তারা নেই কারো ভাবনায়, করোনাকালে শেষ হয়ে গেল যাদের চাকরির বয়স

স্টার ফাইল ছবি

বয়স একদিন বেশি হওয়ায় ৪৩তম বিসিএস (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস) পরীক্ষার জন্য আবেদন করতে পারেননি ইডেন মহিলা কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সুমনা রহমান। গত বছর ৩১ অক্টোবর তার বয়স ৩০ বছর পূর্ণ হয় এবং পরের দিন ১ নভেম্বর ৪৩তম বিসিএসের জন্য প্রজ্ঞাপন দেওয়া হয়। মহামারির কারণে সুমনার মতো কয়েক লাখ চাকরিপ্রার্থী কোনো চাকরি জোগাড় করতে না পারলেও আবেদনের বয়সসীমা শেষ হয়ে গেছে। এখন তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন, এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার কি আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেবে?

দ্য ডেইলি স্টারকে সুমনা জানান, ৪৩তম বিসিএসের যখন বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার কথা ছিল, তার অনেক পরে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে গত দেড় বছরের মধ্যে ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ছাড়া আর কোনো পরীক্ষায় অংশ নেওয়ারও সুযোগ পাননি। অথচ বয়স ৩০ পার হওয়ায় তিনি নতুন করে আর কোনো চাকরির আবেদনও করতে পারবেন না।

করোনাকালে যাদের বয়স শেষ হয়েছে, তাদের ক্ষতি পোষাতে ব্যাকডেটে আবেদনের সুযোগ দেওয়া হবে বলা হলেও চলতি বছরের শুরুতে ব্যাকডেটে আবেদন করার সুযোগ রাখা হয়নি বলে দাবি করছেন চাকরিপ্রার্থীরা।

এ বিষয়ে সুমনা জানান, গত বছরের জুলাই পর্যন্ত তিনি চার-পাঁচটা চাকরিতে ব্যাকডেটে আবেদন করেছিলেন। তবে, ২০২১ সালের শুরু থেকে ব্যাকডেটে আর কোনো চাকরির আবেদনের সুযোগ পাননি।

সুমনা বলেন, ‘মুজিব বর্ষে কেউ বেকার থাকবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন প্রায় সাড়ে তিন লাখ পদে চাকরির জন্য সার্কুলারও দেওয়ার কথা ছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে আমরা সেই সার্কুলারগুলোতে আবেদন করতে পারতাম। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির কারণে সেই চাকরিগুলোর সার্কুলার হয়নি। আমার মতো অনেকের চাকরির বয়সও শেষ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে যদি সেই চাকরিগুলোর সার্কুলার দেওয়া হয়, তাহলে আমি কেন বঞ্চিত হব। এখানে আমার তো কোনো দোষ নেই।’

‘প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী আমাকে চাকরি দিতে হবে না, শুধু আমাকে চাকরিতে আবেদন করার সুযোগটুকু দেওয়া হোক। প্রধানমন্ত্রীর কাছে শুধু আমার এটাই দাবি’, যোগ করেন সুমনা।

আসছে ৪৩তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার জন্য আবেদনের সময় শেষ হবে আগামী ৩০ জুন। ইতোমধ্যে চার লাখেরও বেশি প্রার্থী আবেদন সম্পন্ন করেছেন। তার আগে ছিল ৪২তম বিশেষ বিসিএস। দুই হাজার চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ওই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এ ছাড়া, ৪১তম বিসিএসের জন্য আবেদন করেন চার লাখ ৭৫ হাজার প্রার্থী এবং ৪০তম বিসিএসে চার লাখ ১২ হাজার প্রার্থী।

এর বাইরেও প্রতিবছর কয়েক লাখ প্রার্থী যোগ্যতাপূরণ না হওয়ায় বিসিএসের জন্য আবেদন করতে পারেন না। তবে, তারাও মোট চাকরিপ্রার্থীদের বিশাল একটি অংশ।

এ ছাড়া, প্রতিবছর কয়েক লাখ নতুন চাকরিপ্রার্থী চাকরির প্রতিযোগিতায় নামেন, আবার কয়েক লাখ চাকরিপ্রার্থীর বয়স শেষ হয়ে যাওয়ায় চাকরি না পেলেও এই প্রতিযোগিতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হন।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স) থেকে পাস করে সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করছেন মুজনে বিন সাদ। চলতি বছরের ২৫ মার্চ তার বয়স ৩০ বছর পূর্ণ হয়েছে। সাদ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘মাস্টার্স শেষ হওয়ার পর ২০১৭ সাল থেকে সরকারি চাকরির জন্য আবেদন শুরু করি। বলতে পারেন ফুলটাইম চাকরিপ্রার্থী। আমার চাকরির বয়স শেষ হওয়ার আগের বছর থেকে দেশে মহামারি শুরু হয়েছে। মহামারির আগে কয়েকটা ভাইভা দিয়েছিলাম, তবে চাকরি হয়নি। আশা করছিলাম, ভালো প্রস্তুতি আছে, শেষ দিকে এসে ভালো কিছু একটা হয়ে যাবে। কিন্তু, মহামারির কারণে আর নতুন চাকরির জন্য আবেদন করা কিংবা পরীক্ষা দেওয়া কোনোটারই সুযোগ পেলাম না। আবার বয়সও শেষ হয়ে গেল।’

সাদ বলেন, ‘চার বছরের বেশি সময় ধরে প্রস্তুতি নিয়েছি। এখন মানসিক অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, না পারছি পড়া লেখা চালিয়ে যেতে, না পারছি সব ছেড়েছুড়ে নতুন কিছু শুরু করতে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন করে ব্যবসা দাঁড় করানোর চেষ্টা বা নিজের পড়ালেখার ক্ষেত্র টেক্সটাইল সেক্টরে গিয়ে কাজ শুরু করাটাও আমার জন্য অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে।’

বয়স শেষ হওয়ার আগে ২০টার মতো চাকরিতে আবেদন করা আছে উল্লেখ করে সাদ বলেন, ‘এগুলোর ওপর নির্ভর করছে আমার ভবিষ্যৎ। পরিস্থিতি ঠিক থাকলে গত দেড় বছরে আরও অন্তত ২০টা চাকরির জন্য আবেদন করতে পারতাম। তাতে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনাটাও বেড়ে যেত।’

একটা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির কারণে আমাদের জীবন থেকে অনেক মূল্যবান সময় হারিয়ে গেল উল্লেখ করে সাদ বলেন, ‘এ বিষয়ে সরকারের কী পরিকল্পনা আছে জানি না। তবে, আমরা যারা এই পরিস্থিতির শিকার হয়েছি, তাদের দাবি হচ্ছে সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়স বাড়ানো হোক। আবেদনের ন্যূনতম বয়স ৩২ বছর করা হলে এই ক্ষতি কিছুটা কমানো সম্ভব হবে।’

২০১৭ সালে বাংলাদেশে সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপে বলা হয়েছে, দেশে মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী রয়েছে ছয় কোটি ৩৫ লাখ। আর তাদের মধ্যে কাজ করেন ছয় কোটি আট লাখ নারী-পুরুষ। অর্থাৎ ২৭ লাখ মানুষ কোনো কাজ করেন না, তারা বেকার। আর শতাংশ হিসাবে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার চার দশমিক দুই শতাংশ।

চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি প্রকাশিত ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের মূল্যায়নে সারাদেশে ১১টি শিক্ষা বোর্ডে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ জন শিক্ষার্থী চলতি বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাস করে। এ ছাড়া ২০১৯ সালে মোট ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬২৯ জন শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষা দেয় এবং তাদের মধ্যে নয় লাখ ৮৮ হাজার ১৭২ জন পাস করে। অর্থাৎ প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক পাস করে উচ্চশিক্ষাসহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে।

সেই হিসাবে প্রতিবছর যদি ১০ লাখ নতুন চাকরিপ্রার্থী চাকরি ক্ষেত্রে প্রবেশ করেন, তাহলে একই বছর আরও ১০ লাখের কাছাকাছি সংখ্যক প্রার্থীর আবেদনের বয়স শেষ হয়। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এই বিশাল সংখ্যক প্রার্থী আবেদনের তেমন একটা সুযোগই পাননি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী নুর আলম বলেন, ‘আগামী ১৫ জুলাই আমার সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়স শেষ হবে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গত দেড় বছরে মাত্র একটা চাকরির পরীক্ষা দিতে পেরেছি। এ ছাড়া, ২০টার মতো চাকরির আবেদন করা আছে। এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, সেগুলোর ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ।’

নুর আলম আরও বলেন, ‘চাকরিতে আবেদনের বয়স শেষ হয়ে যাওয়ার পর থেকে চাকরির জন্য প্রস্তুতি চালিয়ে যাওয়াটা খুব কঠিন কাজ। এটা মনের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করে। এই পরিস্থিতির শিকারও হওয়া প্রায় ৯০ ভাগ চাকরিপ্রার্থীই মানসিকভাবে হতাশা ও বিষণ্নতায় ভুগছেন। চাকরি না পেয়ে পরিবার ও সমাজের বিদ্রূপের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথও বেঁছে নেন অনেকে।’

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ করার দাবিতে আন্দোলন করা ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন ‘সরকারি চাকরি প্রত্যাশী যুব প্রজন্মের’ সমন্বয়ক সাজিদ রহমান সেতু ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘২০২০ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেড় বছরে শুধু ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছি এবং দুটো চাকরির জন্য আবেদন করতে পেরেছি। এর বাইরে আমার আবেদন করার মতো কোনো সার্কুলারই হয়নি। এর মধ্যে আগামী ২১ জুলাই আমার বয়স ৩০ বছর পূর্ণ হবে। এরপর আর কোনো সরকারি চাকরিতে নতুন করে আবেদন করতে পারব না। এই যে আমার জীবন থেকে দেড় বছর হারিয়ে গেল, যেটার জন্য আমি দায়ী না। এই ক্ষতি কীভাবে পূরণ হবে?’

সেতু আরও জানান, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গত ঈদের আগে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ না করলেও সমস্যা হবে না। ব্যাকডেটে আবেদনের সুযোগ দেবেন। তবে, ঈদের পর থেকে আজ পর্যন্ত তিন-চারটা (তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির) চাকরির সার্কুলার হলেও সেগুলোতে ব্যাকডেটে আবেদনের কোনো অপশন ছিল না।

তিনি জানান, মহামারির মধ্যে গত বছরের নভেম্বরে ৪৩তম বিসিএসের সার্কুলার দেওয়া হয়। তবে, যে সময় সার্কুলারটা হওয়ার কথা ছিল, তারও অনেক পরে সার্কুলার হওয়ায় অনেকে এক থেকে পাঁচ দিন পর্যন্তও বয়স বেশি হওয়ায় আবেদন করতে পারেননি।

বর্তমান শিক্ষার্থীদেরও চাকরির বয়স ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উল্লেখ করে সেতু বলেন, ‘এখন যারা প্রায় দেড় বছর ধরে অনার্স বা মাস্টার্স শেষ করার অপেক্ষায় রয়েছেন, তাদেরও জীবন থেকে দেড় বছর হারিয়ে গেল।’

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘মহামারির কারণে অন্যান্য সব ক্ষেত্রের মতো শিক্ষাখাতও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আমি বলব, শিক্ষাখাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে, এই সময়ে ক্লাস-পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষা নেওয়া হলে অনেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ব্যক্তিগতভাবে আরও বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারত। আবার এটাও ঠিক যে, এই সময়ের মধ্যে অনেকে চাকরি পেয়ে পরিবার নিয়ে নিশ্চিন্তেও থাকতে পারত। তবে, সবার সুযোগ-সুবিধার কথা চিন্তা করে একটা ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আজ যার বয়স ৩০ পার হলো, তার আর চাকরির জন্য আবেদন করার সুযোগ থাকল না। সে যদি নতুন করে আবেদন করতে পারে, একটা ভালো চাকরি পায়, তাহলে আমি খুশিই হব।’

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতির কারণে শিক্ষাখাতের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও হতাশাগ্রস্ত। পরিস্থিতির কারণে চাকরিপ্রার্থীদের যে ক্ষতি হচ্ছে, তাতে তাদের কোনো হাত নেই। আমি মনে করি সরকার এই বিষয়টা বিবেচনায় নিয়ে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়াবে। তা না হলে এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী কোথায় যাবে? আমাদের বেসরকারি খাতও এত বেশি শক্তিশালী নয় যে, তাদের কাজে লাগানো যাবে।’

করোনা মহামারির জন্য সামগ্রিক শিক্ষাখাতে যে ক্ষতি হয়েছে, তা অপূরণীয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘একটা পরিসংখ্যান থেকে দেখেছি ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী আর শিক্ষাক্ষেত্রে ফিরে যেতেই পারবে না। সরকার নিশ্চয়ই এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে। তবে, সরকারের উচিত হবে, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বিবেচনা করা। তা না হলে এই বিশাল সংখ্যক শ্রমশক্তির অপচয় হবে।’

Comments

The Daily Star  | English

Power, Energy Sector: Arrears, subsidies weighing down govt

The interim government is struggling to pay the power bill arrears that were caused largely by “unfair” contracts signed between the previous administration and power producers, and rising international fuel prices.

10h ago