মঞ্চ টেলিভিশন সিনেমার উজ্জ্বল এক নাম হুমায়ুন ফরীদি
‘তিন ধরনের শিল্পী আছে পৃথিবীতে। ভালো শিল্পী, বিপদগ্রস্ত শিল্পী আর অশিল্পী। বিপদগ্রস্ত শিল্পী সব সময় মনে করে, এই বুঝি পড়ে গেলাম। এখনকার শিল্পীরা ত্রস্ত, দৌড়াচ্ছে। এই দৌড়টা বন্ধ করে হেঁটে যাও। টাকার পেছনে না ছুটে ভালো অভিনয় করো। টাকা এমনিই আসবে’— কথাগুলো একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন বরেণ্য অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি।
বেঁচে থাকলে আজ ৬৯ বছরে পা রাখতেন তিনি। মঞ্চ, টেলিভিশন নাটক ও সিনেমার অভিনেতা হিসেবে খ্যাতিমান এক নাম।
মঞ্চে ঢাকা থিয়েটারের ‘শকুন্তলা’, ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’, ‘কীর্তনখোলা’, ‘কেরামত মঙ্গল’ নাটকে অভিনয় করে নিজের জাত চিনিয়েছেন প্রথমে। এরপর ১৯৮০ সালে ‘নিখোঁজ সংবাদ’ নামে নাটকের মাধ্যমে তার টেলিভিশন জগতে অভিষেক হয়। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘নীল নকশার সন্ধ্যায়’ ও ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’ নাটকে অভিনয় করে মুগ্ধ করেন দর্শকের হ্রদয়। তার অভিনীত ধারাবাহিক নাটক ‘সংশপ্তক’ আজও দর্শকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল।
‘কানকাটা রমজান’ চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি। তার অভিনীত আলোচিত নাটকগুলোর মধ্যে আছে ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’, ‘বকুলপুর কতদূর’, ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা’, ‘একটি লাল শাড়ি’, ‘মহুয়ার মন’, ‘সাত আসমানের সিঁড়ি’, ‘একদিন হঠাৎ’, ‘অযাত্রা’, ‘পাথর সময়’, ‘দুই ভাই’, ‘শীতের পাখি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘তিনি একজন’, ‘চন্দ্রগ্রস্ত’, ‘কাছের মানুষ’, ‘মোহনা’, ‘শৃঙ্খল’, ‘প্রিয়জন নিবাস’। সর্বশেষ তিনি ‘তখন হেমন্ত’ নামে একটি ধারাবাহিক নাটক পরিচালনা করেন এবং ‘পূর্ণ চাঁদের অপূর্ণতায়’ নামে একটি নাটকে অভিনয় করেন।
হুমায়ুন ফরীদি অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত ‘হুলিয়া’। কিন্তু নব্বই সালের দিকে শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত ‘সন্ত্রাস’, ‘দিনমজুর’, ‘বীরপুরুষ’ ও ‘লড়াকু’র মতো বাণিজ্যিক সিনেমায় খলনায়ক চরিত্রে অভিনয় করে অন্যমাত্রা দেন। সিনেমায় নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন। শহিদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত ‘বিশ্বপ্রেমিক’, ‘অপহরণ’, ‘দুঃসাহস’সহ ২৫টি সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি। তার অভিনীত অন্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে ‘দহন’, ‘একাত্তরের যীশু’, ‘দূরত্ব’, ‘ব্যাচেলর’, ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘অধিকার চাই’, ‘ত্যাগ’, ‘মায়ের মর্যাদা’, ‘মাতৃত্ব’ ও ‘আহা!’ সিনেমায় দেখা গেছে। ২০০৪ সালে ‘মাতৃত্ব’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। মরণোত্তর একুশে পদক পেয়েছেন।
ঢাকার নারিন্দা এলাকায় ১৯৫২ সালের ২৯ মে হুমায়ুন ফরীদির জন্ম হয়। তার বাবার নাম এটিএম নুরুল ইসলাম, মায়ের নাম বেগম ফরিদা ইসলাম। চার ভাই-বোনের মধ্যে ফরীদি ছিলেন দ্বিতীয়। ইউনাইটেড ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হন স্নাতক করতে। পরের বছরই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কাঁধে তুলে নেন রাইফেল। স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে স্নাতক পড়তে শুরু করেন হুমায়ুন ফরীদি। এখানেই তার অভিনয় প্রতিভা বিকশিত হয়েছিল। সেলিম আল দীনের কাছে নাট্যতত্ত্বের দীক্ষা নেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নাট্য সম্পাদক ছিলেন। তখন থেকেই ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
হুমায়ুন ফরীদি আশির দশকের শুরুতে বেলি ফুলের মালা দিয়ে মিনু নামে একজনকে বিয়ে করেন। দেবযানী নামে তাদের একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। পরে বিয়ে করেন খ্যাতিমান অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফাকে। ২০০৮ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। হুমায়ুন ফরীদি ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
Comments