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া কঠিন কাজ। কারণ দেশে বর্তমানে বিভিন্ন ধরণের একাধিক প্রকল্প একই সময়ে, একইসঙ্গে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে দাতা সংস্থার উল্লেখযোগ্য সাড়া পাওয়াটা অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক। তবে যথার্থ সমন্বয়ের অভাব এ ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যথার্থ সমন্বয়ের অভাবে দেখা যায়, একই ধরণের একাধিক প্রকল্প পৃথকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে একই দাতার অর্থ একই ধরণের একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে। এর ফলে কিছু কাজের জন্য প্রচুর অর্থের যোগান থাকে আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য পর্যাপ্ত দাতা সহায়তার পরিমাণ অপ্রতুল। সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স, দর কষাকষির দক্ষতা বৃদ্ধি, শ্রমিকের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য এবং সম্পদের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কাজ করার জন্য আরও অনেক বেশি অর্থের যোগান প্রয়োজন। কাজেই কিভাবে আরও ভালোভাবে সমন্বয়ের মাধ্যমে দাতা সংস্থাগুলোর অর্থ এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে কাজে লাগানো যায়, তা আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন।
এখানে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো যখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একই ইস্যুতে আলাদাভাবে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে তখন প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়নের খরচ ও লাভের যথার্থ হিসাব পাওয়া যায় না। তাছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নের উপকার কতটা হচ্ছে, তা কে পরিমাপ করছে? কোন প্রকল্পের প্রভাব বা লাভ কতটা তাই বা আমরা কিভাবে হিসাব করবো? বৃহত্তর কল্যাণের জন্য গৃহীত প্রকল্পের জন্যই দাতা সংস্থা অর্থের যোগান দিয়ে থাকে। কাজেই আমরা কেউই চাই না দাতাদের অর্থ অপচয় হোক বা যথেচ্ছা ব্যবহার হোক। বরং সেটি যেন সকলের জন্য অর্থবহ হয় আমরা তাই কামনা করি। আমি মনে করি, দাতা সংস্থার আর্থিক সহায়তায় কিছু প্রকল্প অন্যগুলোর চেয়ে বেশি ফলপ্রসূ। কিন্তু কেন এমনটি হয়? সেটি আমাদের খুঁজে বের করা দরকার এবং তা থেকে ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
প্রকল্প থেকে প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া যায়নি, এমন কয়েকটি উদাহরণ নিলে দেখা যায়—সেখানে প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিসরে সীমাবদ্ধতা ছিল। অর্থাৎ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর দাতা সংস্থার সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে প্রকল্পটি কীভাবে অব্যাহত রাখা হবে, সে বিষয়ে পরিকল্পনা থাকে না। আর দাতা সংস্থাগুলো সাধারণত দুই কিংবা তিন বছর মেয়াদী পাইলট প্রকল্পের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে থাকে। আর প্রকল্প শেষ হওয়ার পর প্রকল্পের আওতাধীন কারখানাগুলো উদ্দেশ্য অনুযায়ী চালু রাখার জন্য অর্থ ব্যয়ে আগ্রহী থাকে না। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্পের সাফল্য পরিমাপের কোনো নির্দিষ্ট মাপকাঠি থাকে না। থাকলেও সেটা কেবল ওই প্রকল্পের আওতায় কতজনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো সেই সংখ্যায় পরিমাপ করা হয়ে থাকে। প্রকল্পের প্রকৃত প্রভাব বা সুবিধা পরিমাপ করা হয় না। এর পাশাপাশি বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার এবং সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব তো রয়েছেই।
আরেকটি বিষয় আমি লক্ষ্য করেছি, যেটি প্রকল্প ফলপ্রসূ হওয়ার পথে অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। সেটি হলো, যখন প্রকল্পটি দাতা সংস্থা পরিচালনা করে এবং সেখানে তাদের অগ্রাধিকার প্রাধান্য পায়। কেন দাতা সংস্থা এটা করে, তা আমাদের বোধগম্য। কারখানার মালিক, ব্যবস্থাপক, স্থানীয় ইউনিয়ন এবং স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে কোন কোন বিষয় নিয়ে আমাদের কাজ করা উচিৎ, তা কি আমরা নির্ধারণ করতে পারি না? দাতা সংস্থার প্রকল্পের সঙ্গে যদি স্থানীয় স্টেকহোল্ডারদের যথার্থ সম্পৃক্ততা না থাকে, তাহলে তার প্রতি তাদের আগ্রহ কমে যাবে। সেক্ষেত্রে দাতার অর্থায়ন বিফলে যাওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যায়।
আমার অভিজ্ঞতায় বলে, আরেকটি বিষয় এ ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করতে পারে। সেটি হলো— যে সব খাতে প্রকল্প নেওয়া হবে, দাতাদের মধ্যে সেসব খাতভিত্তিক যথার্থ জ্ঞানের অভাব। কাজেই এ বিষয়ে দাতাদের উচিৎ স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের ওপর নির্ভর করা, যারা কোথায় অর্থায়ন করতে হবে এবং কীভাবে তা বাস্তবায়ন করতে হবে সে ব্যাপারে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারেন।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও প্রকল্পের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। দেশের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্পের অনন্য অবদান রয়েছে। দাতা সংস্থাগুলোরও এ খাতের প্রতি আগ্রহ রয়েছে। সেই বিবেচনায় এই শিল্প সংশ্লিষ্ট সব প্রকল্পের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি বিশেষ সমন্বয় সেল বা ইউনিট চালু করা যেতে পারে। পোশাক শিল্প সংক্রান্ত যেকোনো প্রকল্প এই সেলের মধ্য দিয়ে নেওয়া হবে এবং দাতা সংস্থার অর্থায়নের কাজটি সমন্বয় করা হবে।
এর মাধ্যমে একই ধরণের একাধিক প্রকল্প গ্রহণ বন্ধ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। প্রকল্পের কাজ সমন্বয়, প্রয়োজনীয় কার্যাবলী চিহ্নিত করা এবং প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য সম্ভাব্য দাতা সংস্থা চিহ্নিত করার লক্ষ্যে এই সেল ডিজিটাল ডাটাবেস ব্যবহার করতে পারে।
এই সেলের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে শিল্প বিষয়ক বিশেষজ্ঞ, প্রধান দাতা সহায়তা প্রদানকারী দেশগুলোর দূতাবাসের প্রতিনিধি এবং বাণিজ্য সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ এর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা কাউন্সিল গঠন করা যেতে পারে। উপদেষ্টা কাউন্সিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সেই বিশেষ সেলের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করতে পারে। যেখানে তারা আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করবেন কোথায় এবং কোন প্রকল্পে অর্থায়ন প্রয়োজন। পাশাপাশি গৃহীত প্রকল্পগুলোর ফলপ্রসূতা যাচাই বাছাই করবেন।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তথা দাতা সংস্থা এবং উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যে সহযোগিতা বাংলাদেশ পেয়ে আসছে, তার জন্য বাংলাদেশ কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমাদের উন্নয়ন সহযোগীরা এ দেশের উন্নয়নকল্পে যে অর্থায়ন করছে তার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব।
মোস্তাফিজ উদ্দিন: ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments