স্বীকৃতির প্রত্যাশা নয়, কর্তব্যবোধই ছিল যার চালিকাশক্তি
মহিউদ্দিন আহমেদকে প্রচলিত পরিচয়ে দেশের প্রথিতযশা প্রকাশনা সংস্থা ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেই অধিকাংশ মানুষ চেনেন। তবে, সেটি তার সীমিত পরিচয়। তার পরিচয় ও অবদান কেবল এই সীমিত পরিসরে বিবেচনা করলে তা হবে অসম্পূর্ণ। মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের পথিকৃৎ ও মহীরুহ— এটাই হচ্ছে তার পরিচয়।
মহিউদ্দিন আহমেদের জীবনাবসানের সংবাদ আমার কাছে অবিশ্বাস্য বলেই মনে হয়। সোমবার দিনগত রাতে ৭৭ বছর বয়সে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘ অসুস্থতা সত্ত্বেও অপরিমেয় প্রাণশক্তি দিয়ে তিনি তা মোকাবিলা করেছেন। পরিণত বয়স বা অসুস্থতা আমাদেরকে মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত করে না। মহিউদ্দিন আহমেদের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি সত্যি। যে ক্ষতি অপূরণীয়, তাকে গ্রহণ করার মতো কোনো শক্তি আমরা কেউ কখনোই অর্জন করি না।
যাদের ছায়া দীর্ঘ, যাদের কাজ একটি ক্ষেত্রকে আমূল বদলে দিয়েছে, তাদের জীবনাবসানের সংবাদ আমাদেরকে কেবল বেদনাহতই করে না, আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় তাদের কাজ কী করে অন্যদের জীবনকে বদলে দিয়েছে। যাদের কাজ অন্যদের সৃজনশীলতা ও গবেষণাকে বদলে দিয়েছে, তাদের অনুপস্থিতি স্মরণ করিয়ে দেয় তারা কতটা প্রয়োজনীয় ছিলেন।
মহিউদ্দিন আহমেদের পরিচয় আমার কাছে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন গবেষণার ক্ষেত্রকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে নিবেদিত একজন মানুষ হিসেবে। বাংলাদেশে বাংলাদেশ বিষয়ে যেসব কাজ হচ্ছে, তার সঙ্গে বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, একইসঙ্গে সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ বিষয়ে যে সব গবেষণা হচ্ছে, তাকে বাংলাদেশের পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া— এটাই তিনি করেছেন সারা জীবন ধরে। এক বাক্যে যত সহজে তা লেখা যায়, সেই কাজ করা যে কতটা কঠিন, সেটা কেবল তার কাজের প্রভাব থেকেই উপলব্ধি করা সম্ভব। ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে একাগ্র চিত্তে তিনি তাই করেছেন। বৈষয়িক সাফল্য নয়, স্বীকৃতির প্রত্যাশা নয়— ভালোবাসা ও কর্তব্যবোধই ছিল তার চালিকাশক্তি।
অন্তরালের মানুষ ছিলেন তিনি, মৃদুকণ্ঠ। কিন্তু, তাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প ও মানসম্পন্ন প্রকাশনার ইতিহাস রচনা করা যাবে না। তিনি থাকবেন এই ইতিহাসের কেন্দ্রে। এটি তিনি অর্জন করেছেন, মেধা দিয়ে, শ্রম দিয়ে, সর্বোপরি উত্তরসূরিদের জন্যে পথ নির্মাণের মধ্য দিয়ে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের যে পরিচিতি, তার সিংহভাগ যে তারই প্রাপ্য, প্রকাশনার জগতের সঙ্গে যারা যুক্ত তারা তা অকুণ্ঠচিত্তে উল্লেখ করেন। কেননা মহিউদ্দিন আহমেদ সেই কাজটির সূচনা করেছেন বলেই এখন বাংলাদেশের বই আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এইখানেই তিনি স্বমহিমায় উদ্ভাসিত।
সাংবাদিকতা দিয়ে তার জীবনের সূচনা হয়েছিল। স্থায়ীভাবে অ্যাকাডেমিক জগতে প্রবেশের ডাক এসেছিলো তার, যখন তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিতে ভর্তির সুযোগ পান। কিন্তু, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের (ওইউপি) প্রকাশনা ও সম্পাদনা তাকে বেশি আকর্ষণ করেছিল, সেটা ১৯৬৯ সাল। এক সময় সাংবাদিকতার পাশাপাশি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতাও করেছিলেন। ১৯৯৭/৯৮ সালে লন্ডনে মহিউদ্দিন আহমেদ আমাকে তার জীবনের এই পর্বের কথা বললে আমার স্বতস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া ছিল যে— ভাগ্যিস আপনি পিএইচডি না করে ওইউপির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। তার স্বভাবসিদ্ধ হাসিতে উজ্জ্বল মুখে বলেছিলেন— ‘আমিও তাই ভাবি’। তারপরে আরও কথা হয়েছিল। কী করে ১৯৭৫ সালে ইউপিএল প্রতিষ্ঠা পেল, সেসব গল্প।
বাংলাদেশে গবেষণা-ভিত্তিক ইংরেজি বইয়ের প্রকাশনার যে ধারা তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা কি অন্য আর কারও হাতে তৈরি হতে পারত? যে সময়ে তিনি প্রকাশনার জগতের জন্যে নিজেকে নিবেদন করলেন, যেভাবে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন, তা কেবল ধৈর্য, নিষ্ঠা আর ভালোবাসা দিয়েই সম্ভব। যে দেশে প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে না, যেখানে প্রতিষ্ঠানের অকাল মৃত্যুই ভবিতব্য বলে বিবেচিত, সেখানে মহিউদ্দিন আহমেদ তৈরি করেছেন এমন প্রতিষ্ঠান, যা নিয়ে বাংলাদেশ গর্ব করতে পারে। তিনি কেবল যে প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন, তা নয়, আসলে তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন প্রতিষ্ঠান।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো ও আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট
আরও পড়ুন:
Comments