প্রবাসে

উচ্চশিক্ষা: করোনাকালে কিছু বিক্ষিপ্ত ভাবনা

ছবি: সংগৃহীত

‘সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা

তোমার বেলায় নেব সখী তোমার কানের সোনা’

বাংলাদেশের খ্যাতনামা অভিনেত্রী কবরী চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আমরা স্কুলে পড়ার সময় এই গানটি সবার মুখে মুখে ফিরত। করোনা কখন যে কার জীবন নিবে তা আর কেউ জানে না। একাত্তর টিভির একজন প্রযোজক করোনা আক্রান্ত হয়ে সন্তান জন্ম দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। হাসন রাজার গানের মতোই বলতে হয়— কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরই মাঝার।

মৃত্যুর মিছিলেও জীবন থেমে থাকে না। আমার মন বিক্ষিপ্ত থাকলে লিখতে ইচ্ছে করে। আমাদের কর্মই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। মানুষ মানুষের জন্য। প্রতিটা পেশার মাধ্যমেই মানুষ অবদান রাখতে পারে। কোনো পেশাই ছোট নয়। প্রতিটা পেশা কত গুরুত্বপূর্ণ এটা করোনাই আজ আমাদের শিখিয়েছে। তবে কিছু পেশার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান এবং জগৎ তৈরি হয়। কিন্তু শিখতে হয়। উচ্চশিক্ষা হচ্ছে মানুষের জ্ঞান তৈরির প্রধান হাতিয়ার। উচ্চশিক্ষাকে দিতে হয় সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার।

পৃথিবীর প্রতিটি দেশে বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এই জ্ঞান তৈরির প্রদান কেন্দ্র। নতুন জ্ঞান শুধু তৈরি হয় না, তা বাস্তবায়িত হয় জীবন যাত্রার উন্নতি হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকেই এই খাতটি সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। এটার জন্য কাউকে আসলে দায়ী করা যায় না। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কখনই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি। এছাড়া জমি দখলের মতন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার চেয়ে রাজনীতি নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিল, এখনো আছে। সময় এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি করার প্রাণকেন্দ্রে পরিণীত করার। এর জন্য দরকার সদিচ্ছা এবং সামগ্রিক ভাবে একটা পরিকল্পনা।

করোনার কারণে একবছরেরও বেশি সময় ধরে ছাত্ররা বসে আছে, শিক্ষকরা বসে আছে। সেশন জট চেপে বসছে। সেশন জট নামক একটা দৈত্য থেকে কিছুদিন আগেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুক্ত ছিল, এখন আবার চলে যাচ্ছে আগের যুগে যখন চার বছরের ডিগ্রি আট বছরে পাওয়া যেত। কিন্তু হা হুতাশ করে লেখা লিখার মানুষ আমি নই। এই একটি বছর কেন বিভিন্ন ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করল না সেটা আমার বোধগম্য নয়। অনলাইনে পড়ানোর সমস্যা থাকলে, রেগুলার কোর্সগুলো সেলফ স্টাডির মতো করে কোর্স-মেটেরিয়ালগুলো ইমেইল করে পড়ান যেত। গ্রেড নিয়ে মাথা ব্যথার কোনো দরকার ছিল না, ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পাস/ফেল/ইন কমপ্লিট, এই ধরনের গ্রেডগুলো দেওয়া যেত। তারপরও ছাত্ররা লেখাপড়ার মধ্যে থাকত। এছাড়া সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিছু কিছু অনলাইন মাস্টার্স ডিগ্রির সিস্টেম ডেভেলপ করার চেষ্টা করতে পারত। এর মাধ্যমে রেভেনিউ আনা যেত। এখন লকডাউন বুঝলাম, কিন্তু পৃথিবীর সব দেশে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ভাবে এই শিক্ষা খাতটি সচল রাখতে চেষ্টা করছে। আমার আজকাল সিংহভাগ সময় যায় এই ধরনের নতুন প্রোগ্রামের কমিটিগুলোতে কাজ করতে করতে। আন্ডার গ্র্যাজুয়েট এবং গ্র্যাজুয়েট ১০০ জনের উপর ছাত্রদের নিয়ে পুরো একটা রিসার্চ সিম্পোজিয়াম আমরা ধাপে ধাপে করে ফেলতে পারছি জুম এবং টিম এর দ্বারা রেকর্ডেড সেমিনারের মাধ্যমে। করোনা আমাদের বিভিন্ন ভাবে শিক্ষাকে সচল রাখার পদ্ধতি শেখাচ্ছে, তবে এই ভিশনগুলো আসতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পর্যায় থেকে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু জ্ঞান তৈরি করেনা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উদ্যোক্তা হতে সাহায্য করে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন এবং রাসায়নিক প্রযুক্তি/প্রকৌশল বিভাগে পড়ি। আমাদের সিলেবাসে একমাসের জন্য ইন্টার্নশিপ এর ব্যবস্থা ছিল। আমি এবং আর কিছু বন্ধু চিটাগাং ইউরিয়া সার কারখানায় এই সুযোগটা পেয়েছিলাম। আমি একমাসে সার কারখানায় যা শিখেছি, তা তাত্ত্বিক পড়াশোনা থেকেও অনেক কার্যকর ছিল। এছাড়া মাস্টার্সের সময় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানে সাত দিনের একটা ট্রেনিং এ গিয়েছিলাম। মনে আছে আমার গ্রুপের প্রকল্পটি প্রথম হয়েছিল। আমরা চিনিকলের চিটাগুড় থেকে অক্সালিক এসিড নামে একটা রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করার একটি কোম্পানি দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলাম। আমেরিকাতে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টার্ট আপ কোম্পানি তৈরি করার জন্য সাহায্য করা হয়। নতুন আবিষ্কারগুলো থেকে নতুন পণ্য তৈরি করার জন্য জায়গাও দেওয়া হয়, এদেরকে বলে ইনকিউবেটর। এটা পরিচালনার জন্য সরকারের কাছে টাকা চেয়ে গ্রান্ট লেখা যায়, ব্যাংকের কাছে চাওয়ার কোনো দরকার নেই। আমেরিকার এনএসএফ (NSF) এবং এনআইএইচ (NIH) গ্রান্ট মূল্যায়ন করে এই কোম্পানিগুলো শুরু করার জন্য বিভিন্ন ধাপে ধাপে টাকা দেয়। আমার বিভাগের বেশ কয়েকজন প্রফেসরের এই ধরনের কোম্পানি আছে। বাংলাদেশে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের উদ্যোগ চালু করা উচিত, যাতে নতুন প্রজন্ম উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য পৃষ্ঠপোষকতা পায়।

সম্প্রতি ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটের প্রধান আদর পুনেওয়ালার টুইটের বিষয় হলো আমেরিকা যেন তার দেশ থেকে ভ্যাকসিনের কাঁচামাল রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। পৃথিবীর একটি প্রধান ভ্যাকসিন তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান আমেরিকার কাছে মুখাপেক্ষী হয়ে আছে কাঁচামালের জন্য। আমার মনে আছে, আমেরিকার একটি সেরা গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক নর্থ ওয়েস্ট ন্যাশনাল ল্যাবে আমাদের কাজ কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল শুধুমাত্র চীন থেকে একটি রাসায়নিক সলভেন্ট না আসার জন্য। দক্ষ জনবল এবং গবেষণার উপকরণের বিশাল ইন্ডাস্ট্রি এই ধরনের স্টার্ট আপ কোম্পানির মাধ্যমে ধাপে ধাপে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

এর আগেও এই বিষয়টা তুলেছি, বাংলাদেশে একটা গ্র্যাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়/ইন্সটিটিউট করা এখন সময়ের দাবি। চীন এবং ভারত এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেই করেছে। এর মাধ্যমে প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা সম্ভব। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার স্থবিরতা, দক্ষ জনবলের দুর্বলতা সেটা কাটিয়ে ফেলা সম্ভব। এমনকি এই ইনকিউবেটরগুলো এর সঙ্গে যুক্ত করে একটা পৃথিবী-বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান করা সম্ভব যা পিএইচডি এবং পোস্টডক্টরাল গবেষণার প্রাণকেন্দ্র হতে পারে। আগেই বলেছি, উচ্চ শিক্ষার কাঠামো তৈরি করার জন্য দরকার হচ্ছে সুদূর প্রসারী চিন্তা ভাবনা, এই ভিশন বাস্তবায়নে এখনই উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

 

সাইফুল মাহমুদ চৌধুরী: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস এট আরলিংটনের রসায়ন এবং প্রাণরসায়ন বিভাগের অধ্যাপক

Comments

The Daily Star  | English

Election in first half of April 2026

In his address to the nation, CA says EC will later provide detailed roadmap

4h ago