ভ্যাকসিনের বিকল্প উৎস: মজুদ শেষের পথে, এখনো নতুন চুক্তি হয়নি
দেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের মজুদ দ্রুত কমে আসছে। কিন্তু, সরকার টিকাদান কর্মসূচি চলমান রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালালেও এখনো কোনো বিকল্প উৎস থেকে ভ্যাকসিনের বিপুল পরিমাণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারেনি।
ভারত সরকার সেরাম ইনস্টিটিউটের কোভিশিল্ড (অ্যাস্ট্রাজেনেকা) ভ্যাকসিনের রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরপরই ২৬ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ সরকার প্রথম ডোজের টিকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গতকাল জানিয়েছে, মজুদ হিসেবে আর ১৪ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন আছে এবং ভারত থেকে নতুন কোনো চালান আসার সম্ভাবনা আপাতত নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘যদি বর্তমান মজুদ শেষ হওয়ার আগে নতুন কোনো চালান না আসে, তাহলে দেশে ভ্যাকসিনের সংকট দেখা দেবে।’
প্রথম ডোজ দেওয়া বন্ধ করার পর থেকেই সরকার বিভিন্ন কূটনৈতিক চ্যানেলে রাশিয়ার স্পুতনিক-ভি, চীনের সিনোফার্ম ও অন্যান্য উৎস থেকে ভ্যাকসিন কেনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
চীন উপহার হিসেবে সিনোফার্ম ভ্যাকসিনের পাঁচ লাখ ডোজ দিতে চেয়েছে এবং তারা আশা করছে বাংলাদেশ এই ভ্যাকসিনগুলো বেইজিং থেকে নিজ খরচে নিয়ে আসবে।
বাংলাদেশের সরকার এ মুহূর্তে রাশিয়ার সরকারের সঙ্গে স্পুতনিক-ভি ভ্যাকসিন কেনার জন্য একটি চুক্তি নিয়ে কাজ করছে।
তবে, বাংলাদেশ এখনো চীনের কাছে গত সপ্তাহে দেওয়া সিনোফার্ম ভ্যাকসিন কেনার প্রস্তাবের কোনো উত্তর পায়নি।
বিকল্প ভ্যাকসিন কেনার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার জন্য ইতোমধ্যেই দেশের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর স্পুতনিক-ভি ও সিনোফার্ম ভ্যাকসিনকে জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দিয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘শিগগিরই চীনের কাছ থেকে উত্তর পাওয়া যাবে বলে আমরা আশা করছি।’
‘আমি ধারণা করছি ছুটির কারণে তারা (চীন) উত্তর দিতে পারেনি’, বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চীনের দূতাবাসের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছে।’
‘আমরা তাদের প্রস্তাবনাটি পেলে প্রয়োজনীয় নিরীক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাব। আর যদি সবকিছু ঠিক থাকে, তাহলে খুব দ্রুত চুক্তি সইয়ের চেষ্টা করব’, বলেন তিনি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ ফ্লাইট ১০ মে বেইজিংয়ে গিয়ে সিনোফার্ম ভ্যাকসিনের পাঁচ লাখ ডোজ নিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।’
স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা আগে বলেছেন, সিনোফার্ম ভ্যাকসিনটি প্রথম ডোজ দেওয়ার জন্যে ব্যবহার করা হবে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সাংবাদিকদের জানিয়েছে, তারা সিনোফার্ম ভ্যাকসিনটিকে দেশব্যাপী টিকাদান কর্মসূচিতে ব্যবহার করার আগে প্রথমে এক হাজার মানুষকে টিকা দেবেন এবং ফলাফল পর্যালোচনা করবেন।
২০২০ সালের শুরুর দিকে বেইজিং ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রডাক্টস বিবিআইবিপি-করভি নামের নিষ্ক্রিয় করোনাভাইরাসের একটি টিকা তৈরি করে, যা সিনোফার্ম নামেও পরিচিত। চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিশর, পাকিস্তানসহ আরও কয়েকটি দেশ বর্তমানে এ টিকা ব্যবহার করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এখনো এ টিকার অনুমোদন দেয়নি। তবে, ডব্লিউএইচওর পরামর্শক প্যানেল জানিয়েছে, সিনোফার্ম নিজেদের টিকার কার্যকারিতা বিষয়ক নথি তাদের সামনে উপস্থাপন করেছে।
এদিকে যারা ইতোমধ্যে কোভিশিল্ডের প্রথম ডোজ পেয়েছেন, তারা দ্বিতীয় ডোজ পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। তবে, বাংলাদেশ আশা করছে তারা প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিনগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পাবে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের ছয় কোটি অতিরিক্ত ডোজ রয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তিনি আজ ভ্যাকসিন পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলারের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন।
মোমেন বলেন, ‘ওয়াশিংটন ডিসিতে নিযুক্ত আমাদের রাষ্ট্রদূত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। আমি দেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিলারকেও এ বিষয়ে অনুরোধ জানিয়েছি। আমাদের অনুরোধটি তারা বিবেচনা করছেন।’
তিনি আরও বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রাজিল ও ভারতকে প্রাধান্য দিচ্ছে। কারণ সেখানে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক পর্যায়ে রয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ভারতের প্রবাসী সম্প্রদায় অ্যাস্ট্রাজেনেকার পুরো ছয় কোটি ডোজ তাদের দেশেই পাঠানোর জন্য মার্কিন সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
‘আমিও আমাদের প্রবাসী সম্প্রদায়ের কাছে অনুরোধ করছি বাংলাদেশে ভ্যাকসিন পাঠানোর জন্য মার্কিন সরকারকে চাপ দিতে’, বলেন তিনি।
মোমেন বলেন, ‘বাংলাদেশ ইতোমধ্যে কয়েকটি ইউরোপীয় দেশের কাছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন চেয়েছে। কিন্তু, তাদের কাছে খুব কম পরিমাণ ভ্যাকসিন রয়েছে।’
‘ইউরোপ থেকে ভ্যাকসিন পাওয়ার সম্ভাবনা খুব একটা নেই বললেই চলে’, বলেন তিনি।
রাশিয়ান প্রস্তাবনাটি আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে
রাশিয়া সরকারের ভ্যাকসিন সরবরাহের প্রস্তাবনাটির আইনগত বিষয়গুলো পর্যালোচনার জন্যে ইতোমধ্যে সেটি আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ মজিবুল হক গতকাল ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা চুক্তির প্রক্রিয়াটিকে দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছি। আইন মন্ত্রণালয়ের অভিমত পাওয়ার পর আমরা প্রস্তাবনাটিকে আবারও রাশিয়ার কাছে ফেরত পাঠাব।’
গতকাল ভ্যাকসিন ক্রয় ও বিতরণের ওপর একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে টিকাদানের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বলেন, ‘আমরা কীভাবে চীন ও রাশিয়া থেকে দুই ধরনের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন কেনা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করেছি। এ ছাড়াও জাতীয় টিকাদান কমিটিকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দিয়ে আরও বর্ধিত করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কমিটিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে খুব কম সময়ের মধ্যে এই দুটি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা নিয়ে একটি খসড়া প্রতিবেদন তৈরি করতে এবং কখন এই ভ্যাকসিনগুলো আমরা হাতে পাব, তা জানাতে।’
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট ভ্যাকসিনের চালান পাঠাতে ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশে চলমান টিকাদান কর্মসূচি বাঁধার মুখে পড়ে।
চুক্তি অনুসারে, বাংলাদেশকে ছয় ধাপে তিন কোটি টিকা দেওয়ার কথা ছিল সেরামের। জানুয়ারিতে ৫০ লাখ ডোজের প্রথম চালানটি ঠিকমতো দিলেও ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় চালানে মাত্র ২০ লাখ টিকা পাঠায় সেরাম। এরপর থেকে আর কোনো চালানই পাঠায়নি তারা।
আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট যদি চুক্তিতে প্রতিশ্রুত ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে না পারে, তাহলে অগ্রিম দেওয়া অর্থ ফেরত পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
‘যখন চূড়ান্তভাবে জানা যাবে যে ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে না, তখন অগ্রিম যে অর্থ দেওয়া হয়েছে, তা আমরা অবশ্যই ফেরত পাব। লিখিত চুক্তির ভিত্তিতে সবকিছু হয়েছে’, বলেন তিনি।
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
আরও পড়ুন:
বেক্সিমকো-সেরাম: অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন দেশে তৈরির আলোচনা
নিজের জীবন বাজি রেখে অন্যের জীবন বাঁচানোর লড়াই
সঠিকভাবে মাস্ক না পরলে ঝুঁকি আড়াই গুণ বেশি
করোনাভাইরাস মূলত বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়: ল্যানসেট
টিকা সংকট নিরসন: নতুন উৎস রাশিয়া ও চীন
‘আগামী মাস থেকে স্পুতনিকের ৪০ লাখ ডোজ টিকা আসতে পারে’
দেশে রাশিয়ার ‘স্পুতনিক-ভি’ ভ্যাকসিন অনুমোদন
শিগগির ভারত থেকে ভ্যাকসিন পাচ্ছে না বাংলাদেশ
ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধের আহ্বান বিশেষজ্ঞদের
বাংলাদেশকে আড়াই কোটি ডোজ ভ্যাকসিন দিতে চায় রাশিয়া
টিকার বিকল্প উৎস সন্ধানে বাংলাদেশ
বাংলাদেশকে ৬০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন দিতে চায় চীনের সিনোফার্ম
ভারত সরকারের অনুমতি না পাওয়ায় বাংলাদেশে টিকা পাঠাতে পারছে না সেরাম
অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন পাওয়ায় অনিশ্চয়তা: অন্য উৎস খুঁজছে সরকার
Comments