বাহরাইনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বিমার ব্যবস্থা
বাহরাইনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বিমার ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ দূতাবাস। এখন থেকে মাত্র ১৬ দিনারে (বাংলাদেশি প্রায় তিন হাজার ৬০০ টাকা) দুই বছর মেয়াদী বিমা পলিসিতে মৃত্যু বা পঙ্গুত্বে ক্ষতিপূরণ, জটিল রোগের চিকিৎসা কিংবা মরদেহ দেশে পাঠাতে প্রয়োজনীয় খরচ নিশ্চিত করতে পারবেন তারা।
দেশটির নামী একটি বিমা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মী, বিশেষ করে ফ্লেক্সি বা ফ্রি ভিসার এবং ছোট প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য এমন কল্যাণমুখী উদ্যোগ নিয়েছে বাহরাইনের বাংলাদেশ দূতাবাস।
চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত, বিদেশের ব্যয়বহুল চিকিৎসার সামর্থ্য নেই কম আয়ের অনেক কর্মীর- এমনটি জানিয়ে এই উদ্যোগকে সময়োপযোগী এবং বাস্তবসম্মত হিসেবে দেখছেন বাহরাইনের সাধারণ প্রবাসী, কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব ও সংগঠকরা।
তাদের মতে, চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতের পাশাপাশি এতে প্রবাসীদের মৃত্যু ঝুঁকিও অনেক কমবে।
গত বুধবার রাজধানী মানামায় বাংলাদেশ দূতাবাসে সলিডারিটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির সঙ্গে প্রবাসীদের জন্য এই বিমা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. নজরুর ইসলাম এবং বিমা প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী (সিইও) জাওয়াদ মোহাম্মদ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামস, বাংলাদেশ কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. শহিদুল আলম, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক মো. হামিদুর রহমান, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (মিশন ও কল্যাণ) নাসরিন জাহান, দূতাবাসের শ্রম কাউন্সেলর শেখ মো. তৌহিদুল ইসলাম, আইওএম’র বাহরাইন মিশন প্রধান, বাহরাইনের শ্রম মন্ত্রণালয় পরিচালক এবং প্রবাসী পরিষেবা অধিদপ্তর প্রতিনিধি।
দূতাবাস সূত্রে জানা যায়, বাহরাইনে প্রায় দুই লাখ বাংলাদেশি আছেন, যাদের মধ্যে ৩৫ হাজারের মতো বৈধ ফ্লেক্সি বা ফ্রি ভিসার কর্মী। এর বাইরে ৩০-৩৫ হাজার মতো দোকানি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মী রয়েছেন। এদের সবারই কোম্পানির কর্মীদের মতো চিকিৎসা সুবিধা সুযোগ, তাদের মরদেহ দেশে পাঠানোর খরচ কিংবা পরিবারের আর্থিক সহায়তা পাওয়ার সুযোগ নেই। মূলত এমন ৭০ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশিকে বিমা আওতায় আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, ১৬ দিনারের দুই বছর মেয়াদী বিমা পলিসিতে প্রবাসীরা দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে তিন হাজার দিনার, অন্য কোনো কারণে মৃত্যুতে এক হাজার ৫০০ দিনার, দুর্ঘটনার কারণে স্থায়ী পঙ্গুত্বে দুই হাজার দিনার, মরদেহ পাঠাতে সর্বোচ্চ এক হাজার দিনার, জটিল অসুস্থতায় এক হাজার দিনার, অসুস্থতার জন্য দেশে প্রত্যাবর্তনে সর্বোচ্চ ১৫০ দিনার পাবেন। এক বাহরাইনি দিনারে বাংলাদেশি প্রায় ২২৫ টাকা।
রাষ্ট্রদূত ড. নজরুল ইসলাম জানান, প্রবাসীদের বিমা সুবিধার আওতায় আনতে পলিসির সুবিধাগুলোর ব্যাপক প্রচার প্রচারণার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশ কমিউনিটি সংগঠকদের সঙ্গে আলোচনা করে এই কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বড় কোম্পানি, শিল্প ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের চিকিৎসা সেবাসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা আছে। ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও তাদের কর্মীদের সেই সুবিধা নেই। বাংলাদেশ সরকারের কাছে স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্প চালুর দাবিটি প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের হলেও তা এখনো বাস্তবের মুখ দেখেনি।
এমন বাস্তবতায় বিকল্প হিসেবে দূতাবাসের এমন কল্যাণমুখী উদ্যোগের প্রশংসা করে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে বাহরাইনের সাধারণ প্রবাসীসহ কমিউনিটি সংগঠকরা।
বাংলাদেশি শিল্পদ্যোক্তা ও প্রবাসী সিআইপি মোহাম্মদ শফি উদ্দিন বলেন, ‘চিকিৎসা নিয়ে কষ্টে পড়েন হাজার হাজার সামর্থহীন প্রবাসী। খরচের ভয়ে অনেকেই শরীরের রোগ পুষে রাখেন, চিকিৎসা নেন না। কারও অকালেই মৃত্যু হয়। চিকিৎসার জন্য দেশেও ফিরে যান অনেকে। এখন বিমার মাধ্যমে সবার চিকিৎসা সেবা, সহায়তা নিশ্চিত হবে। সত্যিকার অর্থে এটি একটি ভালো উদ্যোগ।’
‘বাহরাইনের আইন অনুযায়ী বৈধ প্রবাসীদের আকামার (ওয়ার্ক পারমিট) সঙ্গেই মাসিক সাত দিনার হারে স্বাস্থ্য বিমার ফি দিতে হয়, কিন্তু তাতে অনেক কিছুই কভার করে না। সেক্ষেত্রে দুই বছর মেয়াদী পলিসিতে ১৬ দিনার খরচ তুলনামূলক অনেক কম আর সুবিধাও অনেক বেশি। ফ্রি ভিসা বা অন্য প্রবাসীদের ওপর তেমন বেশি চাপ পড়বে না বলে মনে করি’, বলেন তিনি।
বাংলাদেশ স্কুলের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুইজ চৌধুরী বলেন, ‘নিঃসন্দেহে এটি সময়োপযোগী ভালো উদ্যোগ, বিশেষ করে ফ্লেক্সি ভিসাধারী বাংলাদেশি প্রবাসীদের জন্য এ ধরনের বিমা সুবিধার বেশি প্রয়োজন ছিল। তবে, তাদের বিমার ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলাটা বড় চ্যালেঞ্জ হবে। কারণ বিমা করতে বাংলাদেশিদের আগ্রহ বরাবরই কম। আশা রাখছি, দূতাবাস ও কমিউনিটি সংগঠনগুলোর প্রচারণায় কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসবে।’
বাংলাদেশ সোসাইটির আসিফ আহমদে বলেন, ‘সামর্থ্যহীন অসুস্থ প্রবাসী কর্মীদের চিকিৎসা কিংবা মরদেহ দেশে পাঠাতে দূতাবাস, কমিউনিটি সংগঠন ও বিত্তবান বাংলাদেশিরা যতটুকু সম্ভব সহায়তা করে থাকেন। কিন্তু সবার জন্য নিশ্চিত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। দেরিতে হলেও এমন উদ্যোগ সেই অভাব দূর করবে।’
‘দূতাবাসের নির্দেশনায় আমরা বাংলাদেশি কমিউনিটিতে প্রচারণায় জোর দেব। বেশি সংখ্যক প্রবাসীকে বিমার আওতার আনার চেষ্টা থাকবে আমাদের। আমরা আশা করি- আমাদের প্রবাসীরা এই বিমা সেবার গুরুত্ব বুঝবেন ও স্বল্প খরচের এই সেবাটি নেবেন’, বলেন তিনি।
বাহরাইন সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি বশির আহমেদ বলেন, ‘ইনস্যুরেন্স কোম্পানি চুক্তি মোতাবেক কাজ করবে এবং সহজ সরল সাধারণ প্রবাসীরা প্রয়োজনের সময় কোনো বিড়ম্বনা ছাড়াই সেবা পাবেন এই প্রত্যাশা করি।’
প্রবাসী ইমারত মোহাম্মদ বলেন, ‘এত অল্প টাকা দিয়ে দুই বছরের হেলথ সার্ভিস ও মৃত ব্যক্তির মরদেহ দেশে পাঠানো কল্পনা করা যায় না। আমরা অনেক বড় সুবিধা পেয়েছি। তবে খেয়াল রাখতে হবে, এ কাজে যেন কোনো মধ্যস্থতাকারী বা দালালচক্রের উত্থান না হয়।’
বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, শিগগির কমিউিনিট সংগঠক, ব্যক্তিত্ব এবং বিভিন্ন শ্রেণির প্রবাসী প্রতিনিধিদের নিয়ে ভার্চুয়াল বৈঠকে বিমার বিস্তারিত তুলে ধরা হবে এবং এ বিষয়ে প্রচারণার নির্দেশনা দিয়ে অনুরোধ জানানো হবে।
Comments