১৭ জুন ১৯৭১: জগদীশপুর গণহত্যা
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৭ জুন গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাঈদ চৌধুরীকে ব্রিটেনে বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি পত্র ব্রিটেনের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের বাসভবন বাকিংহাম প্যালেসে পাঠানো হয়। আরেকটি পত্র ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে গিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের কাছে তুলে দেওয়া হয়।
১৭ জুন পাকিস্তান সরকার এক বিবৃতিতে বলে, 'ভারতীয় সেনাবাহিনী আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে বিনা উস্কানিতে মর্টার ও মেশিন গানের গোলাবর্ষণ চালিয়ে অসংখ্য বেসামরিক লোককে হত্যা করেছে। কুমিল্লা, যশোর, রংপুর, রাজশাহীর সীমান্তবর্তী এলাকায় এসব ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। ভারতের সেনাবাহিনী যদি তাদের এসব উসকানিমূলক কার্যক্রম চলমান রাখে তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী চরম পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।'
আন্তর্জাতিক মহলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিবৃতি
১৭ জুন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং শরণার্থী সমস্যা নিয়ে ওয়াশিংটনে মার্কিন কর্মকর্তার সাথে বৈঠকে বসেন। এদিন সরদার শরণ সিং ওয়াশিংটন প্রেসক্লাবে এক বক্তৃতায় বলেন, 'আমি আপনাদের নেতাদের সঙ্গে একটি সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য এখানে এসেছি। সমস্যাটি প্রেসে ইতোমধ্যে বিশদভাবে রিপোর্ট করা হয়েছে। নিশ্চয়ই আমেরিকান প্রেস জনমত গঠনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পূর্ববাংলার ট্র্যাজেডি আজ ভারতের জন্য বড় সমস্যা। এশিয়া জুড়েও এটি এখন গুরুত্বপূর্ণ। পূর্ববাংলার ঘটনাবলীর ধরন ও মাত্রা এমন যে সেটি পাকিস্তানের সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে উদ্বেগের বিষয় হতে বাধ্য।'
তিনি একই সঙ্গে শরণার্থী সমস্যা নিয়ে বলেন, 'প্রতিটি দিন প্রায় ১ লাখ মানুষ আমাদের দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে পূর্ববাংলার সীমান্তজুড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে। সহজ করে বললে প্রতি সেকেন্ডে একজন শরণার্থী আমাদের দেশে প্রবেশ করছে। আমরা উদ্বাস্তুদের আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ত্রাণ দিচ্ছি। আমাদের স্বাস্থ্যসেবা সীমিত এবং সেখানে পরিবহন ও তাঁবু, খাদ্য ও ওষুধ এবং অন্যান্য সম্পদ সঙ্কট আছে। আমরা সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বিশেষ করে যেসব দেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালো তাদের অনুরোধ করছি একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পাকিস্তান সরকারকে প্রভাবিত করতে। আমরা যতদিন না একটি রাজনৈতিক সমাধান আসে ততদিন পাকিস্তানে তাদের মিলিটারি ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করার ব্যাপারে সব দেশের প্রতি আহ্বান করছি। আমি আশা করি যে, এই দেশের মানুষ বুঝতে পারবে কেন আমরা পূর্ববাংলার পরিস্থিতির ওপর আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছি। ২৫ মার্চ থেকে পূর্ববাংলায় যে হত্যাকাণ্ড হচ্ছে তার ফলাফল আমাদেরও প্রভাবিত করছে।'
১৭ জুন জাতিসংঘের এক মুখপাত্র বলেন, 'কলকাতা থেকে পাকিস্তানি কূটনীতিক ও ঢাকা থেকে ভারতীয় কূটনীতিকদের নিজ নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়টি পাকিস্তান মেনে নিয়েছে।' এর আগে জাতিসংঘ মহাসচিব এই প্রতিকূল পরিস্থিতির অবসানে এই অনুরোধ করেছিলেন। অন্যদিকে ঢাকায় ভারতীয় কূটনীতিকদের পাকিস্তান আটক করে রেখেছে বলে ভারত সরকার জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে দাবি করেছিলেন। এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের মহাসচিব জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধিকে ডেকে পাঠান এবং ঘটনার বিস্তারিত জানতে চান।
১৭ জুন মার্কিন প্রতিনিধি সভার এশিয়া বিষয়ক সাব কমিটির চেয়ারম্যান কর্নেলিয়াস গ্যালাঘার পাকিস্তানকে সবরকম সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ার জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব আনেন। মার্কিন সিনেটেও এ ধরনের একটি প্রস্তাব আনা হয়েছে।
১৭ জুন সুইডেন, হল্যান্ড, ইতালি, অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরিসহ কয়েকটি দেশ ঐক্যমত প্রকাশ করে বলে, 'পাকিস্তান পূর্ব বাংলার উপর একতরফাভাবে কোনো সমাধান চাপিয়ে দিতে পারে না। ইউরোপের এসব দেশ তাদের মিত্র দেশসমূহের সঙ্গে একত্রে মিলে ইয়াহিয়া সরকারকে তাদের এই মনোভাব জানিয়ে দেবে।'
১৭ জুন পূর্ব পাকিস্তান সফররত ৩ সদস্যের ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি দলের সদস্য ব্রিটিশ এমপি জেমস টিন বলেন, ‘ব্রিটিশ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ভারতের একতরফা প্রচারের কারণেই বিদেশি পত্রিকায় সঠিক খবর প্রকাশিত হচ্ছে না।’
দলের আরেক সদস্য মিসেস নাইট বলেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী দুষ্কৃতকারী দমনে অত্যন্ত দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে এই নির্মমতার দরকার ছিল।”
১৭ জুন যুগোশ্লাভ পররাষ্ট্র দফতরের এক মুখপাত্র বলেন, 'শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব একমাত্র পাকিস্তান সরকারের। পাকিস্তান সরকারের কারণেই আজ প্রায় ৬০ লাখ বাঙালী গৃহহীন উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে।'
ভারতে এদিন
১৭ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দিল্লিতে তার কার্যালয়ে দেখা করেন ভারতের শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রের অর্থনীতিবিষয়ক সম্পাদকেরা। এসময় ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ভারত প্রথম থেকেই পূর্ববঙ্গের সঙ্গে আছে। ভারত বহুবার চেষ্টা করেছে পূর্ববঙ্গে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু প্রথমে বিশ্বের পরাশক্তিরা পাত্তাই দিতে চায়নি পূর্ববঙ্গের অবস্থা নিয়ে। ভারত এখনো রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর পূর্ববঙ্গের অবস্থা যদি স্বাভাবিক হয়ে যায় তবে শরণার্থীদের দেশে পাঠাতে আর কোনো দেরি করবে না ভারত।
১৭ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খাঁ। এসময় ইন্দিরা গান্ধী প্রিন্স আগা খাঁকে শরণার্থীদের অবস্থা সম্পর্কে জানান, একই সঙ্গে ভারতের অবস্থান জানিয়ে দেন। তিনি একই সঙ্গে গণহত্যা বন্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের কড়া পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ
১৭ জুন লন্ডন থেকে প্রকাশিত দ্য স্টেটসম্যানের এক খবরে বলে, '১২০ জন লেবার দলীয় এমপি গত রাতে হাউস অব কমন্স সভায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বীকৃতি দানের দাবি জানিয়েছেন।'
১৭ জুন গায়ানা ইভনিং পোস্ট এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলে, 'ছয় কোটি মানুষের উপর চালানো পৈশাচিকতা ও নির্মমতার ফলে ভারতের জনগণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে মারাত্মকভাবে প্রভাব সৃষ্টি করেছে, কিন্তু মানবতার কারণে এই ছাড় দিতে হবে। মিসেস গান্ধীর মতে, বিশ্বের অন্য কোনো দেশে এই মাত্রার অনুপ্রবেশ ঘটেনি। এমনকি এর দশ ভাগের এক ভাগও না। কিন্তু, মিসেস গান্ধী বলেন, শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য ভারত প্রয়োজনবোধে ‘জাহান্নামের মধ্য দিয়ে যাবে’। কিন্তু স্পষ্টতই, এই অবস্থা কেবলমাত্র ভারতকে উদ্বিগ্ন করার কথা না। পুরো বিশ্বের সহায়তা প্রয়োজন। সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন খাদ্য, আশ্রয় ও ওষুধ। গায়ানার জনগণ তহবিল সংগ্রহ করতে পারেন। ভারতের এই সঙ্কটের মধ্যে গায়ানার এগিয়ে আসা উচিত। গায়ানা নিজেই একটি দরিদ্র দেশ কিন্তু ভারত যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে তাতে গায়ানার মানুষকে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে এবং গায়ানার মানুষ জানে কীভাবে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।'
১৭ জুন নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, 'যতক্ষণ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান গণহত্যা বন্ধ না করবে এবং সুষ্ঠু রাজনৈতিক সমাধানে না আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত পাকিস্তানকে দেওয়া সমস্ত মার্কিন সাহায্য বন্ধ করা হোক।' একই সঙ্গে পূর্ববঙ্গের জন্য দেওয়া সাহায্য পূর্ববঙ্গে আদৌ পৌঁছাচ্ছে কিনা সে বিষয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা হয় এই সম্পাদকীয়তে।
দেশব্যাপী গণহত্যা ও প্রতিরোধ যুদ্ধ
জগদীশপুর গণহত্যা
১৭ জুন সকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজাকার ও শান্তিবাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় ঝালকাঠির জগদীশপুর, খাজুরা, রামপুর, মিরাখালি ও বেতরা গ্রামে পেয়ারা বাগানে প্রাণের ভয়ে আশ্রয় নেয়া হিন্দু ধর্মালম্বীদের আটক করে তাদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালায়। পরে জগদীশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠের পাশে এনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে। এই গণহত্যায় শহীদ হন প্রায় ৬০ জন নিরীহ মানুষ।
১৭ জুন টাঙ্গাইলের বাসাইল থানার পশ্চিমে কামুটিয়া নর্থখোলা খেয়া পারে হানাদার বাহিনীর সাথে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে হানাদার বাহিনীর ৫ জন সৈন্য নিহত হয়।
১৭ জুন পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি ও মর্টারসহ চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনীর চাঁদগাজী ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়। হানাদারদের এ ব্যাপক হামলা ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা, ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী প্রতিআক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কিছু ক্ষতি হলেও হানাদার বাহিনীর ৪৫ জন সৈন্য নিহত হয় এবং হানাদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়।
১৭ জুন ফেনীর পরশুরামের বিলোনিয়াতে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটির ওপর হানাদার বাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালায়। প্রথম অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার সেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হলেও পরবর্তীতে বিমান বাহিনীর সহায়তায় হানাদার সেনারা আক্রমণ অব্যাহত রাখলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে চিথলিয়া গ্রামে চলে এসে সেখানে অবস্থান নেয়।
১৭ জুন দিনাজপুর জেলার ঠনঠনিয়াপাড়ায় হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণের উদ্দেশ্যে মুক্তিবাহিনী অগ্রসর হয়। কোম্পানির দুটি কলামে বিভক্ত হয়ে একটি কলাম সম্মুখভাগ আক্রমণের জন্য মেজর নাজমুল হকের নেতৃত্বে এবং অপর কলাম সুবেদার মেজর এ রবের নেতৃত্বে বিরল-ঠনঠনিয়া সড়কের ১৫০ গজ বামে ‘কাট অফ’ পার্টি হিসেবে প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করে।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র অষ্টম, নবম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড
দৈনিক পাকিস্তান ১৮ জুন ১৯৭১
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ১৮ জুন ১৯৭১
আহমাদ ইশতিয়াক
ahmadistiak1952@gmail.com
Comments