টিকা নেওয়ার পরের অনুভূতি
কোভিডের টিকা নিলাম। না কোন ব্যাথা তো লাগলো না! ছোট্ট একটা সাধারণ কালো পিঁপড়া কামড় দিলে যেমন লাগে সুঁচ ফোটানোর অনুভূতি তেমনই মনে হলো। এর বাইরে সব স্বাভাবিক। শারীরিক আর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। কিন্তু, মানসিকভাবে যতটা আনন্দ হলো, ব্যবস্থাপনায় যতটা মুগ্ধ হলাম, বাংলাদেশি একজন নাগরিক হিসেবে যতটা ভালো লাগলো সেটাতো অবর্ণনীয়।
আমার টিকাদানের কেন্দ্র ছিল ঢাকার মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। নির্ধারিত ওয়েবসাইট ‘সুরক্ষা’য় গিয়ে নিবন্ধন করেছিলাম ১০ ফেব্রুয়ারি বুধবার দুপুরে। নিবন্ধনের পর মনে হলো এখুনি গিয়ে টিকা দিয়ে আসলে কেমন হয়? একটা রিকশা নিয়ে হাসপাতালের সামনে থামতেই চোখে পড়লো বিভিন্ন দূতাবাসের অনেক গাড়ি। হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। বছর দুয়েক আগে উদ্বোধন করা হাসপাতালটি বেশ ঝকঝক করছে।
টিকাদানের নির্ধারিত কক্ষে ঢোকার আগে দেখি দুজন স্বেচ্ছাসেবক। নিবন্ধন কার্ডটা দেখাতেই তারা ভেতরে প্রবেশ করতে বললেন। কোন ভিড় নেই। লাইন নেই। ধাক্কা-ধাক্কি নেই। একটি টেবিলের সামনে যেতেই কর্মীরা তাদের খাতায় নিবন্ধন করলেন। এরপর আমার স্বাক্ষর দিতে বললেন। জানালেন আজকে প্রথম ডোজ। পরের ডোজ একমাস পর। সেই তারিখ লিখে দিয়ে আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন। আমি আশেপাশ দেখছিলাম। ইশশ! সব হাসপাতালগুলো সবসময় যদি এমন ঝকঝকে থাকতো!
আমার অপেক্ষার পালা কয়েক মিনিটেই ফুরাল। আমাকে অরেকটি টেবিলের কাছে যেতে বলা হলো। জানলাম, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স ফারিয়া আক্তার আমার টিকা দেবেন। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘সুঁচের ব্যাথা টেরই পাবেন না।’ আসলেই টের পেলাম না। ফারিয়া আপার সঙ্গে থাকা আরও চার-পাঁচজন নার্সের সবাইকে ধন্যবাদ জানালাম। সরকারি হাসপাতালের সেবা ব্যবস্থাপনা যে এতো ভালো হতে পারে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
টিকা নিয়ে কক্ষ থেকে বের হতেই দেখলাম পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। শুভেচ্ছা বিনিময় হলো। তার সঙ্গে দেখলাম বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত রেন্সজে তেরিংককে। আশেপাশে দেখলাম আরও বেশ কয়েকজন কূটনীতিককে। চেনা-পরিচিত কয়েকজন সাংবাদিককেও দেখা গেল।
জানলাম, বিদেশি কূটনীতিকদের জন্য মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট হাসপাতালে টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন করা হয়েছে। প্রথমদিনে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জার্মানি, তুরস্ক, ফ্রান্স, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের মিশন প্রধানসহ জনা ত্রিশেক কূটনীতিক টিকা নিয়েছেন। তাদের সঙ্গে টিকা নিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও। এখানে পর্যায়ক্রমে ১২ শ’র বেশি কূটনীতিক যারা বাংলাদেশে আছেন, তারা সবাই ভ্যাকসিন নেবেন বলে জানলাম।
শুনে বেশ ভালো লাগলো। উন্নত অনেক দেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই এখনো টিকা নেই। অথচ বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা টিকা নিচ্ছি। এইতো কয়েকমাস আগেও ভাবাটা এতো সহজ ছিল না যে বাংলাদেশ শুরুর দিকেই টিকা পেয়ে যাবে। কিন্তু, সেটাই এখন বাস্তবতা। সেই বাস্তবতা ফুটে উঠলো কূটনীতিকদের মুখেও।
এই যেমন গতকাল টিকা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত রেন্সজে তেরিংক বাংলাদেশের প্রশংসা করে বলেছেন, ‘আমাকে টিকা নিতে ইউরোপ যেতে হচ্ছে না, আমি এখানেই তা করতে পারছি এবং আজকেই সেটা করেছি। এমন উদ্যোগের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ জানাই। এটা মানুষের মধ্যে আস্থা আনবে।’
গতকাল বিকেলে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে নিজের টিকা নেওয়ার সংবাদ ফেসবুকে দিতে গিয়ে দেখলাম রেন্সজে টিকা দেওয়ার ছবিটাও প্রোফাইল বানিয়েছেন। খবরে পড়লাম ঢাকায় কূটনৈতিক কোরের ডিন আর্চ বিশপ জর্জ কোশারি গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে নিজে টিকা নিয়ে সবাইকে টিকা নেওয়ার আহবান জানিয়ে বলেছেন, ‘দয়া করে সবাই টিকা নিন, যাতে মহামারি ক্ষীণ হয়ে আসে এবং দেশ অগ্রসর হতে পারে।’
আসলেই তাই। টিকা নেওয়া লোকের সংখ্যা যে দ্রুত বাড়ছে তা এখন পরিষ্কার। গণমাধ্যম বলছে, গতকাল টিকাদান শুরুর চতুর্থ দিনে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫১ জন টিকা নিয়েছেন। এর আগে মঙ্গলবার এক লাখেরও বেশি মানুষ টিকা নিয়েছিল। টিকা শুরুর প্রথম চার দিনে সারা দেশে ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৭৬৯ জন টিকা নিয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। টিকা নিয়ে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে এমন খুব একটা শুনিনি।
আমরা জানি, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার এই টিকা কিনে এনে এখন বিনামূল্যে সারা দেশে দিচ্ছে সরকার। ঢাকাসহ সারা দেশে ১০১৫টি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টিকা দেওয়া হচ্ছে। ঢাকায় ২০৪টি এবং ঢাকার বাইরে ২ হাজার ১৯৬টি স্বাস্থ্যকর্মীর দল এসব কেন্দ্রে টিকা প্রয়োগ করছেন। প্রতিটি দল দৈনিক ১৫০ জনকে টিকাদান করতে পারবে। সে হিসেবে দৈনিক তিন লাখের বেশি মানুষকে টিকা দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের।
তবে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি স্বাস্থ্যখাতের লোকজনও টিকা দেওয়ার কাজে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গতকাল বলেছেন, টিকাদান কার্যক্রমে বেসরকারিখাতকেও সম্পৃক্ত করা হবে। এক্ষেত্রে যেন বাণিজ্য না হয়, ব্যবস্থাপনার সংকট না হয় সেটা নিশ্চিত করা উচিত।
সবাই কমবেশি জানেন, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে সার্স জাতীয় এই ভাইরাস মানবদেহে বাসা বাঁধার পর তা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে নানা দেশে। ভাইরাসটি নতুন করোনাভাইরাস হিসেবে পরিচিতি পায়, আর এর সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট রোগ নাম পায় কোভিড-১৯।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে বুধবার পর্যন্ত বিশ্বে ১০ কোটি ৬৫ লাখেরও বেশি মানুষের দেহে সংক্রমণ ধরা পড়েছে, আর মৃত্যু ঘটেছে ২৩ লাখ ৩৩ হাজার জনের।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির করোনাভাইরাস রিসোর্স সেন্টারের তথ্য মতে, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১০ কোটি ৭৩ লাখ ২৩ হাজার ৮৫ জন এবং মারা গেছেন ২৩ লাখ ৫৩ হাজার ৭৮২ জন।
বাংলাদেশে করোনার আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। ভাবতে ভালো লাগছে, এক বছর আগে যেখানে সারা দুনিয়াতে করোনা নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল এখন সেই আতঙ্কের বিপরীতে টিকা আছে। করোনা মোকাবিলায় এটাই গত এক বছরে সবচেয়ে ভালো সংবাদ।
করোনা মোকাবিলা নিয়ে কিছু অব্যবস্থাপনা থাকলেও বাংলাদেশে মৃত্যুহার অনেক দেশের তুলনায় কম। এখন যদি দেশের বেশির ভাগ মানুষকে টিকা দেওয়া যায় সেটা আরেক ধাপ অগ্রগতি হবে। আশার কথা হলো, ভ্যাকসিন নিয়ে নেতিবাচক কিছু প্রচারণা চললেও মানুষ টিকার ওপর আস্থা রাখছে। এমনকি যারা এই টিকাকে ভারতীয় টিকা বলে নেতিবাচক কথা বলেছিলেন তাদের অনেকেও টিকা নিচ্ছেন।
দেশে টিকা নেওয়ার আগ্রহীদের সংখ্যা যে বাড়ছে তা পরিস্কার। ফেসবুক ও ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড যৌথভাবে বিশ্বজুড়ে এক জরিপ করেছে। জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের যত মানুষ জরিপের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, তার মধ্যে ৬৪ শতাংশের বেশি কোভিড টিকা নিতে আগ্রহী। ডেটা ফর গুড প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে ফেসবুক একাডেমিক সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে এই জরিপ পরিচালনা করেছে।
বাংলাদেশে টিকা নিয়ে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রচারণা যে ভারতের টিকা আনা হয়েছে। আসলে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার যে ভ্যাকসিন ব্রিটেন, ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলো ব্যবহার করছে, সেই ভ্যাকসিনই তৈরি করছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। কাজেই এটা ভারতের নয়, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকারই টিকা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিওএইচও) বলেছে, বিশ্বে করোনা মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এখনো মূল হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে এই অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ডের টিকা। কাজেই কোনো নেতিবাচক প্রচারণায় বিশ্বাস না করে সবার নিবন্ধন ও টিকা নেওয়া উচিত।
করোনার সময় সরাসরি দায়িত্ব পালন করেছেন এমন লোকজন ছাড়াও ৪০ বছরের বেশি যে কেউ টিকা নিতে পারবেন। এ জন্য সরকারের ‘সুরক্ষা’ প্ল্যাটফর্মের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনে (www.surokkha.gov.bd) গিয়ে নিবন্ধন করতে হবে।
আগে থেকে নিবন্ধন করা না থাকলেও সরাসরি টিকা কেন্দ্রে গিয়েও নিবন্ধন করে টিকা নেওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে টিকা নেওয়ার জন্য ভোটার আইডি কার্ড বা জাতীয় পরিচয়পত্র নিতে হবে।
একটা বিষয় আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে ভ্যাকসিন ছাড়া কোভিড-১৯ থেকে মুক্তির আর কোনো উপায় এখনো বের হয়নি। দয়া করে ভাববেন না যে দেশে করোনা নেই, কাজেই টিকারও দরকার নেই। বরং টিকা দেওয়া মানে আপনি নিরাপদ। কাজেই চলুন আমরা সবাই নিবন্ধন করি, টিকা দিই। নিজে নিরাপদ থাকি, দেশকেও নিরাপদ রাখি।
শরিফুল হাসান, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments