১৬ জুন ১৯৭১: বাংলাদেশ প্রশ্নের রাজনৈতিক মীমাংসা চাই: ইন্দিরা গান্ধী
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৬ জুন গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রাজ্যসভায় বলেন, 'আমরা অবশ্যই বাংলাদেশ প্রশ্নের রাজনৈতিক মীমাংসা চাই, তবে বাংলাদেশের কবর রচনা করার কিংবা গণতন্ত্র ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যারা লড়াই করছে তাদের থেকে নিষ্ক্রিয় করার অধিকার আমাদের নেই। ভারত সে ধরনের মীমাংসার আশাও করে না। আমরা শরণার্থীদের সীমান্তের ওপারে বর্বরতার মুখে ঠেলে দিতে পারি না, যেখান থেকে প্রাণভয়ে তারা সীমান্ত অতিক্রম করে আমাদের দেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন।'
১৬ জুন দৈনিক কালান্তর পত্রিকা তাদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলে, 'পাক সামরিক চক্র বাংলাদেশে জাতিগত হত্যার ঘৃণ্য অপরাধ চাপা দেয়ার জন্য ইসলামিক দেশ বিপন্ন বলে যে ধুয়া তুলেছে তা আরব দেশের জনগণকে প্রতারিত করতে পারবে না বলে এখানে আরব দেশের ৫টি যুব সংস্থা এক যুক্ত বিবৃতি প্রচার করেছে। আরব দুনিয়া থেকে বাংলাদেশের জনগণের ওপর ইয়াহিয়ার আক্রমণের প্রতিবাদে এই প্রথম বিবৃতি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চমকপ্রদ জয় বর্ণনা করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে প্রশাসনিক দায়িত্ব তুলে দেওয়ার এবং জনগণের রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পরিবর্তে পশ্চিম পাকিস্তানের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের অনুরোধে ইয়াহিয়া বাংলাদেশের ওপর জাতিগত হত্যা শুরু করেছে। বাংলাদেশের জনগণের ওপর গণহত্যা এবং ইয়াহিয়ার সামরিক বর্বরতা দেশের ঐক্যের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে। বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামরত যুবকদের প্রতি সমর্থন জানানোর জন্য সংহতিমূলক প্রচার সংগঠিত করার এবং সামরিক শাসকের জাতিগত হত্যার মুখোশ খুলে দেয়ার উদ্দেশ্যে আরব দেশের যুবকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ করার জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চাপ সৃষ্টি করতে হবে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। বিবৃতিতে সিরিয়ার ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ ইউনিয়ন, ইরাকের ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ ইউনিয়ন, ইয়েমেনের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের আসসালাফি যুব আন্দোলন, সুদানের যুব ইউনিয়ন, লেবানন ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ স্বাক্ষর করেছেন। জানা গেছে, যে জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের যুব সংস্থার সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে যোগদানের উদ্দেশ্যে আগত উপরোক্ত আরব যুব সংস্থার নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ভারতীয় যুব ফেডারেশন ও যুব কংগ্রেসের সর্বশ্রী যোগীন্দ্র সিং দয়াল ও জনার্দন সিং আলোচনার ফলশ্রুতি হিসেবেই বাংলাদেশ সম্পর্কে আরব দেশের যুব সমাজের পক্ষ থেকে ঐ মর্মে বিবৃতি দেয়া হয়েছে।'
আন্তর্জাতিক মহলে রাষ্ট্রীয় নেতাদের বিবৃতি
১৬ জুন কানাডার অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী মিজেল শার্প কমন্স সভায় বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের উদ্ভুত পরিস্থিতির রাজনৈতিক মীমাংসা ছাড়া শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টির সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। আর এই রাজনৈতিক মীমাংসার একমাত্র উপায় হচ্ছে পাকিস্তান বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।'
১৬ জুন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং শরণার্থী সংকট ও পূর্ববঙ্গের অবস্থা নিয়ে আলোচনার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সরদার শরণ সিং মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বলেন, 'পাকিস্তানের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে ভারত এখন মারাত্মক সংকটের মুখে, পূর্ববঙ্গের নেতাদের সঙ্গে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে রাজনৈতিক সমঝোতায় আসতে বাধ্য করা জরুরি। নয়তো পূর্ববঙ্গের অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে। ভারত শান্তিপূর্ণ সমাধানে বিশ্বাসী। কিন্তু বরাবরই পাকিস্তান নিজেদের পৈশাচিকতা বলবৎ রেখেছে। এখন যদি পূর্ণাঙ্গ সমাধান না আসে তবে ভারত যে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।'
১৬ জুন জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট এক বিবৃতিতে বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে আসা শরণার্থীদের সংকট এতটাই গুরুতর যে আমি আমার আফ্রিকান সংহতি সংস্থার সম্মেলন বাতিল করেছি। আমি আশা করি বিশ্ববাসী পূর্ববঙ্গের বিষয়টি ভেবে দেখবে। পূর্ব পাকিস্তানে এখনই জরুরিভিত্তিতে সহায়তা প্রয়োজন।'
১৬ জুন পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।'
১৬ জুন ব্রিটিশ কমন্স সভার ১২০ জনের বেশি সদস্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে এক মানবিক আবেদন করেন।
১৬ জুন ব্রিটেনের প্রবাসী বাঙালি নারীদের সংগঠন মহিলা সমিতির সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে প্রতিবাদ সভা করেন।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদিন মুক্তিযুদ্ধ
১৬ জুন প্রখ্যাত ব্রিটিশ সংবাদপত্র ডেইলি মিরর পত্রিকায় জন পিলজারের লেখা ‘একটি জাতির মৃত্যু’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনে জন পিলজার পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে বাংলাদেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন করে এই প্রতিবেদনটি লিখেছিলেন।
১৬ জুন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র প্রাভদা পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে নলা হয়, 'পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতের সীমান্ত এলাকায় অগণিত শরণার্থী এসে ভিড় করায় অবস্থা এখন গুরুতর। ভারত সীমান্ত এলাকা থেকে কিছু শরণার্থী স্বদেশে প্রত্যাবর্তনে রাজি।'
১৬ জুন টাইমস অফ ইন্ডিয়া তাদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলে, 'তামিলনাড়ু থেকে পশ্চিমবঙ্গ অনেক দূরে অবস্থিত হলেও বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের নজিরবিহীন প্রবাহ এখানেও অব্যাহত আছে। এখানকার মানুষও ইয়াহিয়া খানের হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। এখানকার স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার বিলম্বের কারণে ভারত সরকারের ওপর ক্ষোভ ঝেড়েছে স্থানীয় নেতারা।'
ভারতে এদিন
১৬ জুন জাতীয় পরিষদের সদস্য ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সংসদীয় প্রতিনিধি দলের নেতা ফণীভূষণ মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের মর্মান্তিক পরিস্থিতি এখানকার মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে তামিলনাড়ুতে আসেন। সফরের এক পর্যায়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'শরণার্থীদের এই প্রবাহ ভারতের সচিব পরিষদে উত্থাপিত হবে।'
১৬ জুন ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সুরেন্দ্রনাথ সিং রাজ্যসভার অধিবেশনে বলেন, 'পূর্ববঙ্গের শরণার্থী পরিস্থিতি ও গণহত্যা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গঠনে আমাদের ছয় মন্ত্রী শিগগিরই বিভিন্ন দেশ সফর করবেন। এদিকে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো আমাদেরকে আশ্বাস দিয়েছে তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গণহত্যা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমাদের জন্য শুভ সংবাদ হলো এই যে যে তিন জন মন্ত্রী এখন বিদেশ সফরে আছেন সবাই ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছেন। জাতিসংঘ ও শরণার্থীদের পক্ষে আছে।'
একই দিন একই অধিবেশনে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, 'ভারতের যে কোনো সীমান্ত আক্রান্ত হলেই তার উপযুক্ত জবাব দিতে ভারত প্রস্তুত আছে।'
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
১৬ জুন চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনীর চাঁদগাজী ঘাঁটির ওপর হানাদার সেনারা তীব্র আক্রমণ চালায়। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ চালালে হানাদারেরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ সংঘর্ষে পাকিস্তানি হানাদারদের ৫০ জন সৈন্য নিহত হয়।
১৬ জুন গোপালগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের কোদালধোয়া ঘাঁটির ওপর চারটি স্পিডবোটে করে এসে হানাদার বাহিনী আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনী তাদের প্রতিরোধ করলে দুপক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির মুখে হানাদার সেনারা পয়সারহাট থেকে আট মাইল দূরে পালায়। এ যুদ্ধে পাকসেনাদের ৯ জন সৈন্য নিহত হয় ।
১৬ জুন কুমিল্লার রাজাপুর রেলস্টেশন ঘাঁটি থেকে টহল দিতে আসা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপরে মুক্তিবাহিনীর এক প্লাটুন যোদ্ধা অ্যামবুশ করে। এসময় উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষে হানাদার বাহিনীর ৮ জন সৈন্য নিহত ও একজন আহত হয়। সম্মুখযুদ্ধ শেষে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, টেলিফোন সেট ও অন্যান্য জিনিস মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আসে।
১৬ জুন মুক্তিযোদ্ধাদের কসবা অবস্থান থেকে একটি দল বগাবাড়িতে হানাদার বাহিনীর একটি টহল দলকে অ্যামবুশ করে। এ অভিযানে হানাদার বাহিনীর ১০ জন সেনা নিহত ও ৫ জন আহত হয় ।
১৬ জুন যশোরের বেনাপোল হানাদারদের ঘাঁটির ওপর মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এতে হানাদার বাহিনীর প্রচুর ক্ষতি হয়।
তথ্যসূত্র-
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র নবম, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ খণ্ড।
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ১৭ জুন ১৯৭১
দৈনিক কালান্তর ১৬ জুন ১৯৭১
আহমাদ ইশতিয়াক
ahmadistiak1952@gmail.com
Comments