নিম্ন আয়ের এই মানুষদের নিয়ে হাসি-তামাশা কেন?

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেশে এখনো কাগজে-কলমে লকডাউন চলছে। তবে, কলকারখানা খোলা। খোলা বিপণিবিতানগুলোও। সেখানে বেশ ভিড়ও আছে। আবার ঈদে বাড়ি না গিয়ে সরকারি-বেসরকারি সব চাকরিজীবীদের কর্মস্থলে থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, বেসরকারি চাকরিজীবীদের কীভাবে কর্মস্থলে রাখা হবে, কে দেখবে, কেউ জানে না। কোথাও সেটা বলাও হয়নি। চাকরিজীবী ছাড়া অন্য কোনো পেশার মানুষের কী হবে, সেই সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনাও নেই।
শিমুলিয়াঘাটে ঘরমুখো মানুষের উপচে পড়া ভিড়। ৮ মে ২০২১। ছবি: স্টার

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেশে এখনো কাগজে-কলমে লকডাউন চলছে। তবে, কলকারখানা খোলা। খোলা বিপণিবিতানগুলোও। সেখানে বেশ ভিড়ও আছে। আবার ঈদে বাড়ি না গিয়ে সরকারি-বেসরকারি সব চাকরিজীবীদের কর্মস্থলে থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, বেসরকারি চাকরিজীবীদের কীভাবে কর্মস্থলে রাখা হবে, কে দেখবে, কেউ জানে না। কোথাও সেটা বলাও হয়নি। চাকরিজীবী ছাড়া অন্য কোনো পেশার মানুষের কী হবে, সেই সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনাও নেই।

এদিকে আবার দূরযাত্রার সব গণপরিবহন বন্ধ। তবে, আকাশপথ খোলা আছে। টাকা থাকলে আকাশে উড়ে যেকোনো গন্তব্যে যেতে পারবেন। প্রাইভেট কার থাকলেও কেউ আটকাবে না রাস্তায়। এমনকি মোটরসাইকেলেও যেতে পারবেন। মাইক্রোবাস বা পিকআপও আছে।

এই যে দেখেন, যমুনা বহুমুখী বা বঙ্গবন্ধু সেতুতে একদিনেই চলেছে ২৬ হাজার গাড়ি। এর মধ্যে পাঁচ শতাধিক যাত্রী-বোঝাই বাসও আছে। লকডাউনের মধ্যেও এগুলো কীভাবে চলছে, কেউ জানে না। তবে, মানুষজন যাচ্ছে। অন্যসময় যেখানে ৫০০ টাকায় বাসে বাড়ি যেতে পারতেন, এখন ভেঙে ভেঙে লাগছে আড়াই হাজার টাকা।

আপনি যদি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কোনো জেলার যাত্রী হন, আপনিও ভেঙে ভেঙে আসতে পারেন পদ্মাপাড়ে। কিন্তু, এরপরেই পড়বেন বিপদে। কারণ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাওয়ার দুই নৌরুট শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ও দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাটে ফেরিসহ যাত্রী পারাপারের সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ করার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার।

জনস্রোত নিয়ন্ত্রণে শনিবার সন্ধ্যা থেকে দুই ঘাটে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। তবে, জনস্রোত তো থামেইনি, উল্টো দুই ঘাটে কোনো ফেরি নোঙর করলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে হাজারো মানুষ। একেকটা ফেরিতে চার-পাঁচ হাজার করে মানুষ পার হচ্ছে, যাদের বেশিরভাগই হয়তো নিম্ন আয়ের মানুষ।

এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ট্রল, হাসি-তামাশা, দোষারোপ চলছে। যেন ফেরিতে পারাপার হওয়া মানুষগুলোই শুধু করোনা ছড়াচ্ছে। তারাই যেন শুধু অপরাধী। না, ফেরিতে গাদাগাদি করে বাড়ি যাওয়া কোনোভাবেই সমর্থন করছি না। সেটা লিখতেও বসিনি। কিন্তু, কথা হলো, লাখো মানুষ কেন এভাবে যাচ্ছে? বিকল্প কিছু কি করার ছিল না?

আবার একই দেশে এত নিয়ম কেন? যার গাড়ি আছে সে যদি যেতে পারে, তাহলে যার কিছু নেই সে কেন যাবে না? এখন আমাদের উদ্দেশ্য কী? গরিব মানুষের ঈদযাত্রা বন্ধ করা, নাকি করোনা ঠেকানো? যদি করোনা ঠেকানোই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে কেন বিকল্প ভাবনা নেই?

এই যে দেখেন, একটা দল উড়োজাহাজে করে যেখানে খুশি যেতে পারবে, সমস্যা নেই। করোনাকালে যারা বিমানবন্দরে গিয়েছেন তারা জানেন, কখনো কখনো এত ভিড় হয়েছে যে দেখলে চট করে গুলিস্তান মনে হতে পারে। কিন্তু, সেই ছবি নিয়ে কোনো হাসাহাসি হয়নি।

আবার দেখেন, উত্তরাঞ্চলের পথে মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল, ছোট গাড়ি— সবই আছে। তাহলে আনুষ্ঠানিকভাবে বাস চলছে না কেন? করোনার ভয়ে? যে মাইক্রোবাসে আট জন বসার কথা, সেখানে গাদাগাদি করে ১৬ জন যাচ্ছে। সেখানে করোনার ভয় নেই? মাইক্রোবাসে গাদাগাদি না করে বাসে ১৬ জন গেলে ঝুঁকি কি কমত না? তাহলে কেন বাস বন্ধ আর মাইক্রোবাস চলবে? বিষয়টা কি এই যে, বাসে করোনা ছড়াবে, মাইক্রোবাসে ছড়াবে না? আচ্ছা, ঈদ উপলক্ষে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দূরপাল্লার বাস-ট্রেন বা লঞ্চ চালু রাখলে সমস্যা কতটা হতো? সব লোককে যদি ঢাকা থেকে গাড়িতে নেওয়া যেত, তাহলে তো পথে পথে তাদের ওঠানামা করতে হতো না।

এই যে একজন মানুষকে বারবার ভেঙে বাড়ি যেতে হচ্ছে, তাতে তো করোনার ঝুঁকি আরও বাড়ছে। ধরেন, একজন সংক্রমিত মানুষ ঢাকা থেকে রংপুর, চট্টগ্রাম বা খুলনা যেতে সাত থেকে আট বার গাড়ি বদলাচ্ছে। প্রতিবারই কিন্তু সে নতুন নতুন লোককে ঝুঁকিতে ফেলছে। একবারে গেলে কিন্তু সেই ঝুঁকিটা কমত। এই যে ফেরিতে একবারে চার-পাঁচ হাজার মানুষ যাচ্ছে, তারা যদি আলাদা করে লঞ্চে বা বাসে যেতেন, তাহলে কি করোনার ঝুঁকি কমত?

আর মানুষ কি শুধু মাওয়া-শিমুলিয়া কিংবা আরিচা-পাটুরিয়ায় ভিড় করছে? নাকি সবখানেই এমন ভিড়? গণমাধ্যমের খবর বলছে, গাজীপুরের চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায়ও কিন্তু হাজারো মানুষ। সেখানে যাত্রীদের নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে পিকআপ, মাইক্রোবাস আর মোটরসাইকেল। অতিরিক্ত ভাড়ায় এসব বাহনের চালকরা যাত্রীদের উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যাচ্ছেন। ভাড়া নিয়ে চলছে দর-কষাকষি। ৫০০ টাকার খরচ এখন আড়াই হাজার টাকা হয়ে যাচ্ছে।

আচ্ছা, ঈদের সময় এই ভিড় কি নতুন? শুক্রবার সকাল থেকেই দেখা যাচ্ছিল, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে ঈদে ঘরে ফেরা মানুষ ও যানবাহনের চাপ। ফেরিতে ঠাসাঠাসি করে মানুষকে নদী পারাপার হতে দেখা যাচ্ছিল। গণমাধ্যম ও ফেসবুকে সেসব ছবি এলে সরকার থেকে বলা হয়, ৮ মে থেকে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া, শিমুলিয়া-বাংলাবাজারসহ সব ফেরিঘাটে দিনের বেলা ফেরি চলাচল বন্ধ থাকবে। শুধু রাতের বেলায় পণ্যবাহী পরিবহন পারাপারের জন্য ফেরি চলাচল করবে।

মূলত সম্প্রতি স্পিডবোট দুর্ঘটনার পর লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। যাত্রীদের পারাপারের জন্যে বিকল্প কোনো নৌযান না থাকায় ফেরিতে যাত্রীদের প্রচুর চাপ হচ্ছিল। এখন বিজিবি ও পুলিশ কীভাবে এই চাপ সামলাবে? হাজারো লোক ঘাটে এসে বসে আছে। ফেরি আসলেই তারা ঝাপিয়ে পড়ছে। অবস্থা এমন হয়েছে লোকের ভিড়ে মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্সও ফেরিতে উঠতে পারেনি। আচ্ছা ঈদ-যাত্রায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে, সেটা কি সরকারের ভাবনায় ছিল না? না থাকলে এখুনি ভাবা উচিত। কারণ, এই মানুষগুলো যেমন আগামী কয়েকদিন বাড়িতে যাবে, কয়দিন পর তারাই আবার ফিরবে।

এখন আপনি প্রশ্ন করতেই পরেন, এরা কেন এত কষ্ট করে ঢাকা ছাড়ছে, আবার কেনই গাদাগাদি করে আসবে? এই প্রশ্নের উত্তর জানলে তো হাসাহাসি হতো না এই মানুষদের নিয়ে। আচ্ছা এই যে ৪০-৫০ লাখ পোশাকশ্রমিক যাদের বেশিরভাগই নারী তাদের সন্তানরা যে গ্রামে দাদা-দাদি বা নানা-নানির কাছে থাকে, সেটা কি আমরা জানি? বছরে এক বা দুই বারই এরা সন্তানদের দেখতে যায়। ঈদ ছাড়া আর কখন তারা যাবে?

এই যে হাতে ব্যাগ নিয়ে যে মানুষটা বাড়ির পথে ছুটছে, কতজন আমরা জানি সেই ব্যাগে হয়তো আছে সন্তান বা প্রিয়জনদের জন্য কেনা কোনো পোশাক, যার জন্যে অপেক্ষার প্রহর গুনছে পরিবারটি। লকডাউন কি শুধু এই মানুষগুলোর জন্য? ঢাকার যে তরুণ বা ছাত্রটি মেসে থাকে, কেন তারা ঈদে বাড়ি যেতে চায়, এই শহরে তার কে আছে?

আচ্ছা ঢাকা শহরে কত মেসবাড়ি আছে আমরা কি কেউ জানি? ছাত্র, তরুণ, পিয়ন, দারোয়ান, ক্লিনার, সিকিউরিটি গার্ড, রাস্তায় চলা বাসের ড্রাইভার, হেলপার, কন্ডাক্টর, অফিসের সামনের ছোট চা দোকানিসহ নিম্ন আয়ের কত মানুষ থাকে এসব মেসে? ঈদের ছুটিতে তারা কোথায় যাবে? ঢাকা শহরে বাস করা নিম্ন আয়ের লাখো মানুষের পরিবার-পরিজন তো থাকে গ্রামে। তারা তো গ্রামেই যাবে।

কঠিন বাস্তবতা হলো, রাজধানী ঢাকায় যারা থাকে, তাদের বেশিরভাগই ঢাকাকে কখনো নিজের শহর মনে করতে পারে না। মূলত কাজের টানে ঢাকায় আসা এসব মানুষের মনে গভীরভাবে স্থায়ী হয়ে থাকে তার নিজের শহর। হোক, সেটা ছোট্ট মফস্বল কিংবা অনুন্নত জেলা শহর। ঈদে তারা সেখানেই যাওয়ার চেষ্টা করে, শত ঝুঁকি নিয়েও।

করোনাকালে এই যাওয়া-আসাটা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ঈদকে সামনে রেখে যেভাবে মানুষ রাজধানী থেকে গ্রামের পথে ছুটে যাচ্ছেন এবং পথে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক ও আশঙ্কাজনক। ঈদের পরে যেকোনো সময় পরিস্থিতি খারাপের দিকে চলে যেতে পারে। কোনো সন্দেহ নেই পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। কিন্তু, সেটা কি শুধু গরিব মানুষের জন্যে?

এখন সমাধান কী? আচ্ছা হঠাৎ করে একটা ঘোষণা দিয়ে দিলেই কি মানুষ বিপণিবিতানে ভিড় করা বা ঈদে বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দেবে? আবার গরিব মানুষের প্রতি আমাদের যে নেতিবাচক আচরণ, যে হাসি তামাশা সেটাও কি রাতারাতি বদলাবে? আচরণ পরিবর্তন কি এতই সহজ?

আসলে ব্যক্তি মানুষ বা সামষ্টিকভাবে সমাজের সাধারণ মানুষের আচরণ কীভাবে পরিবর্তন করা যায়, তা নিয়ে দুনিয়াজুড়ে গবেষণা চলছে। বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ বা লকডাউন কার্যকর করতে কী ধরনের যোগাযোগ কৌশল দরকার, তা নিয়ে কি কোনো কাজ বা গবেষণা হচ্ছে?

এই যে আমরা বলেই যাচ্ছি, মাস্ক পরতে, হাত ধুতে, দূরত্ব বজায় রাখতে, তারপরেও মানুষ এগুলো শুনছে না কেন? ঈদে বাড়ি যাবেন না বলার পরেও যাচ্ছে কেন? ভেবে দেখেন তো, করোনাকালে গত এক বছরে বাংলাদেশে যত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত এসেছে, তার কয়টা মানুষকে মানানো গেছে? শুধু প্রজ্ঞাপন দিয়ে কি আসলেই সমস্যার সমাধান হয়, নাকি দায়মুক্তি মিলে?

আসলে আচরণ পরিবর্তন কথাটা শুনতে খুব সহজ মনে হলেও মানুষের যেকোনো আচরণ পরিবর্তন করাটা কঠিন একটি বিষয়। কারণ, দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ওপর ভিত্তি করেই মানুষের আচরণ তৈরি হয়, যা একসময় তার অবচেতন কার্যকলাপের অংশেও পরিণত হয়ে যায়। এই যে বছরের পর বছর ধরে নিম্ন আয়ের মানুষ ঈদ করতে বাড়ি যাচ্ছে, সেখান থেকে হঠাৎ করে একটা নিষেধাজ্ঞা বা ঘোষণায় তাদের ঠেকানো কঠিন। এজন্য আরও পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি লাগবে।

মনে রাখতে হবে, যেকোনো ধরনের আচরণ পরিবর্তন করতে হলে প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া, সচেতনতা তৈরি, দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনসহ নানা ধাপ আছে। মূলধারার গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, মসজিদ বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রচারসহ সব মাধ্যমকেই কিন্তু কাজে লাগাতে হবে। এখানে যদি একেক শ্রেণির মানুষের জন্য একেক নিয়ম হয়, তাহলে কিন্তু সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন না এসে উল্টো আরও বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। কাজেই সমাজের কোনো অংশকে দায়ী না করে প্রয়োজন সবার জন্যে সমন্বিত পরিকল্পনা। করোনা মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

শরিফুল হাসান: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

shariful06du@gmail.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Exporters cheer weaker taka

Owing to a chaotic and volatile exchange rate, local exporters were desperate for the introduction of a floating exchange rate so they could draw more money and be more competitive.

1h ago