নারায়ণগঞ্জে অগ্নিকাণ্ড

এখনও বোনের ফেরার অপেক্ষায় ঝুমা

নিখোঁজ শ্রমিক রিপনের মা নাজমা বেগম কাঁদছিলেন কারখানার সামনে। এইচএসসি শিক্ষার্থী রিপন কয়েক মাস আগে পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করতে কারখানায় কাজ শুরু করে। ছবি: আনিসুর রহমান

রাতে মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছিল ১৫ বছর বয়সী তুলি আক্তার। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তার মা মুরগি রান্না করে অপেক্ষা করছিলেন তুলি ফিরলে দুই মেয়েকে নিয়ে রাতের খাবার খাবেন। কিন্তু, তুলির আর বাড়ি ফেরা হয়নি।

গত বছর এসএসসি পাসের পর তুলি কাজ শুরু করে নারায়ণগঞ্জের ওই ফুড ফ্যাক্টরিতে।

তার বোন ঝুমা আক্তার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘তুলি মনে করত ফ্যাক্টরিতে কাজ করে কিছু টাকা জমাবে ভবিষ্যতের জন্য।’

নারায়ণগঞ্জের ওই ফুড ফ্যাক্টরির ভয়াবহ আগুনে নিহতদের মধ্য থেকে এখন পর্যন্ত তুলিকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। আগুনে পুড়ে যাওয়ার কারণে কাউকেই শনাক্ত করা যায়নি। তারপরও তুলির ফিরে আসার অপেক্ষায় আছেন বোন ঝুমা।

তিনি বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে, তুলি এখনো নিখোঁজ আছে।’

ঝুমা আশা করে বসে আছেন, তুলি হয়তো শিগগির ফিরে এসে তার বাড়ি না ফেরার কোনো এক অদ্ভুত গল্প হাজির করবে। তারপর মা-বোনকে নিয়ে নিজের পছন্দের তরকারি দিয়ে খেতে বসবেন।

নিখোঁজের যে তালিকা করা হয়েছে, সেখান থেকে এখন পর্যন্ত ৫১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ওই তালিকার বেশ বড় একটা অংশজুড়ে আছে কম বয়সী ছেলে-মেয়ে।

এরকম আরেকটি ঘটনার উদাহরণ হলো, ১৪ বছর বয়সী মিতু বেগম।

মিতু ও তার বড় বোন মিনা কাজ করতেন ওই ফুড ফ্যাক্টরিতে। গত বৃহস্পতিবার তাদের দুই বোনের একই সময়ে ডিউটি পড়ে।

মিতুর বাবা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ওইদিন হঠাৎ করে আমার বড় মেয়ের ডিউটির টাইম চেঞ্জ হয়ে যায়। এরপর সে যখন ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার জন্যে বের হচ্ছিল, তখন আগুন লাগার কথা শুনতে পারে।’

বিল্লাল হোসেন ওই ফ্যাক্টরির সামনে কান্নাকাটি করছিলেন আর এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছিলেন। মানুষজনকে জিজ্ঞেস করছিলেন, তার মেয়েকে কেউ দেখেছে কি না।

‘আমরা কী দোষ করেছি? পেটের দায়ে দুই মেয়ে ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। আমার মেয়েকে কেন মেরে ফেলা হলো?’, বলেন বিল্লাল হোসেন।

তুলি ও মিতুর মতো অনেক মেয়ে নারায়ণগঞ্জের ভুলতার হাশেম ফুডস লিমিটেডের ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, আগুন লাগার সময় ওই ফ্যাক্টরিতে অন্তত ৫০০ জন শ্রমিক কাজ করছিলেন। তাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।

সুজন মিয়া শুক্রবার সকাল থেকেই ফ্যাক্টরি এলাকায় এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছিলেন। তার মেয়ে ফাতেমা বেগমের ছবি হাতে নিয়ে তাকে খুঁজছিলেন। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ওই ভবনের চতুর্থ তলায় কাজ করছিল ১৩ বছর বয়সী ফাতেমা।

ফ্যাক্টরির সামনে থেকে সুজন মিয়া কাঁদতে কাঁদতে ডেইলি স্টারের প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার মেয়ে সন্ধ্যা ৭টার দিকে ফোন দিয়ে বলে “বাবা, আমি শ্বাস নিতে পারছি না... চারদিকে ধোঁয়ায় ভরে গেছে। সুপারভাইজার সিঁড়ির গেটে তালা দিয়ে রেখেছে।” এরপর আর কিছু শুনতে পারিনি।’

সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল হাসেমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সব দায় অস্বীকার করেন। এ ছাড়া, তিনি জানান, ফ্যাক্টরিতে কোনো শিশু শ্রমিক নেই।

ওই ফ্যাক্টরির প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সালাউদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের বয়স নিয়ে যেটা বলা হচ্ছে, সেটা ভুল। কাগজপত্র যাচাই করেই তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যদি কারও বয়স কম হয়, তাহলে সেটা তারা নিজেরা ঘষেমেজে তৈরি করে এনেছে।’

প্রত্যক্ষদর্শী ও জীবিত উদ্ধার হওয়া কর্মীদের অভিযোগ, যদি কর্তৃপক্ষ দ্রুত ব্যবস্থা নিত এবং চতুর্থ তলা তালাবন্ধ না থাকত, তাহলে অনেক কর্মী বেঁচে যেতেন। আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার কর্মীরা জীবন বাঁচাতে জানালা দিয়ে লাফ দেন।

ফ্যাক্টরি ভবনের কাছে তিনটি কাভার্ড ভ্যান রাখা ছিল। কর্মীরা আগুন থেকে বাঁচতে কাভার্ড ভ্যানের ওপর লাফিয়ে পড়েন এরপর সেখান থেকে মাটিতে নামেন।

শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে ইউএস-বাংলা হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, সেখানে আগুন থেকে বেঁচে যাওয়া ছয় জন চিকিৎসা নিচ্ছেন।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে তারা প্রায় ৩০ জনের চিকিৎসা দিয়েছেন। বর্তমানে ছয় জন সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন, বাকিদের ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ওই ফ্যাক্টরির ১৫ বছর বয়সী কর্মচারী রোজিনা ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সবাই আগুন আগুন বলে চিৎকার শুরু করে। আমি সিঁড়ির কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখি সেখানেও আগুন। এরপর জানালার পাশে দাঁড়াই, তখন কেউ একজন আমাকে পেছন থেকে ধাক্কা দিলে কাভার্ড ভ্যানের ওপর গিয়ে পড়ি। এরপর হামাগুড়ি দিয়ে মাটিতে নামি।’

আঘাত পেয়ে পা ভেঙে গেছে রোজিনার। হাসপাতালে সেটার চিকিৎসা চলছে। এ ছাড়া, তার থুতনিতেও আঘাত লেগেছে।

১৩ বছর বয়সী মারিয়াও লাফ দেন ওই ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে।

৪০ বছর বয়সী মনোয়ারা বেগম সে সময় হাসপাতালের বেডে শুয়ে ব্যথায় চিৎকার করছিলেন। বলেন, ‘আগুন ছড়িয়ে পড়ার পরও কেউ জানায়নি যে, ওই বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছে। সিঁড়ির দিক দিয়ে ঘন ধোঁয়া আসছিল। এরপর আমি দুই তলা থেকে তিন তলায় যাই, সেখান থেকে ঝাপ দিই।’

১৪ বছর বয়সী রুমা বেগমও ফ্যাক্টরির তিন তলা থেকে লাফ দেন। তার বয়সী সোমাও ঝাপ দিয়েছিলেন দুই তলা থেকে। তারও চিকিৎসা চলছে হাসপাতালে।

এই প্রতিবেদক হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পথে বেঁচে ফেরা একজনের মা বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। পেটের দায়ে মেয়েকে ওই ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে পাঠিয়েছিলাম। এসব অবুঝ বাচ্চাদের কাজে পাঠাতেও কষ্ট লাগে। কিন্তু, কিছুই করার নেই। এখন আমরা সবই হারালাম।’

আরেক অভিভাবক বলেন, ‘স্যার, এসব নিষ্পাপ বাচ্চাদের জন্যে কিছু একটা করেন। কাজে পাঠিয়ে আমরা তাদের স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছি। এখন তাদের বেঁচে থাকার আশাও নষ্ট হয়ে গেল। তাদের সাহায্য করেন।’

Comments

The Daily Star  | English

MRT-1 unlikely to be ready before 2030

Five years have passed since the country’s first underground metro rail project was approved, but construction of the key structure has not yet begun.

8h ago