আশুলিয়া থেকে রূপগঞ্জ: তদারককারীরা সবসময় ঘুমিয়ে

এসব পোড়া লাশের দায় কার

অগ্নিকাণ্ডের পর কারখানা থেকে মরদেহ বের করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

নিশ্চিন্তপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে উপস্থিত সবার মধ্যেই সেদিন ছিল আহাজারি আর চরম অনিশ্চয়তা। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন কারখানায় আগুনে ১১১ জন শ্রমিক পুড়ে অঙ্গার হয়ে গিয়েছিলেন। পরে সেই লাশগুলো উদ্ধার করে স্কুল মাঠে সারি সারি করে রাখা হয়। অবশ্য লাশ না কঙ্কাল, বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল। এর মধ্যেই পরম মমতায় ব্যাগে মোড়ানো একেকটি মৃতদেহ ছুঁয়ে চেনার চেষ্টা করছিলেন স্বজনেরা।

পুড়ে যাওয়া এমনি একটি কঙ্কালসম শরীরের কানে সোনার দুল দেখে চিৎকার করে উঠেছিলেন রাজবাড়ির মোহাম্মদ শোয়েব। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেছিলেন, এটাই তার স্ত্রী শিউলির লাশ। সোনার এই দুলটা তিনি স্ত্রীকে কিনে দিয়েছিলেন। আর সেই দুল দেখেই স্ত্রীর মরদেহ পেলেন। তবে, তার পাশে থাকা রংপুরের মিঠাপুকুরের নুরজাহান বেগম পোড়া লাশগুলো থেকে তার বোনকে আলাদা করতে পারেননি। স্কুলমাঠে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বলছিলেন, ‘এত লাশ, হামার ছোট বোইন ববিতার লাশ কোনঠে?’

ঘটনার নয় বছর পেরিয়ে গেলেও শোয়েব-নুরজাহানদের সেই আহাজারি কানে বাজে। আগুন লাগার খবর পেয়ে সাংবাদিক হিসেবে সেদিন ছুটে গিয়েছিলাম। আগুনে পুড়ে কোনো মৃত্যুর কথা শুনলেই আজও সেই আহাজারি কানে বাজে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানায় আগুনে পুড়ে অর্ধশত মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় সেই আহাজারি ফিরে এলো। মনে পড়ল পুড়ে যাওয়া শিউলির সেই দুলের কথা।

তাজরীন আর হাসেম বেভারেজের দৃশ্যগুলো প্রায় একইরকম। তাজরীন ভবন ছিল নয়তলা আর হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানাটি ছয়তলা। তাজরীন ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর তৃতীয় তলার মূল ফটকে তালা মেরে দেওয়া হয়। এর ফলে সেখান থেকে লোকজন বের হতে পারেননি। একই ঘটনা ঘটেছে রূপগঞ্জেও।

তাজরীনের আগুন লেগেছিল সন্ধ্যায়, জ্বলেছিল রাতভর। রূপগঞ্জেও। দুই ঘটনাতেই রাত পেরিয়ে সকাল হয়েছে। স্বজনদের অপেক্ষার পরিণতি—আগুনে দগ্ধ পুড়ে যাওয়া মাংসপিণ্ড আর কঙ্কাল। তাজরীন অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৫৮টি লাশ কোনোভাবেই চিহ্নিত করা যাচ্ছিল না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেগুলোর ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। এবারও সেই ডিএনও প্রক্রিয়া চলছে। তাজরীনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় ত্রুটি ছিল এবং জরুরি নির্গমন পথ না থাকার কারণেই প্রাণহানি বেশি হয়েছিল বলে জানিয়েছির ফায়ার সার্ভিস। এবারও প্রায় একইরকম কথা শোনা যাচ্ছে।

তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড ছিল তোবা গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। ঘটনার দুদিন পর প্রতিষ্ঠানের মালিক দেলোয়ার হোসেন বলেছিলেন, আগুন লাগানোর দায় তার নয়। রূপগঞ্জে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির মালিক সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল হাসেমও বলছেন, এই ঘটনার দায় তার নয়। তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আশুলিয়া থানায় একটা মামলা হলেও কোনো ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্ট করে আসামি করা হয়নি। পুলিশ বলেছিল, তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর অভিযুক্তদের আসামি করা হবে। কিন্তু, সেই ঘটনার বিচার আর হয়নি। এবার কী ঘটবে দেখার অপেক্ষা।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, রূপগঞ্জের ওই ভবনে প্রচুর প্লাস্টিক, কেমিক্যাল, কার্টনসহ প্রচুর দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন ভয়াবহ হয়ে উঠে। কিন্তু, এই ধরনের ঘটনা তো দেশে প্রথম ঘটছে না। এই যে বারবার ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগে, গরিব মানুষ মারা যায়, কারো কি কোনো দায় নেই?

২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে আগুন লাগে। এই ঘটনায় ১২৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এরপর পুরান ঢাকা থেকে বিপজ্জনক রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থের গুদাম সরিয়ে নেওয়ার দাবি উঠেছিল।

এই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির বিশেষজ্ঞরা যে ১৭টি সুপারিশ পেশ করেছিলেন, সেগুলোর প্রথমেই ছিল বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের গুদাম ও কারখানাগুলো সরিয়ে নেওয়া। বাকি ১৬টি সুপারিশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল শিল্প মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের ওপর। কিন্তু, সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের কোনো অগ্রগতি নেই বললেই চলে।

নিমতলীর সেই ঘটনায় বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি হয়েছিল। সেই ঘটনার কোনো বিচার হয়নি। এরপর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ঘটে ভয়ানক আরেক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা৷ এতে ৭৮ জন প্রাণ হারায়। কারণ সেই রাসায়নিক। এই ঘটনারও বিচার হয়নি।

২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর ২২তলা ভবন এফআর টাওয়ারে আগুন লাগে। এতে ২৬ জনের মৃত্যু হয়৷ এই ঘটনার পর জানা যায়, এফআর টাওয়ার রাজউক থেকে ১৮তলার নকশার অনুমোদন নিয়ে ২৩তলা করা হয়৷ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরে নকশার এই অনিয়ম নিয়ে মামলা হয়৷ যা এখনো চলছে৷ কিন্তু, কথা হলো নকশা অনুমোদন ছাড়া এই শহরে একটা ভবন হলো কর্তৃপক্ষ কী দেখেনি?

২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর টাম্পাকো ফয়েলস কারখানার অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ৪১ জন। ঘটনার পর জানা যায়, এই কারখানা ভবনে যথাযথ সিঁড়িই ছিল না। আরও জানা যায়, ইমরাত নির্মাণের যে লে-আউটের অনুমোদন নিয়েছিল, তা তারা বাস্তবে অনুসরণ করেনি। ঘটনার পর আরও নানা অনিয়মের কথা শোনা যায়। অথচ বিসিক শিল্প এলাকার ভেতরেই ছিল এই কারখানা। কিন্তু, কেউ যেন কিছু দেখেনি।

২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর ঢাকার অদূরে কেরাণীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি প্লাস্টিক কারখানায় আগুন লাগলে ১৩ জন মারা যান। এরপর জানা যায়, আগুন লাগার পর শ্রমিকরা তাৎক্ষণিক বের হতে পারেননি। পরে জানা যায়, কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই চলছিল কারখানাটি। না পরিবেশগত ছাড়পত্র, না আগুন নেভানোর সক্ষমতা, কিছুই ছিল না। অথচ কোনোদিন সেখানে কোনো অভিযান হয়নি।

একই ধরনের ঘটনা শোনা গিয়েছিল রানা প্লাজার পরেও। এ যেন এক বিস্ময়কর ঘটনা! প্রতিবারই ঘটনা ঘটার পর জানা যায়, নানা ধরনের ত্রুটি ছিল। অনুমোদন ছিল না। আগুন নেভানোর যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিল না। বছরের পর বছর ধরে যেন একই গল্প। অথচ একটা ভবন বা কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে সরকারি বহু দপ্তর থেকে অনুমোদন নিতে হয়। শুধু অনুমোদনেই শেষ না। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরসহ সরকারের নানা দপ্তর আছে যাদের কাজ নিয়মিত এগুলো তদারকি করা। কিন্তু, প্রত্যেকটা দুর্ঘটনার পর একই কথা। তদারককারীরা সবাই যেন ঘুমাচ্ছিল!

নারায়ণগঞ্জের এই কারখানায় নিহত অনেকে ছিল শিশু-কিশোরী, যাদের বয়স ছিল ১৮ বছরের নিচে। এগুলোও যেন দেখার কেউ ছিল না। অবশ্য অগ্নিকাণ্ডের পর এখন পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, বরাবরই যেমন হয়। আগামী কয়েকদিন এখন তদন্ত হবে, বহু আলোচনা হবে, জানা যাবে বহুকিছু। তারপর আবার সব হারিয়ে যাবে। এরপর আবার একই দুর্ঘটনা ঘটবে। একই গল্প শোনা যাবে। তখন জানা যাবে বহুকিছু।

বড়ই বিস্ময়কর! এই দেশে লঞ্চ ডুবলে ঘটনার পর জানা যায় লঞ্চের অনুমোদন নেই। ভবনে আগুন লাগলে জানা যায় অনুমোদন নেই। গাড়ি দুর্ঘটনার পর জানা যায় ফিটনেস নেই। অথচ তদারকের দায়িত্বে থাকা নানা কর্তৃপক্ষ আছে! কিন্তু, মানুষ মরে যাওয়ার আগে কারো হুঁশ হয় না। ফলে বারবার বাবার কাঁধে ওঠে সন্তানের লাশ, সন্তানের কাঁধে বাবার। ভাই নিয়ে যাবে বোনের লাশ, বোন অপেক্ষা করবে ভাইয়ের লাশের। প্রতিটা ঘটনার পর শোনা যাবে এমন আহাজারি, ‘ও স্যার, আমার মায়ের হাড্ডিগুলা খুইজ্জা দেন স্যার।’

শরিফুল হাসান: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

shariful06du@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English