শঙ্কার কারণ ইয়াবা পাচারের রৌমারী রুট

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম ও মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলা গত দুই বছরে বাংলাদেশে ইয়াবার নতুন প্রবেশপথ হয়ে উঠেছে। এসব ইয়াবা আসছে মিয়ানমার থেকে।

পুলিশ ও গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে, রৌমারী দিয়ে বাংলাদেশে ইয়াবার চালান পাঠানোর জন্য মাদক পাচারকারী চক্রগুলো মিজোরাম, মেঘালয় ও আসামকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।

জামালপুরের সদ্য সাবেক পুলিশ সুপার দেলোয়ার হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ২০১৯ সালের শুরুর দিকে জামালপুর জেলা পুলিশ ৫০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রথম এ রুট সম্পর্কে জানতে পারে। জামালপুর দিয়ে পাচারের সময় গত বছরের জুন পর্যন্ত আরও ৬৪ হাজার ৬০৫ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়।

দেলোয়ার হোসেন কয়েক সপ্তাহ আগে সিআইডিতে বদলি হয়েছেন। এর আগেই এসব তথ্য জানান তিনি।

পুলিশ জামালপুরে ৩৭ জন ইয়াবা চোরাকারবারিকেও গ্রেপ্তার করে, যাদের মধ্যে ২৪ জনের বাড়িই রৌমারীতে। তবে, গ্রেপ্তার হওয়া চোরাকারবারিরা বিস্তারিত কোনো তথ্য জানতেন না। তারা শুধু কার কাছ থেকে চালান পেয়েছে এবং কার কাছে এগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে— তা জানাতে পেরেছে।

কুড়িগ্রামের পার্শ্ববর্তী ও ভারতের মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী জামালপুরে ২০১৯ সালের আগে ইয়াবা জব্দের ঘটনা খুবই কম ছিল। পুলিশ সূত্র বলছে, গত বছর কক্সবাজারে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে পুলিশ চেকপোস্ট ও অভিযান কমে যাওয়ায় জামালপুরে ইয়াবা জব্দের ঘটনাও অনেক কমে যায়।

এক সময় মাদক চোরাকারবারের জন্যে কক্সবাজারের টেকনাফ সবচেয়ে সহজ রুট ছিল। কিন্তু, সেখানে কঠোর নজরদারি শুরু হওয়ায় পাচারকারী চক্রগুলো ২০১৮ সাল থেকে এ নতুন রুটে চালান আনতে শুরু করে বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সন্দেহ।

ইতোমধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অন্য তিনটি ইয়াবা চোরাচালানের পয়েন্ট— সিলেটের জকিগঞ্জ, সুনামগঞ্জের মধ্যনগর ও টেকেরঘাট এবং হবিগঞ্জের বল্লায় সতর্কতা বাড়িয়েছে। মিয়ানমার থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল হয়ে এসব পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবার চালান বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

রৌমারীতে কর্মরত গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, টেকনাফের পর রৌমারী উপজেলা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইয়াবা পাচার রুটে পরিণত হয়েছে।

নাম গোপন রাখার শর্তে তিনি বলেন,  ‘রৌমারী নদী অঞ্চল হওয়ায় এ পয়েন্ট দিয়ে পাচার হওয়া ৯০ শতাংশ ইয়াবা নদী পথে ঢাকার বিভিন্ন স্থান ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়।’

সীমান্তের ওপারে

ইয়াবার চালান প্রথমে মিজোরামে প্রবেশ করে। সেখান থেকে গাড়ি, বাস বা মোটরবাইকে করে পাহাড়ি রাস্তা হয়ে মেঘালয় ও আসামে পৌঁছায় সেগুলো। তারপর কুড়িগ্রামের সীমান্তবর্তী মেঘালয়ের আমপাতি জেলা ও আসামের ধুবড়ী জেলায় পৌঁছানোর পর নদীপথে মূলত রৌমারী হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

ভারতের মাদক চোরাকারবারিরা কাঁটাতারের বেড়ার ওপর দিয়ে ইয়াবার প্যাকেট এদিকে ছুঁড়ে দেয়। তাদের বাংলাদেশি সহযোগীরা এগুলো সংগ্রহ করে।

সীমান্তের এক কিলোমিটারের মধ্যে ভারতীয় ও বাংলাদেশি— দুই দেশের সিমই কাজ করায়, চোরাকারবারিরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই যোগাযোগ করে বলে জানান গোয়েন্দা সংস্থার ওই কর্মকর্তা।

আরেকজন পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জামালপুরে গ্রেপ্তার হওয়া মাদক চোরাকারবারিরা স্বীকার করেছে যে সীমান্তে হাট চলাকালীনও এসব এলাকায় ইয়াবা হাতবদল হয়। কারণ, সীমান্ত তখন খোলা থাকে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, চোরাকারবারিরা হুন্ডির মাধ্যমে নগদ পাঠায়। অর্থ লেনদেনের একটি অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থা এটি।

তারপর চোরাকারবারিরা হয় নদীপথে, না হয় দেওয়ানগঞ্জ হয়ে জামালপুর শহরে ইয়াবা নিয়ে যায়। সেখান থেকে রাজধানীর বিভিন্ন গন্তব্যে যায় এগুলো।

পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, মিয়ানমার থেকে চালান কুড়িগ্রামের সীমান্ত অঞ্চলে পৌঁছাতে তিন থেকে চারদিন লেগে যায়। এরপরও সিন্ডিকেট সদস্যরা এ রুট বেছে নেওয়ার কারণ হলো, এ ক্ষেত্রে ‘ভারতের দিকে বড় কোনো চেকিং না হওয়ায়’ ঝুঁকি কম।

‘এ ছাড়া, রৌমারী রুট তুলনামূলক সাশ্রয়ী। কারণ, টেকনাফ দিয়ে চালান আনতে গেলে তাদেরকে বিভিন্ন পয়েন্টে মাদক চোরকারবারিদের টাকা দিতে হয়’, তারা জানান।

এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, রৌমারীর মাদক চোরাকারবার সিন্ডিকেটের কিছু সদস্যের কুড়িগ্রামের প্রভাবশালী এক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

রৌমারী সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা চোরাকারবারের বিষয়ে জানতে চাইলে ২২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনতাসির মামুন অবশ্য বলেন, চোরাচালানের এ জাতীয় কোনো ঘটনা তাদের নজরে আসেনি।

যদিও, গত বছরের মার্চে জামালপুর জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার এবং মেঘালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়মিত সভায় বাংলাদেশ পক্ষ এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।

‘আমরা আমাদের ভারতীয় সহযোগীদের ভারতে ইয়াবা চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছিলাম’, জামালপুরের সাবেক পুলিশ সুপার দেলোয়ার হোসেন বলেন।

পাশাপাশি, জেলা পুলিশ বিষয়টি পুলিশ সদর দপ্তরকেও জানিয়েছিল, যেন সেখানকার শীর্ষ কর্মকর্তারা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে উদ্বেগের বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন।

২০২০ সালে ভারত সফরকালে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ প্রতিবেশী দেশটির হাতে ১৮ জন ইয়াবা চোরাকারবারির তালিকা তুলে দেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যে।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম

Comments

The Daily Star  | English

Economic expectations: Did govt fall short?

When an interim government was sworn into office following the ouster of the Awami League regime just 100 days ago, there was an air of expectation that the Prof Muhammad Yunus-led administration would take steps to salvage a scam-ridden financial sector and rescue an ailing economy.

8h ago