হুমায়ুন আজাদ: বাংলা ভাষার এক নিরন্তর সংগ্রামী অভিযাত্রী
আমাদের দেশে নির্ভয়ে সত্য উচ্চারণ করার মতো সাহসী বুদ্ধিজীবী ভয়াবহ রকমের সংখ্যালঘু। হাতে গোনাই বলা চলে। কারণ বুদ্ধিজীবী নির্ভয়ে মত প্রকাশ করে সরকার কিংবা ক্ষমতাশালী, উগ্রবাদীদের চক্ষুশূল হতে চান না। আর যারাই সত্য উচ্চারণ করেছেন তারা পদে পদে বাধা বিপত্তির শিকার হয়েছেন।
শাসক, সমাজের মোড়ল ও ধর্মান্ধদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সত্যি কথাটি বলার মতো ছিলেন খুবই নগণ্য সংখ্যক বুদ্ধিজীবী। অধ্যাপক আহমদ শরীফ, দাউদ হায়দার, শামসুর রাহমানকে হুমকি-ধামকিও প্রচুর দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি তো কবি শামসুর রাহমানের ঢাকার শ্যামলীর বাড়িতে ঢুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেছিল দুর্বৃত্তরা। অবশ্য গুরুতর আহত হয়েও কবি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। তবে সবচেয়ে বেশি আঘাত এসেছে হুমায়ুন আজাদের উপর। তার বই যেমন নিষিদ্ধ হয়েছে, তাকে অজস্র গালাগাল, মানসিক আঘাত সইতে হয়েছে। এবং সর্বশেষ তাকে তো শারীরিকভাবে আঘাত করে মৃত্যুর মুখেই ঠেলে দিয়েছিল উগ্রবাদীরা। তিনি জানতেন আঘাত আসবে কিন্তু তবু তিনি টলেননি। তাই স্রোতের প্রতিকূলে চলে সত্য ভাষ্যের এক অনন্য পথিক হুমায়ুন আজাদ।
হুমায়ুন আজাদের জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরের কামারগাঁয়ে নানা বাড়িতে। যেটি বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার অন্তর্গত। তার জন্ম নাম ছিল হুমায়ুন কবীর।
তার বাবা আবদুর রাশেদ প্রথম জীবনে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন, পরে পোস্টমাস্টার এবং ব্যবসায়ী হয়েছিলেন। মা জোবেদা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। তিন ভাই এবং দুই বোনের মধ্যে হুমায়ুন আজাদ ছিলেন দ্বিতীয় পুত্র। হুমায়ুন আজাদের বেড়ে উঠা তাদের বাড়ি রাঢ়ীখাল গ্রামে। তার শৈশব ছিল অসম্ভব সুন্দর। রাঢ়ীখাল গ্রামের কাছেই পদ্মা নদী। রাতের বেলায় নদীতে স্টিমার চলত, তিনি তন্ময় হয়ে শুনতেন। নিজে লিখেছিলেন স্টিমারের আওয়াজ আমার কাছে অলৌকিক মনে হতো, তাই আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম অলৌকিক ইস্টিমার।
হুমায়ুন আজাদের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সূচনা হয় দক্ষিণ রাড়িখাল প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। সালটা ১৯৫২। সেখানে চার বছর পড়েছিলেন তিনি। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার জন্য তাকে স্যার জে সি বোস ইন্সটিটিউটে ভর্তি করানো হয়। ছেলেবেলা থেকেই প্রচণ্ড মেধাবী ছিলেন হুমায়ুন আজাদ। এ স্কুল থেকে থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ১৯৬২ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় তিনি মেধাতালিকায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এই স্কুলে থাকা অবস্থাতেই হুমায়ুন আজাদের কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে সাহিত্য কর্মের সূচনা হয়েছিল। নবম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার কচিকাঁচার আসরে ছাপা হয়েছিল তার লেখা ‘ঘড়ি বলে টিক টিক’ নামে একটি প্রবন্ধ। এরপর বহুবার তার সেই কৈশোরেই প্রবন্ধ, কবিতা ও ছড়া প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৬২ সালে হুমায়ুন আজাদ চলে এলেন ঢাকায়। ভর্তি হলেন ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে। তার ইচ্ছে ছিল তিনি পড়বেন মানবিক বিভাগে, কিন্তু বাবার ইচ্ছের কাছে হার মেনে ভর্তি হলেন বিজ্ঞান বিভাগে। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষাতেও তিনি মেধাতালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন। ১৯৬৪ সালে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় তিনি থাকতেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন হুমায়ুন আজাদ। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় তিনি হয়েছিলেন প্রথম বিভাগে প্রথম। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়ার সময় লতিফা কোহিনুর ও হুমায়ুন আজাদ একে অপরের প্রেমে পড়েন।
১৯৬৯ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা জীবন শুরু হয় হুমায়ুন আজাদের। সেখানে কিছুকাল থাকার পর ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি যোগ দিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে। একই বছরের ডিসেম্বর তিনি ঢাকায় ফিরে যোগ দিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হলো তার প্রথম গবেষণা গ্রন্থ ‘রবীন্দ্র প্রবন্ধ: রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা’। একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হলো তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অলৌকিক ইস্টিমার’। সে বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে ভাষাবিজ্ঞান পড়তে স্কটল্যান্ডে চলে যান হুমায়ুন আজাদ। মূলত হুমায়ুন আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানী নওম চমস্কির উদ্ভাবিত রূপান্তর মূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ তত্ত্বটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাই এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য হুমায়ুন আজাদ এই তত্ত্বের কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে বাংলা ভাষার রূপমূলতত্ত্ব তথা বাক্যতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তার এই গবেষণার মধ্য দিয়ে বাংলার ভাষা বিষয়ক গবেষণায় আধুনিক ভাষাবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূত্রপাত ঘটে।
১৯৭৫ সালের ১২ অক্টোবর দীর্ঘদিনের প্রেমিকা লতিফা কোহিনুরের সঙ্গে বিয়ে হয় হুমায়ুন আজাদের। ১২ অক্টোবর যখন তাদের বিয়ে হয় টেলিফোনে; হুমায়ুন আজাদ তখন স্কটল্যান্ডে আর লতিফা কোহিনুর বাংলাদেশে।
১৯৭৬ সালে স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন হুমায়ুন আজাদ। পিএইচডিতে তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘বাংলা ভাষায় সর্বনামীয়করণ’। এডিনবরায় গবেষণাকালীন তিনি রবার্ট ক্যাল্ডরের সহযোগিতায় কবি জীবনানন্দ দাশ এবং নিজের কিছু কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। যেগুলো ‘লিডস বিশ্ববিদ্যালয় জার্নাল’ এবং এডিনবরার বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘চ্যাপম্যান’ সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
স্কটল্যান্ড থেকে আসার পরেই সর্বপ্রথম ছোট গল্পে হাতে খড়ি হয় হুমায়ুন আজাদের। প্রথম গল্পটির নাম ‘অনবরত তুষারপাত’। এই গল্পটিপ্রকাশিত হয় আর দুই বছর পরে ইত্তেফাক পত্রিকায়। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হুমায়ুন আজাদ যোগ দেন। সময়টা ১৯৭৮ সালের পয়লা নভেম্বর।
আশির দশকে হুমায়ুন আজাদের পিএইচডি অভিসন্দর্ভ প্রকাশিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে। এর পরের বছর ১৯৮৪ সালে বাংলা ভাষার বাক্যতত্ত্বের ওপর ‘বাক্যতত্ত্ব’ নামে একটি বই বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশ করেন তিনি। একই সালে বাংলা একাডেমি থেকে তিনি ‘বাঙলা ভাষা’ নামে দুই খণ্ডের একটি সংকলিত বই প্রকাশ করেন যেখানে বাংলা ভাষার বিভিন্ন ক্ষেত্রের ওপর বিগত শতাধিক বছরের বিভিন্ন ভাষাবিদ ও সাহিত্যিকের লেখা গুরুত্বপূর্ণ ভাষাতাত্ত্বিক রচনা সংকলিত হয়েছিল। এই তিনটি গ্রন্থই আজ অবধি বাংলা ভাষাবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসাবে বিবেচিত হয়। ১৯৮৬ সালে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হন ড. হুমায়ুন আজাদ। এর দুই বছর পর বের হলো তার ‘তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান’ গ্রন্থ।
হুমায়ুন আহমেদের রাজনৈতিক লেখালেখি ও বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনার সূচনা হয় আশির দশকেই। মূলত আশির দশকের শেষভাগ থেকে হুমায়ুন আজাদ সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। এ সময় তিনি খবরের কাগজ নামীয় সাপ্তাহিক পত্রিকায় সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখতে শুরু করেন। সামরিক শাসনের বিরোধিতা দিয়ে সূচনা হয় তার রাজনৈতিক লেখালিখির।
গদ্যকার হিসেবে হুমায়ুন আজাদ যেমন অসামান্য, ঔপন্যাসিক হিসেবেও তিনি ছিলেন কিংবদন্তী তুল্য ঔপন্যাসিক। হুমায়ুন আজাদের উপন্যাসে যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৪ সালে। তার প্রথম উপন্যাস ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশের সামরিক শাসন প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাসটি তিনি উৎসর্গ করেন উপন্যাসের প্রধান চরিত্র রাশেদকে, হুমায়ুন আজাদের বাবার নামও ছিল রাশেদ, তাই তিনি উপন্যাসের উৎসর্গ পাতায় এভাবে লিখেছিলেন, ‘উৎসর্গ পরলোকগত পিতা, আমি একটি নাম খুঁজছিলাম, আপনার নামটিই-রাশেদ-মনে পড়ল আমার।’
১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হলো তার উপন্যাস ‘সব কিছু ভেঙে পড়ে’। এই উপন্যাসের বিষয় ছিল নারী-পুরুষের মধ্যেকার শারীরিক ও হৃদয়সম্পর্কের নানা আবর্তন এবং পরিণতির আখ্যান। এর পর তিনি লিখেছিলেন উপন্যাস ‘মানুষ হিসেবে আমার অপরাধসমূহ’। এই উপন্যাসটি ছিল একজন সরকারি কর্মকর্তার তার বন্ধুর স্ত্রীকে বিয়ে করা নিয়ে। হুমায়ুন আজাদ এই উপন্যাস উৎসর্গ করেছিলেন খ্যাতনামা আইনজীবী ব্যারিস্টার আমির উল ইসলামকে।
১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হলো হুমায়ুন আজাদের উপন্যাস কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ। এ উপন্যাসে হুমায়ুন আজাদ হাসান রশিদ নামের একজন কল্পিত বাঙালি কবির একজন বিবাহিত নারীর সাথে বিয়ে ছাড়া একত্রবাসের বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন। যদিও এই উপন্যাস সেসময় প্রচণ্ড সমালোচিত হয়েছিল। তবে সাহিত্য বোদ্ধারা বলেছিলেন এই উপন্যাসে হুমায়ুন আজাদের উপন্যাসের চরিত্রে শক্তিমত্তা প্রকাশ পায়।
২০০২ সালে প্রকাশিত হলো হুমায়ুন আজাদের উপন্যাস ‘১০,০০০, এবং আরো ১টি ধর্ষণ’। এই উপন্যাসটি ছিল বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের একটি ধর্ষিত মেয়ের জীবনের প্রেক্ষাপট নিয়ে। যে কিনা ধর্ষণের শিকার হয়ে জন্ম নেওয়া নিজের সন্তানকে হত্যা করে।
২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় হুমায়ুন আজাদের বহুল আলোচিত উপন্যাস ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’। এর বিষয়বস্তু ধর্মীয় মৌলবাদ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হানাদারদের সহায়তাকারী একটি দলের উপর ভিত্তি করে এই উপন্যাস রচিত হয়। হুমায়ুন আজাদ এই উপন্যাসটি উৎসর্গ করেছিলেন ‘১৯৭১’ সালকে। পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীতের নামানুসারে এই উপন্যাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে সমালোচনা করা হয়েছে নানা চরিত্রের মাধ্যমে।
তবে এই উপন্যাস গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগে দৈনিক ইত্তেফাকে ছাপা হয়েছিল। পাক সার জমিন সাদ বাদ ছাপা হওয়ার পর ধর্মীয় রাজনৈতিক দল ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এর প্রচণ্ড সমালোচনা করে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী আমির এবং তৎকালীন সংসদ সদস্য, যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী জাতীয় সংসদে এই বই বাজেয়াপ্ত করার হুমকি দিয়ে ইত্তেফাক ভবন পুড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেন। একই বছর বের হয়েছিল হুমায়ুন আজাদের সর্বশেষ উপন্যাস ‘একটি খুনের স্বপ্ন’। একটি খুনের স্বপ্ন উপন্যাসটি ছিল একজন তরুণের অপর একটি তরুণীর জন্য ভালোবাসার কাহিনী নিয়ে। ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ এ মৌলবাদে দীক্ষিত এক পুরুষকে সবার শেষে প্রেমের কাছে পরাজিত হতে দেখান লেখক। একটি খুনের স্বপ্ন উপন্যাসটি হুমায়ুন আজাদ তার নিজেরই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতির প্রতি উৎসর্গ করেছিলেন।
হুমায়ুন আজাদের উপন্যাস প্রসঙ্গে আরও বলা যায় ২০০১ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘ফালি ফালি ক’রে কাটা চাঁদ’ নিয়ে। এই উপন্যাসে শিরিন নামের এক কল্পিত ব্যক্তিত্ব সম্পন্না নারীর অবতারণা করেছেন এই মনে করে যে মানসিক সম্পর্ক রাখা একটি গভীর আস্থার ব্যাপার। উপন্যাসটি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নারীবাদের একটি চিত্র তুলে ধরে। শিরিনের স্বামী রয়েছে যার নাম দেলোয়ার কিন্তু সে একদা খালেদ নামের এক পুরুষের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কে লিপ্ত হয় নিজের এক প্রকারের সম্মতিতেই। শিরিন পরে তার স্বামী দেলোয়ারের সঙ্গে বাস করবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয় এবং খালেদ তাকে প্রেম প্রস্তাব দিলে সেটাও প্রত্যাখ্যান করে। কিংবা বলা যায় হুমায়ুন আজাদের উপন্যাস ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’ নিয়েও। এই উপন্যাসটি একজন বালকের ভেতর দিয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য রচিত উপন্যাস, যেখানে কিশোর বালকটি গ্রামীণ পরিবেশে বড় হয়। ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’ উপন্যাসটিকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান উপন্যাস মনে করতেন হুমায়ুন আজাদ। তুলনা করতে গিয়ে এই উপন্যাসকে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’র তুলনায় অনেক ভালো উপন্যাস বলে মনে করেতেন তিনি। পথের পাঁচালীর অপু চরিত্রের সঙ্গে নিজের জীবনের মধুর জলকদর চরিত্রকে তুলনা করতে গিয়ে জলকদর চরিত্রকেই অনেক বেশি শিল্পোত্তীর্ণ চরিত্র মন্তব্য করেছিলেন হুমায়ুন আজাদ। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘জলকদরের ভিতর দিয়ে আমি নিজের কৈশোর জীবনকে দেখি। ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’ উপন্যাসটির আগে কিশোরদের জন্য হুমায়ুন আজাদ এর আগে ‘আব্বুকে মনে পড়ে’ ও ‘ আমাদের শহরে একদল দেবদূত’ নামে দুটো কিশোর উপন্যাসিকা লিখেছিলেন। ‘আব্বুকে মনে পড়ে’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে আর ‘আমাদের শহরে একদল দেবদূত’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৬ সালে।
হুমায়ুন আজাদ ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক। শামসুর রাহমানকে নিয়ে লেখা তার বই শামসুর রাহমান/ নিঃসঙ্গ শেরপা, শিল্পকলা নিয়ে লেখা প্রবন্ধের বই ‘শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ’, ভাষা আন্দোলন ও সাহিত্য নিয়ে লেখা ‘ভাষা আন্দোলন: সাহিত্যিক পটভূমি’।
১৯৯২ সালে তার প্রকাশিত ‘নারী’ গ্রন্থটি ছিল বাংলাদেশের নারীবাদ বিষয়ক প্রথম বই। যদিও এই বইয়ের প্রবন্ধগুলোর জন্য প্রচণ্ড সমালোচিত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৫ সালের ১৯ নভেম্বর তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পরবর্তীতে প্রায় সাড়ে চার বছর পরে ২০০০ সালের মার্চ মাসে বইটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ফরাসি নারীবাদী দার্শনিক সিমন দ্যা বোভোয়ারের ১৯৪৯ সালের গ্রন্থ ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ হুমায়ুন আজাদ ২০০১ সালে বাংলায় অনুবাদ করেন। হুমায়ুন আজাদ স্বীকার করেছিলেন সিমোন দ্যা বোভোয়ারের লেখা তাকে নারীবাদের প্রতি প্রচণ্ড আকৃষ্ট করেছিল।
একই বছর প্রকাশিত হয়েছিল তার আরও বেশ কয়েকটি গ্রন্থ। ‘প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে’, ‘নিবিড় নীলিমা’, ‘মাতাল তরণী’, ‘নরকে অনন্ত ঋতু’, ‘জলপাই রঙের অন্ধকার’, ‘সীমাবদ্ধতার সূত্র’, ‘আঁধার ও আধেয়’ এবং ‘আমার অবিশ্বাস’; প্রতিটি প্রবন্ধ সংকলনই প্রচণ্ড আলোচিত হয়েছিল।
২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত তার ‘আমরা কি এই বাঙলাদেশ’ চেয়েছিলাম গ্রন্থে হুমায়ুন আজাদ তার স্বপ্নের বাংলাদেশের করুণ অবস্থা দেখে প্রচণ্ড কাতর ও বেদনার্ত হয়েছিলেন। বইটিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি যে রকম প্রগতিশীল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতাম সেই স্বপ্ন বহু আগেই ভেঙে গেছে।’ বাংলাদেশের সমাজের অধঃপতন খুবই আক্ষেপের সঙ্গে প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
বাংলা সাহিত্যে তো বটেই বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে ও হুমায়ুন আজাদের ভূমিকা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলা ভাষার রূপমূলতত্ত্ব তথা বাক্যতত্ত্ব নিয়ে তার গবেষণা যেমন অনন্য তেমনি বিশেষ করে ছোটদের বাংলা ভাষার লাল নীল দীপাবলি (বাঙলা সাহিত্যের জীবনী)। বাংলার ভাষা নিয়ে লেখা বই বাক্যতত্ত্ব, তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান, বাংলা ভাষা শিরোনামে দুই খণ্ডের একটি দালীলিক সঙ্কলন অনন্য সৃষ্টি। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বাংলা ভাষার উপর একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ রচনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন হুমায়ুন আজাদ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি।
হুমায়ুন আজাদের কবি হিসেবেও ভীষণ বিখ্যাত। তার কবিতা বাংলা সাহিত্যের এক নতুন ধারার সূচনা করেছে। তার কবিতা লেখার সূচনা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে। তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তখনই তিনি মূলত কবিতা রচনায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়-জীবন শেষ করার পরেও ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি কবিতা লিখতে থাকেন। ষাটের দশকের পরিব্যাপ্ত হতাশা, দ্রোহ, ঘৃণা, বিবমিষা, প্রেম ইত্যাদি তার কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু ছিল। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ যা তিনি উৎসর্গ করেছিলেন ১৯৬৮-১৯৭২ সালে তার নিজেরই কাটানো রাত-দিনগুলোর উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘জ্বলো চিতাবাঘ’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ সালের মার্চে। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয় তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন তার সমসাময়িক হুমায়ূন আহমেদ এবং ইমদাদুল হক মিলনকে। এই কাব্যগ্রন্থকে বলা হয় হুমায়ুন আজাদের শ্রেষ্ঠ কাব্য গ্রন্থ। ১৯৮৭ সালের মার্চে প্রকাশিত হয় তার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল’। আর তার পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’ প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অমর একুশে বইমেলায়। এরপর তার আরও দুটো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। আট বছর পর ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু’ ও ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়েছিল ‘পেরোনোর কিছু নেই’।
হুমায়ুন আজাদের সৃষ্টিকর্মে ভাষা চিন্তা, ভাষা বিজ্ঞান, সমসাময়িক থেকে রাজনৈতিক, সাহিত্য, মুক্ত বুদ্ধি চর্চা, ধর্মান্ধতা, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কারবিরোধিতা, যৌনতা, নারীবাদ সমস্ত বিষয়ই এসেছিল। ধর্মান্ধতা, উগ্রতা, ভণ্ডামির বিরুদ্ধে আজীবন কলমে প্রতিরোধ গড়েছেন হুমায়ুন আজাদ। এর ফোলে তার উপর হামলা হয়েছে। শাসকের রক্তচক্ষু বারবার চোখ রাঙ্গিয়েছে, অথচ তিনি চাবুকের কষাঘাত চালিয়েছেন দুর্নীতিবাজ, খুনি, ভণ্ডদের বিরুদ্ধে। শাসকের বহু প্রলোভনও ছিল কিন্তু লাথি মেরে এড়িয়েছেন সেসবও। তিনি খাপখোলা সমালোচনা যেমন করেছেন, আলোচনা আর জ্ঞানগর্ভ সৃষ্টিকর্মে সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা ভাষাকে। হুমায়ুন আজাদ জনপ্রিয়তার পিছু ছোটেননি। কোন রাখঢাক ছাড়াই নির্দ্বিধায় সমালোচনা করেছেন অন্যায়ের, সে যে-ই হোক। সুবিধাবাদী, লোভী রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ হোক, সাহিত্যিক হোক, আমলা হোক; সবার ভণ্ডামি ও কাপুরুষতার কথা লিখে গেছেন। এ কারণে তার বই যেমন নিষিদ্ধ হয়েছে, তার উপর আরোপ করা হয়েছে এক প্রকার অদৃশ্য নিষেধাজ্ঞা, এসেছে অবর্ণনীয় মানসিক এবং শারীরিক আঘাত। সেই উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে লেখার ফলে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে একুশে বইমেলা থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিজের বাসায় ফেরার পথে ঘাতকেরা তার উপর অতর্কিত হামলা চালায়। প্রথমে নেয়া হয় ঢাকার সিএমএইচে, পরে থাইল্যান্ডে চিকিৎসায় তিনি খানিকটা সুস্থ হন।
সেই বছরই ৭ আগস্ট বিখ্যাত জার্মান কবি হাইনরিখ হাইনের ওপর গবেষণা বৃত্তি নিয়ে জার্মানি গেলেন তিনি। ১১ আগস্ট রাতে একটি অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পর হঠাৎই শরীর খারাপ হয়ে গেল তার। কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। যে মৃত্যুর জন্য সবচেয়ে বড় দায়ী বইমেলা থেকে ফেরার পথে তার উপর সেই উগ্রবাদীদের হামলা।
হুমায়ুন আজাদ তার মৃত্যুতে হয়তো তিনি শারীরিকভাবে বিলীন হয়েছেন। কিন্তু তার আদর্শ, তার আদর্শ, তার মানবতাবোধ, তার সৃষ্টিকর্ম তো চিরকাল থাকবে। তিনি থাকবেন বাকস্বাধীনতা ও অন্যায়ের প্রতিবাদী প্রতিটি মানুষের অনুপ্রেরণায়। উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন দ্বীপ্তিমান আলোকশিখা হয়ে।
হুমায়ুন আজাদ কতখানি মেধাবী ছিলেন তার একটা কাহিনী বলি। ১৯৮৪ সাল। হুমায়ুন আজাদের তখন বয়স ৩৭ বছর। ওই বয়সেই তার সম্পাদিত গ্রন্থ ‘বাংলা ভাষা’-র প্রথম খণ্ড বেরিয়ে গেছে। একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে তিনি তার নিজ রুমে বসে আছেন। এমন সময় রুমে প্রবেশ করেন বিশ্বভারতীর এক প্রবীণ বাংলার অধ্যাপক। তিনি অফিস রুমে প্রবেশ করেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডক্টর হুমায়ুন আজাদকে কোথায় পাবো বলতে পারেন?’ হুমায়ুন আজাদ বললেন, ‘আমিই হুমায়ুন আজাদ।’ বিশ্বভারতীর অধ্যাপক বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার বিশ্বাস হয় না। যিনি বাংলা ভাষা সম্পাদনা করেছেন তার বয়স এত কম হতে পারে না।’ হুমায়ুন আজাদ বলেন, ‘কতো হওয়া উচিত?’ অধ্যাপক এবার খোলাখুলিই বললেন, ‘অন্তত পঁচাত্তর তো হওয়ার কথা, এর আগে এমন জ্ঞান হতে পারে না।’
আজ প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক, কবি ভাষাবিজ্ঞানী, প্রথাবিরোধী এবং বহুমাত্রিক লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের জন্মদিন। জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানাই এই অসামান্য লেখকের প্রতি।
সূত্র - হুমায়ুন আজাদের শ্রেষ্ঠ কবিতা।
হুমায়ুন আজাদের রাজনৈতিক প্রবন্ধ সমগ্র।
‘বাবার বেড়ে ওঠা’, আমার বাবা/ মৌলি আজাদ
এই বাঙলার সক্রেটিস- শরীফা বুলবুল।
আততায়ীদের সঙ্গে কথোপকথন / হুমায়ুন আজাদ।
ahmadistiak1952@gmail.com
সবগুলো ছবিই ‘হুমায়ুন আজাদ’ ফেইসবুক পাতা থেকে প্রাপ্ত।
Comments