অবৈধ মধুমতি মডেল টাউন এখন নাম বদলে ‘নান্দনিক হাউজিং’

সুপ্রিম কোর্ট অবৈধ ঘোষনার পর ‘নান্দনিক হাউজিং’ নামে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে মধুমতি মডেল টাউন। সম্প্রতি তোলা ছবি। ছবি: হেলেমুল আলম

সাভারের বন্যা প্রবাহ অঞ্চলে অবৈধভাবে তৈরি মধুমতি মডেল টাউনের কার্যক্রম এখনও চলছে। সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ অমান্য করে এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও চোখে টিনের চশমা দিয়ে রেখেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

২০০৫ সালে এই প্রকল্পটি অবৈধ ঘোষণা করেন উচ্চ আদালত। সম্প্রতি এই প্রকল্প এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দ্য ডেইলি স্টার দেখতে পায়, ‘নান্দনিক হাউজিং’ নামে সেখানে চলছে আবাসন প্রকল্পটির কার্যক্রম।

শুধু তাই নয়, সুপ্রিম কোর্ট এই প্রকল্পটিকে অবৈধ ঘোষণা করে রিভিউ পিটিশন বাতিল করলেও প্লট মালিকরা প্রকল্প এলাকায় বিভিন্ন কাজ করছেন।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্প্রতি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। এই প্রকল্পটিকে নগর অঞ্চল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা কিংবা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) এটিকে বন্যা প্রবাহ অঞ্চল থেকে বাদ দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে চিঠিতে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বন্যা প্রবাহ অঞ্চল ঠিক রাখার জন্য সর্বোচ্চ আদালতের আদেশের পর প্লট মালিকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের এমন চিঠি শীর্ষ আদালতের রায়ের লঙ্ঘন।

২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ পাঁচটি রিভিউ পিটিশন বাতিল করে তার পূর্বের রায় বহাল রাখেন। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে যে জলাভূমিতে মধুমতি মডেল টাউন অবৈধভাবে আবাসন প্রকল্পটি গড়ে তুলেছিল সেটি পুনরুদ্ধার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল কর্তৃপক্ষকে।

৫৫০ একর এলাকায় থাকা সব নির্মাণ ভেঙে ছয় মাসের মধ্যে জলাভূমিটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে প্রকল্পের মালিক মেট্রো মেকারস অ্যান্ড ডেভেলপারস লিমিটেডকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট। ১৯৯৭ সালের ঢাকা সিটি মাস্টার প্ল্যানে এই জমিটি বন্যা প্রবাহ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

শীর্ষ আদালত প্রকল্প মালিককে নির্দেশ দেন, সব প্লটের ক্রেতাদের রেজিস্ট্রেশন ফিসহ দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ ফেরত দেওয়ার।

এছাড়াও, প্রকল্পের মালিক ছয় মাসের মধ্যে এই জায়গাটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে ব্যর্থ হলে রাজউককে তা করতে নির্দেশ দেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণার এক বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও প্রকল্পটি এখনও রয়ে গেছে। সেখানে কোনো কাঠামো বা ভবন ভাঙা হয়নি বা সরানো হয়নি। এমনকি প্রকল্প এলাকা থেকে এখন পর্যন্ত কোনো মাটিও সরানো হয়নি।’

২০০৪ সালের আগস্টে এই প্রকল্পের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করে বেলা । আবেদনে বলা হয়, প্রকল্পটি পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, নগর উন্নয়ন আইন এবং রাজউকের বিধি লঙ্ঘন করে তৈরি করা হচ্ছে।

নতুন নাম, নতুন উদ্যমে

আমিন বাজারের কাছাকাছি প্রকল্প এলাকাটি সম্প্রতি পরিদর্শনকালে দেখা যায়, আবাসন প্রকল্পের প্রবেশদ্বারে থাকা মধুমতি মডেল টাউনের বিরাট সাইনবোর্ডটি সরিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো পরিবর্তন নেই।

একটি ছোট্ট নোটিশ বোর্ডে এই প্রকল্পের নাম ‘নান্দনিক হাউজিং’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

হাউজিং এলাকার কেন্দ্রে একটি সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, প্রকল্পটি ‘বন্যা প্রবাহে বাধা সৃষ্টি না করেই তৈরি করা হয়েছে’। প্রকল্পে ‘দুই লাখ গাছ, একটি সুন্দর প্রশস্ত লেক’ রয়েছে এবং এটি ‘তিন হাজার পরিবারের দেড় লাখ মানুষের স্বপ্ন’।

আবাসন প্রকল্পটির ভেতরে দেয়াল দিয়ে অনেক প্লট চিহ্নিত করা রয়েছে। কিছু প্লটে মালিকদের নাম লেখা রয়েছে। সেখানে আবাসন প্রকল্পের নাম হিসেবে উল্লেখ রয়েছে মধুমতি মডেল টাউনের নাম।

প্রকল্প অফিসের কর্মচারী আবদুল্লাহ শেখ জানান, তারা গত এক বছর ধরে মধুমতি মডেল টাউনের পরিবর্তে ‘নান্দনিক হাউজিং’ নামটি ব্যবহার করছেন।

তিনি আরও বলেন, এই আবাসন প্রকল্পে চার হাজার মালিকের ছয় হাজার প্লট রয়েছে। প্লট মালিকরাই এখন প্রকল্পটির তদারকি করছেন এবং কেউ কেউ তাদের প্লট তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রিও করছেন।

প্রকল্প অফিস সূত্রে জানা যায়, সেখানে ইতোমধ্যে ২০টি ডুপ্লেক্স বাড়ি, আটটি রিসোর্ট, প্রায় ৩০০ একতলা ভবন এবং ১৫০টি টিন শেড বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে প্লট মালিক সমিতির সভাপতি এএফ কল্লোল জানান, তিনি আদালতের আদেশ এবং মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক আবেদনের বিষয়ে পরে কথা বলবেন।

কিন্তু, পরবর্তীতে বারবার কল দেওয়া হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।

মেট্রো মেকারস অ্যান্ড ডেভেলপারস লিমিটেডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাদের ফোন নম্বরগুলো বন্ধ পাওয়া গেছে। দুই সপ্তাহ আগে পরিদর্শনকালে দেখা যায়, ঢাকার গ্রিন রোডে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়টি তালাবদ্ধ।

মন্ত্রণালয়ের আবেদন আদালতের আদেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না

রাজউক চেয়ারম্যান সৈয়দ নুর আলম সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর তারা এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে একটি কমিটি গঠন করেছেন।

তিনি জানান, তারা প্রায় পাঁচ থেকে ছয় মাস আগে একটি বৈঠক করেছেন এবং সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগকে সুপ্রিম কোর্টর আদেশ অনুসরণ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন।

তবে আদালতের রায় বাস্তবায়নে তারা কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তা তিনি নির্দিষ্ট করে বলেননি।

২০২০ সালের ১৮ অক্টোবর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বিভাগ-৩ একটি চিঠি দেয় রাজউকের কাছে। চিঠিতে এই প্রকল্পটিকে নগর অঞ্চল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বা ড্যাপের বন্যা প্রবাহ অঞ্চল থেকে এই প্রকল্পের অংশ বাদ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।

গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর মধুমতি মডেল টাউনের প্লট মালিকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে এই চিঠি দেওয়া হয়।

প্লট মালিকদের আবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা চিঠিতে (রাজউককে) বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে বলেছি। সুপ্রিম কোর্ট যদি এই নির্দেশনা দিয়ে থাকেন তাহলে সেটি অনুমোদন পাবে না।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তা বলেন, আদালতের রায় সম্পর্কে তাদের অবহিত করা হয়নি। ‘পাশাপাশি, আবেদনকারীরা আমাদের যে চিঠি দিয়েছে সেখানেও এই তথ্য লুকানো হয়েছে।’

এ বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান সৈয়দ নূর আলম বলেন, ‘আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের আবেদনটি গ্রহণযোগ্য হবে না।’

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘যখন দেশের সর্বোচ্চ আদালত দুবার কোনো প্রকল্পকে অবৈধ ঘোষণা করে এবং প্লট মালিকদের রিভিউ আবেদন সুপ্রিম কোর্ট প্রত্যাখ্যান করেন, তখন ড্যাপে এই অঞ্চলকে নগর হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার কোনো সুযোগ নেই।’

তিনি জানান, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে প্লট মালিকদের এ জাতীয় কোনো আবেদন জমা দেওয়ার এবং সরকারি কর্তৃপক্ষের তা বিবেচনা করার সুযোগ নেই।

‘যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো এই আবেদনের বিষয়টি বিবেচনা করে, তাহলে এর অর্থ হচ্ছে- আদালতের এখতিয়ারে নির্বাহী বিভাগ হস্তক্ষেপ করবে এবং এটি স্পষ্টতই আদালত অবমাননার একটি উদাহরণ।’

তিনি আরও বলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এই জলাভূমি পুনরুদ্ধার করা খুব জরুরি।

দীর্ঘ আইনি লড়াই

২০০৪ সালে হাইকোর্টে দায়ের করা আবেদনে বেলা উল্লেখ করে, প্রকল্পটি যদি অব্যাহত থাকে তবে এলাকার পরিবেশ নষ্ট হবে এবং পরিবেশ দূষিত হবে।

২০০৫ সালের ২৭ জুলাই হাইকোর্ট এই প্রকল্পটিকে অননুমোদিত, অবৈধ এবং জনস্বার্থের বিরুদ্ধে বলে ঘোষণা করেন। আদেশে আরও বলা হয়, এই প্রকল্পের প্লট ক্রেতাদের স্বার্থও রক্ষা করতে হবে।

২০১২ সালের ৭ আগস্ট হাইকোর্টের এই রায় বহাল রাখেন সুপ্রিম কোর্ট। মধুমতি মডেল টাউনকে অবৈধ ঘোষণা করে এই অঞ্চলটিকে একটি মুক্ত বন্যা প্রবাহ অঞ্চল হিসেবে রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন সুপ্রিম কোর্ট।

২০১৩ সালের ১১ জুলাই আপিল বিভাগ ১৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে মেট্রো মেকারস অ্যান্ড ডেভেলপারস লিমিটেডকে সাভারের বিলমালিয়া ও বালিরপুর মৌজার জলাভূমি পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে নির্দেশ দিয়েছেন।

২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে মেট্রো মেকারস অ্যান্ড ডেভেলপারস লিমিটেড এবং প্রকল্পের প্লট মালিকরা রায়ের রিভিউ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের কাছে পাঁচটি পৃথক পিটিশন দায়ের করেন।

২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টর পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ পাঁচটি রিভিউ পিটিশনই খারিজ করেন এবং আগের রায় বহাল রাখেন।

Comments

The Daily Star  | English

Cybergangs breaking into NBR server at will

On May 20, 2024, Chattogram Custom House Deputy Commissioner Mohammad Zakaria was in Kolkata, India, where he had gone for treatment a week earlier.

16h ago