মহামারিতে ভারতের অসহায় আত্মসমর্পণ ও কেরালার সাফল্য
ভারত আজ কাঁদছে করোনার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করে। হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে শুধুমাত্র একটু অক্সিজেনের অভাবে। হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সারা বিশ্ব ভারতের এই দুর্যোগে। দুর্যোগ বললে কম বলা হবে মহা দুর্যোগ।
তবে, এটা কিন্তু সমগ্র ভারতের চিত্র নয়। দিল্লিতে যখন অক্সিজেনের তীব্র সংকট তখন কোরালার মতো ছোট একটি প্রদেশ নিজেদের অক্সিজেনের চাহিদা মিটিয়ে অন্যান্য প্রদেশগুলোতেও দিচ্ছে।
এখন পর্যন্ত যা অবস্থা তাতে দেখা যাচ্ছে মহারাষ্ট্র ও উত্তর প্রদেশের অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। সেই তুলনায় কেরালাতে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। অথচ করোনার প্রথম ধাক্কায় কেরালা ছিল সংক্রমণের হটস্পট।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সেকেন্ড ওয়েভে এসে ভারতে রোজ যে এই লক্ষ লক্ষ রোগী কোভিডে আক্রান্ত হচ্ছেন, তার আসল কারণটা যে ঠিক কী তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা খুব নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছেন না।’
প্রতিবেদনটি আরও বলছে যে ভারতে ভাইরাসের একটি ডাবল মিউটেটেড ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে এটা যেমন ঠিক, তেমনি সারা দেশে কোভিড প্রোটোকল মানার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে চূড়ান্ত শিথিলতা। কারন হিসেবে আরো বলছে যে গত দেড় মাসে হরিদ্বারের কুম্ভমেলায় জড়ো হয়েছেন লক্ষ লক্ষ হিন্দু পুণ্যার্থী, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে সব দলের নেতারাই ভাষণ দিয়েছেন বড় বড় জনসভায়।
কেরালা পারলেও কেন মহারাষ্ট্র ও উত্তর প্রদেশ পারল না, তা নিয়ে হয়তো বিভিন্ন আঙ্গিকে আলোচনা করা যায়। কোথায় ভুল ছিল আর কোথায় অবহেলা ছিল সেসব নিয়ে নিশ্চয়ই একদিন চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে। তবে আজ আমরা একটু বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব তিনটি প্রদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে।
মহারাষ্ট্র ভারতের সবচেয়ে ধনী প্রদেশ। যেখানে ক্ষমতায় শিব সেনা নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায় মহারাষ্ট্রে করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা অন্যান্য সব প্রদেশ থেকে বেশি। গত বছরও এই প্রদেশে করোনার সংক্রমণ খুব বেশি ছিল। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে যে মহারাষ্ট্র সরকার গতবারের অভিজ্ঞতা থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি।
এবার দেখা যাক ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র প্রদেশগুলোর একটি উত্তর প্রদেশের দিকে। উত্তর প্রদেশের ক্ষমতায় বিজেপি সরকার। করোনা ঢেউয়ের প্রথম ধাক্কা বেশ ভালো ভাবে সামাল দিতে পারলেও দ্বিতীয় ঢেউয়ে তছনছ হয়ে গেছে ভারতের সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশটি।
বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উত্তর প্রদেশের সরকার করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউের সম্ভাব্য বিপদটা আঁচ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। উত্তর প্রদেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করোনার প্রকোপ কম ছিল। তখন সরকারের উচিত ছিল অক্সিজেন ব্যাংক তৈরি করা ও হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো। কিন্তু সরকার সেদিকে কোনো নজর দেয়নি। ফলাফল এই রাজ্য আজ করোনা ভাইরাসের হটস্পটগুলোর একটি।
আবার আসা যাক কেরালার দিকে। কেরালার শিক্ষার হার ভারতের অন্য অনেক প্রদেশের চেয়ে অনেক বেশি। আর কেরালায় ক্ষমতায় বাম সরকার।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান দেখা গেল তিনটি রাজ্যের। গত বছর যখন করোনার ছোবলে কেরালা বিপর্যস্ত তখন রাজ্য সরকার মনোযোগ দেয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর। তারই অংশ হিসেবে তারা অক্সিজেন উৎপাদনে মনোযোগ দেয়। এনডিটিভির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় শুধু গত এক বছরেই কেরালাতে অক্সিজেনের উৎপাদন বেড়েছে ৫৮ শতাংশ। কেরালার দৈনিক অক্সিজেন উৎপাদনের সক্ষমতা এখন ২০৪ টন। তারা তাদের নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে সরবরাহ করছে তামিলনাড়ু, কর্নাটক ও গোয়াতে।
তিনটি রাজ্যের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও করোনা পরিস্থিতির একটা তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা গেল। তাতে দেখা গেল যে দেশের সবচেয়ে ধনী প্রদেশ হয়েও করোনার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল আর অন্যদিকে গরিব কিন্তু শিক্ষিত প্রদেশ হয়ে করোনা মোকাবেলায় নিজের প্রদেশ সামাল দিয়ে অন্য প্রদেশের পাশে দাঁড়াল।
ফলাফল দৃশ্যমান। মহারাষ্ট্র ও উত্তর প্রদেশে অক্সিজেনের জন্য হাহাকার; বাড়ছে শ্মশান ও কবরস্থানের আকার আর অন্যদিকে কেরালার নাগরিকেরা তাদের রক্ষা কবচ অক্সিজেনের সরবরাহ নিয়ে ভালোভাবেই সামাল দিচ্ছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। মহারাষ্ট্র ও উত্তর প্রদেশ যখন ধর্মান্ধতায় মগ্ন তখন কেরালা ব্যস্ত ছিল স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে।
এই মহামারির সময়ও এটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে ভারত সরকার যে রাজনীতি ও ধর্মের চেয়ে মানুষ বড়। মানুষ বিনে রাজনীতি বা ধর্ম অসার।
আরও পড়ুন:
Comments