নিজের জীবন বাজি রেখে অন্যের জীবন বাঁচানোর লড়াই
চারপাশে করোনা আক্রান্ত মানুষ। তাদের খুবই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। একটু নিঃশ্বাস নিতে তারা হাঁসফাঁস করছেন। নিজের জীবন বাঁচাতে চিকিৎসকের কাছে আকুতি করে যাচ্ছেন তারা।
এমন দুঃস্বপ্ন প্রায়ই দেখেন করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক মুহাম্মাদ আসাদুজ্জামান।
তিনি বলেন, ‘যখন কেউ আপনার হাত ধরে নিঃশ্বাস নিতে সাহায্য করার মিনতি জানান এবং মানুষটি আপনার চোখের সামনেই মারা যান, তখন নিজেকে স্বাভাবিক রাখা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে যায়। রাতে শান্তিতে ঘুমানো কঠিন হয়ে যায়। ঘটনাগুলো সারাক্ষণ আপনাকে তাড়া করে বেড়াবে।’
৪২ বছর বয়সী এই চিকিৎসক গত এক বছর ধরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবায় নিয়োজিত। তিনি রাজধানীর কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে সহকারী অধ্যাপক এবং নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।
গত কয়েকদিন ধরে বেশ কিছু গুরুতর রোগীর পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হয়েছে। ফলে, আসাদুজ্জামানের মতো অন্যান্য চিকিৎসকরাও নিরাশ।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমি মানুষের মৃত্যু দেখতে দেখতে ক্লান্ত। অনেক ক্ষেত্রেই আমি কিছুই করতে পারিনি। আমার মনে হচ্ছে, আমি মানসিক ভারসাম্য হারাতে চলেছি।’
করোনা অনেক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীর প্রাণ কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি জীবিতদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও বড় ধরণের চাপ ফেলছে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, মহামারিতে ইতোমধ্যে ১৫৪ জন চিকিৎসক প্রাণ হারিয়েছেন এবং আক্রান্ত হয়েছেন দুই হাজার ৯১১ জন। এছাড়াও ২৩ জন নার্স প্রাণ দিয়েছেন এবং আরও দুই হাজার ৫৬৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা এই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দৃঢ় সংকল্প থাকলেও তারা এখন ক্লান্তি, উদ্বেগ, হতাশা ও ঘুমের সমস্যায় ভুগছেন। এর জন্য দায়ী তাদের দীর্ঘ কর্মঘণ্টা ও কোভিড রোগীদের চিকিৎসার অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িত থাকা। বিভিন্ন গবেষণা থেকে এ ব্যাপারটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা গেছে।
সুমন কুণ্ডু তেমনই একজন চিকিৎসক।
তিনি জানান, তিনি সার্বক্ষণিক ভয়ের মধ্যে থাকেন। গত বছর এপ্রিল থেকে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসিইউতে কাজ করছেন।
তিনি বলেন, ‘এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাওয়া এবং বেঁচে থাকাই আমার ও আমার সহকর্মীদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’
মহামারির প্রথম ঢেউয়ের পর সুমন ভেবেছিলেন, হয়তো সবচেয়ে কঠিন সময় আমরা পেরিয়ে এসেছি। কারণ সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার দুটিই গত বছরের শেষের দিকে কমে যায়। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে পরিস্থিতি বেশ ভয়ংকর হয়ে গেছে।
‘এখন অনেক রোগীর পরিস্থিতি খুব দ্রুত অবনতি হয়। আমাদের কিছুই করার থাকে না,’ বলেন সুমন।
দেশের চিকিৎসকদের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি নিয়ে করা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে করুণ চিত্র।
‘কোভিড-১৯ প্যান্ডামিক: মেন্টাল হেলথ অব ডক্টরস ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৮ দশমিক পাঁচ শতাংশ চিকিৎসক উদ্বেগ, অবসাদ, ঘুমের সমস্যা, দুর্বল মনোযোগ, কম আত্মবিশ্বাস এবং দৈনন্দিন কাজ করার ক্ষেত্রে সমস্যায় ভুগছেন।
আকটা সায়েন্টিফিক নিউরোলজি জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণায় বলা হয়েছে, এই সমস্যাগুলো চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে এবং বিপর্যস্ত হতে পারে অন্য মানুষের সঙ্গে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক।
‘সাধারণ স্বাস্থ্য প্রশ্নপত্র-১২’ ব্যবহার করে এক অনলাইন সমীক্ষার মাধ্যমে সঞ্চালিত এই গবেষণায় ঢাকাভিত্তিক ৩৫৮ জন চিকিৎসকের মানসিক স্বাস্থ্য মূল্যায়ন করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের শিক্ষক রাউফুন নাহার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘চিকিৎসা করা না হলে এই মনস্তাত্ত্বিক সংকটগুলো মানসিক ব্যাধিতে রূপান্তরিত হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, গবেষণা থেকে জানা গেছে যে নারী চিকিৎসকরা তাদের পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় অধিক পরিমাণে মানসিক সমস্যা ও দুর্বলতায় ভুগছেন।
চিকিৎসকদের মতো নার্সরাও করোনা রোগীদের সেবা করতে গিয়ে গুরুতর উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভুগছেন।
ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নার্সিং অফিসার কামরুন্নাহার বলেন, তার কখনো ট্যাকিকার্ডিয়ার সমস্যা (যখন হৃদযন্ত্রের কম্পন মিনিটে ১০০ এর বেশি থাকে) ছিল না। কিন্তু তাকে এখন এর জন্য ওষুধ খেতে হচ্ছে। এছাড়াও তাকে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হচ্ছে।
গত ছয় মাস ধরে এন্টিডিপ্রেসেন্ট ও ঘুমের ওষুধ খেতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তাও আমি রাতে ঘুমাতে পারি না।’
আন্তর্জাতিক সাময়িকী স্প্রিংগারে প্রকাশিত ‘মেন্টাল হেলথ সিম্পটমস এমং দ্য নার্সেস অব বাংলাদেশ ডিউরিং দ্য কোভিড-১৯ প্যান্ডামিক’ নামক গবেষণায় এ ধরণের ঘটনাগুলো প্রাধান্য পেয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৫৪৭ জন নার্স মধ্যম থেকে জটিল পর্যায়ের হতাশা, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তায় ভুগেছেন। এর হার যথাক্রমে ৫০ দশমিক পাঁচ শতাংশ, ৫১ দশমিক আট শতাংশ ও ৪১ দশমিক সাত শতাংশ। এছাড়াও, ৬১ দশমিক নয় শতাংশ নার্স জানিয়েছেন যে তারা কোভিড-১৯ এর কারণে মধ্যম থেকে জটিল পর্যায়ের মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।’
এই গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, পুরুষের তুলনায় নারীদের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায় ভোগার প্রবণতা বেশি।
একটি অনলাইনভিত্তিক সমীক্ষার মাধ্যমে গত বছরের ২২ নভেম্বর থেকে ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে এই গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
এতে অংশ নেওয়া ৫৪৭ জন নার্সের বেশিরভাগই ছিলেন নারী।
এই গবেষণায় জানা যায়, ৬১ দশমিক নয় শতাংশ নার্স মহামারির সময়ে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।
গবেষণাটি থেকে পাওয়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, নার্সরা স্বাস্থ্যসেবা কর্মী হওয়ার কারণে এবং করোনা মহামারিতে কাজ করার কারণে মানসিক নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন, উচ্চ হতাশা, উদ্বেগ, মানসিক চাপ ও মানসিক প্রভাবের শিকার হয়েছেন।
গবেষণা প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক ও সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি এন্ড রাইটসের (এসএনএসআর) সাধারণ সম্পাদক সাব্বির মাহমুদ তিহান বলেন, ‘নার্সরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত। তাদের এখনই সহায়তা প্রয়োজন।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নার্সিং অফিসার তিহান জানান, সরকারের উচিত নার্সদের প্রণোদনা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, করোনা রোগীদের চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা গত এক বছর ধরে অনেক বড় ধরণের শারীরিক ও মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে গেছেন।
তিনি মনে করেন, যারা গত এক বছর করোনা রোগীদের সেবা দিয়েছেন তাদের বিশ্রাম দেওয়া উচিৎ।
আশংকা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘যারা অন্যান্য রোগীদের দেখাশুনা করছেন, তাদের এখন করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত করা উচিৎ। তা না হলে সমগ্র চিকিৎসা ব্যবস্থায় ধস নামতে পারে।’
Comments