প্রতিবছর বই ছাপানোর দরকার নেই, বিকল্প ভাবুন
আমার ছেলে এখন কানাডার একটা জুনিয়র স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ে। প্রি-স্কুল থেকে সে এখানে লেখাপড়া শুরু করলেও আজ পর্যন্ত আমি আমার ছেলের পাঠ্যবইয়ের কোনো চেহারা দেখিনি। প্রথম প্রথম আমার খুব অশান্তি লাগতো বই-খাতা-কলম-পেনসিল ছাড়া স্কুল হয় কিভাবে? কিন্তু, এটাই সত্যি শুধু একটা ব্যাগের মধ্যে সামান্য খাবার, স্কুল থেকে দেওয়া একটা প্রিন্টেড নোট ফাইল নিয়েই চলছে তার প্রাইমারি থেকে জুনিয়র স্কুল পর্যন্ত।
তার মানে কি ওদের পাঠ্যবই নেই? অবশ্যই আছে, সিলেবাসও আছে। কিন্তু, সেগুলো প্রতিদিন কাঁধে বা ব্যাগে করে স্কুলে নিয়ে যেতে হয় না, নিয়ে আসতে হয় না। সেগুলো স্কুলেই থাকে, সেখানেই লেখাপড়া করতে হয়।
কানাডার স্কুলের ছেলেমেয়েরা ক্লাস-লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে লেখাপড়া ও অনুশীলন করে। ক্লাস টেস্ট দিয়ে শিক্ষকের দেওয়া সামান্য ‘হোম ওয়ার্ক’ নিয়ে বাসায় ফেরে! সেটাও তাদের স্কুল থেকে দেওয়া প্রিন্টেড ফরমেটের লুজ শিটে প্রতিদিন করে নিয়ে যেতে হয়। এটা করতে তাদের হেলেদুলে আধঘণ্টা থেকে একঘণ্টা সময় লাগে।
তাদের মূল লেখাপড়া ও মূল্যায়নের কাজ প্রতিদিনের ক্লাসে-স্কুলেই হয়ে থাকে। কখন পরীক্ষা হয়, টেস্ট হয় সেটা আমরা জানতেও পারি না। কিন্তু, বছরের নির্দিষ্ট সময়ে খামের মধ্যে সন্তানের গ্রেড, পারফরমেন্স ও রিপোর্ট কার্ড ঠিকই বাসায় চলে আসে।
যতটুকু জানি প্রতিবেশী শ্রীলংকাতেও একই ব্যবস্থা চালু আছে। সেখানেও স্কুলের বই ব্যবহার করেই ছেলেমেয়েদের পড়তে হয়। বিশ্বের উন্নত-উন্নয়নশীল অনেক দেশেই এই ব্যবস্থা চালু আছে।
কানাডা-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন ব্যবস্থা যখন দেখি তখন নিজের দেশের কথা মনে হয়। বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে বছরের শুরুর দিনে মানে ১ জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী ছেলেমেয়েদের মাঝে নতুন বই বিতরণ করেন। যাকে ‘বই উৎসব’ বলা হয়। অনেক অনিয়মের মধ্যে এটাও একটা সাফল্য যে, নিয়ম করে ঠিক সময়ে শিশুদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হয়। এ জন্য সরকারকে সাধুবাদ।
প্রশ্ন হচ্ছে— প্রতিবছর ‘শিক্ষা উৎসব’র নামে হাজার কোটি টাকা খরচ করে কোটি কোটি বই ছাপানোর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা-পদ্ধতিও আছে কি না, চালু করা যায় কি না?— সে প্রসঙ্গ। যেহেতু প্রতিবছর একই বই নতুন মোড়কে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, সে কারণে কাজটা মোটেই কঠিন নয়, সহজেই করা সম্ভব। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ব্যবস্থা-পদ্ধতি অনেক বছর ধরে চালু আছে।
এনসিটিবি’র তথ্য মতে, ২০২১ শিক্ষাবর্ষের প্রাক-প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে বিতরণের জন্য প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপানো হবে। এর মধ্যে মাধ্যমিকে প্রায় ২৪ কোটি ৪১ লাখ বই ছাপানো হবে। এতে সরকারের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৫০ কোটি টাকা।
প্রাথমিকের বইয়ের চাহিদা এখনো না আসলেও গত বছরের চাহিদা ধরে প্রায় ১০ কোটি ৫৪ লাখ বইয়ের দরপত্র দেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক মিলে বিনামূল্যের ৩৫ কোটি বই ছাপাতে সরকারের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ১,১০০ কোটি টাকা।
বই ছাপার সঙ্গে যুক্ত আছে প্রকাশনা শিল্প, শ্রমশক্তি ও বিশাল পুঁজি। কিন্তু, প্রতিবছর একই বই ছাপাতে যেমন প্রচুর অর্থের দরকার একই সঙ্গে সরকার ও প্রশাসনকে এদিকে গভীর মনোযোগ রাখতে হয়। বই বিতরণের জন্য সর্বত্র একটি বাড়তি আয়োজন করতে হয়। এর যোগাযোগ ও ব্যবস্থাপনার একটি বিরাট দিক আছে।
কিন্তু, বছর বছর বই ছাপার যদি কোনো বিকল্প ব্যবস্থা থাকে, তাহলে সে পথে না গিয়ে কেনো শিক্ষার সীমিত বাজেটের মধ্যে এই বিপুল অংকের টাকা খরচ করে প্রতিবছর বই ছাপা হয়— তা বোধগোম্য নয়!
এ কাজের সঙ্গে যুক্ত আমলা, নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিকরা কি বিষয়টি কখনো ভেবে দেখেছেন? ভেবে দেখেননি, এগুলো নিয়ে তাদের ভাবার সময় নেই অথবা তারা এগুলো নিয়ে ভাবতে চান না।
শত শত আমলা ও নীতিনির্ধারক প্রতিমাসে সরকারি টাকায় বিদেশে শিক্ষণ-প্রশিক্ষণে যান। কিন্তু, তারা কী শিক্ষা নেন, কী অভিজ্ঞতা অর্জন করেন? এর কোনো বাস্তব প্রয়োগ তো দেখি না, উন্নয়নেও এর ভূমিকা দেখি না।
আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকদের আগ্রহ কেবল টাকা-পয়সা ভিত্তিক প্রকল্পের দিকে। যেখানে স্বার্থ-সুবিধা ও কমিশন বাণিজ্য আছে, যেখানে অনাহুত খবরদারি-মাতব্বরি আছে সেখানে তাদের আগ্রহ বেশি।
আমাদের সম্পদ কম, সমস্যা অনেক। কিন্তু, আমাদের অনেক সংকট সমাধানের বড় সমস্যা অর্থ নয়, সংকট উপযুক্ত নীতি ও পদ্ধতির। অর্থের সংকট, সম্পদের সীমাবদ্ধতার কথা নির্বোধ জনগণকে বোঝানো হয়। কিন্তু, আমলা-মন্ত্রীদের বিলাসিতার কোনো ঘাটতি নেই।
যে অভিজ্ঞতার গল্প দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম সেখানে ফিরে যাই। সরকার প্রতিবছর শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে পাঠ্যবইগুলো না দিয়ে বইগুলো স্কুলের ক্লাস-লাইব্রেরিতে রাখবে। সেখান থেকে প্রতিদিন শিক্ষার্থীরা স্কুলে গিয়ে বইগুলো নিয়ে পড়বে এবং শিক্ষকরাও তাদের সেখান থেকে পড়াবেন ও শেখাবেন।
পাঠ্যবইয়ের লেখাপড়া ছেলেমেয়েরা স্কুলেই শেষ করে আসবে। শিক্ষকরা বাসার জন্য শিশুদের সিলেবাস অনুযায়ী ফরমেট করা সামান্য বা প্রয়োজনীয় ‘হোমওয়ার্ক’ দেবেন। সেটা তারা বাসা থেকে করে নিয়ে আসবে।
এভাবেই পালা করে বছরের পর বছর শিক্ষার্থীরা এ বইগুলো ব্যবহার করবে। এই পদ্ধতি চালু করা গেলে প্রতিবছর বিপুল অর্থ খরচ করে বই ছাপাতে হবে না। বই ঠিক মতো ছাপা হলো কি না তা নিয়ে তাদের আর নির্ঘুম রাত কাটাতে হবে না।
এটা করতে আমাদের অনেক কিছু করার দরকার নেই, শুধু শিক্ষা-কাঠামোয় কিছুটা ব্যবস্থাগত পরিবর্তন আনতে হবে।
উত্তর আমেরিকার শিক্ষা হচ্ছে বিশ্বের সেরা শিক্ষাগুলোর একটি সেখানে এ পদ্ধতি চালু আছে অনেক বছর ধরে। সীমিত সামর্থের দেশ বাংলাদেশ এ পদ্ধতি সহজে চালু করতে পারে।
কেউ বলতে পারেন প্রতিবছর পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তন হলে, সেটা না ছাপিয়ে তো উপায় নেই! প্রশ্ন হচ্ছে সেরকম কিছু হলে ভিন্ন কথা।
আমার মনে হয় না প্রতিবছর এই কাজ হয়। এ ক্ষেত্রে আমার মত হচ্ছে— পাঠ্যপুস্তকে যদি কোনো মৌলিক পরিবর্তন না ঘটে তাহলে তথাকথিত গদবাঁধা পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন নেই। দুই-একটা গদ্য-পদ্য-অধ্যায় পরিবর্তনে শিক্ষার গুণমানের কোনো তারতম্য হয় না বিধায় সেটা করা জরুরি নয়। তাহলে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কেনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না?
পাঠ্যপুস্তকে যদি পরিবর্তন করতেই হয় অন্তত ৫ থেকে ১০ বছর পরপর এই কাজটি করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন নীতিমালা অনুসরণ করে। সরকারও শিক্ষা-সংশ্লিষ্টদের নিয়ে প্রচলিত নীতির পুনর্বিন্যাস করতে পারে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক যুগান্তকারী মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটলে তা নিয়ে কাজ করা যেতে পারে।
আসলে বাংলাদেশের সব কিছুর মধ্যে ফন্দিফিকির ঢুকে গেছে। সে কারণে অর্থনৈতিক প্রকল্পে সংশ্লিষ্টদের আগ্রহ বেশি। আমলা, নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্টরা তাদের স্বার্থ-সুবিধা-বাণিজ্য ও কমিশনের উপযোগী কাজ করতে বেশি আগ্রহী হন। সেটা করেই তারা তাদের প্রচলিত বা নিত্যনতুন ধারাকে যৌক্তিকতা দেন এবং নিজেদের করিৎকর্মা হিসেবে জাহির করেন।
আমাদের দেশের আমলারা শুধু মোটা মোটা অংকের খরচের পথ বের করেন। কিভাবে খরচ কমিয়ে বা খরচ না করে একটা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেওয়া যায়, তা তারা করতে পারেন না, বা করতে চান না!
একটা ব্যবস্থা উন্নত করা বা পরিবর্তনের নামে যে প্রকল্পগুলো তৈরি করা হয়, এর বেশিরভাগই অপ্রয়োজনীয় ও তুঘলকি কাণ্ড। এর চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে— সে সব খাতে দরকারের অনেকগুণ বেশি অর্থ বরাদ্দ নেওয়া হয়। পত্রিকার পাতায় প্রায়ই পর্দা, বালিশ, চেয়ার, কাঁটাচামচ ক্রয় ও বিদেশ ভ্রমণের অবিশ্বাস্য, অসঙ্গতিপূর্ণ নানা প্রকল্পের মুখরোচক সংবাদ দেখতে হয়।
প্রতিবছর বই ছেপে হাজার কোটি খরচ না করে সে টাকা দিয়ে স্কুলের শিক্ষার্থীদের খাবারের ব্যবস্থা করা যায়। দেশের অনেক স্কুলের অবকাঠামো অত্যন্ত দূর্বল-শোচনীয়— সেগুলো সংস্কার-মেরামত করা যায়।
শিক্ষার মান নিয়ে অনেক কথা আছে। এর উন্নয়ন ও গবেষণায় জন্যে অর্থের প্রয়োজন। দেশে দূর্যোগকালীন শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। বর্তমান মহাদূর্যোগে লেখাপড়া ছাড়া অটোপ্রমোশন দিয়ে চলছে, যা শিক্ষার জন্য মহাবিপদ তৈরি করছে।
ডিজিটালাইজেশনের কথা বলা হলেও প্রযুক্তিগত সুবিধা, ইন্টারনেট, ডাটার অভাবে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার বাইরে আছে। এ সমস্যা সমাধানের কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা, উদ্যোগ দেখছি না। চলমান বিপদ-দূর্যোগ সহসাই শেষ হওয়ার নয়। এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও অর্থায়ন দরকার।
শেষ কথা, আমাদের দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে পাহাড়সম সমস্যা আছে সে কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এর সব সমস্যাই অর্থনৈতিক নয়। এই সমস্যার অন্তত অর্ধেক দূর করা সম্ভব কেবল উপযুক্ত নীতি, পদ্ধতি, ব্যবস্থাগ্রহণ ও প্রয়োগের মাধ্যমে। সে জন্য দরকার কিছুটা সততা ও দেশপ্রেম। সেটা বিদেশ থেকে আমদানি করা সম্ভব নয়, দেশ থেকেই করতে হবে!
ড. মঞ্জুরে খোদা, প্রাবন্ধিক-গবেষক, ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments