ভ্যাকসিন: এখনো হয়নি মূল সমস্যার সমাধান

ছবি: এএফপি

ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশে পৌঁছাতে পারে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন। তবে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার এই করোনা ভ্যাকসিন বিতরণের আগে বেশ কিছু মূল সমস্যারই সমাধান করতে পারেনি সরকার।

মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে ভ্যাকসিন নিতে ইচ্ছুক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত নাগরিক এবং ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী নাগরিকদের ডেটাবেজ তৈরি করার কথা থাকলেও এখনো তা চালু করা যায়নি।

ভ্যাকসিনের অপচয় রোধে বাধ্যতামূলক অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করা হবে কি না, সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।

এখন পর্যন্ত নয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে পেরেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে আসবে তিন কোটি ডোজ এবং কোভ্যাক্স সুবিধার আওতায় পাওয়া যাবে ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ। জনপ্রতি দুই ডোজ হিসাবে এই ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে চার কোটি ৯০ লাখ মানুষকে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, প্রথম পর্বে ক্যানসার, ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশনের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত এবং ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের পাশাপাশি ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ভ্যাকসিন দেওয়া হবে।

ইতোমধ্যে প্রবীণদের একটি ডেটাবেজ তৈরি করতে বেগ পেতে হচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে। আর দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্তদের কোনো ডেটাবেজই নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম গত রোববার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। এনআইডি ডেটাবেজ আমরা দেখছি। সেখান থেকে এলাকাভিত্তিক ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সীদের তালিকা করা সহজ হবে।’

ডেটাবেজ তৈরি করতে কত সময় লাগতে পারে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য দেননি তিনি।

তিনি আরও বলেন, এখনো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্তদের ডেটা সংগ্রহের চেষ্টা করে যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যান্টিবডি পরীক্ষার মাধ্যমে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হলে এর অপচয় কমানো যেত।

তাদের মতে, অনেকেই করোনা আক্রান্ত হলেও তারা লক্ষণবিহীন এবং তাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। তাদের জন্য ভ্যাকসিনের প্রয়োজন নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানান, ভ্যাকসিন কর্মসূচির প্রথম ব্যবস্থা হিসেবে এটুআই, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং আইসিটি মন্ত্রণালয় একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করতে কাজ করছে।

নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করার পর ভ্যাকসিন দেওয়ার তারিখ ও স্থান এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে। ভ্যাকসিন দেওয়ার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটি ভ্যাকসিন কার্ড দেবে। সেখানে ভ্যাকসিনের ব্যাচ নম্বর এবং এর মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ থাকবে বলে জানান অধ্যাপক খুরশিদ।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং টিকা দেওয়ার ভেন্যু তৈরির কাজ শুরু করেছেন।

দেশজুড়ে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ও বিশেষায়িত হাসপাতালে এই ভ্যাকসিন দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

তিনি আরও জানান, প্রথম পর্যায়ে ভ্যাকসিন পাওয়ার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন স্বাস্থ্য পেশাদার, জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, প্রতিরক্ষা কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা, গণমাধ্যমকর্মী ও ধর্মীয় নেতারা।

তবে, এসব গ্রুপভুক্ত সবাই প্রথম পর্যায়ে ভ্যাকসিন পাবেন না। অধ্যাপক খুরশিদ বলেন, এই গ্রুপগুলোর মধ্যে যাদের বয়স ৬০ বছর বা তার বেশি এবং দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, তারা অগ্রাধিকার পাবেন।

তিনি জানান, সরকার প্রথম পর্যায়ে টিকা দেওয়ার জন্য অগ্রাধিকারের তালিকা তৈরি করছে।

সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া থেকে প্রতিমাসে ৫০ লাখ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন পাবে বাংলাদেশ।

গত সোমবার এই ভ্যাকসিন জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এর জন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রায় ৫৯ মিলিয়ন ডলারও অনুমোদন দিয়েছে। জনপ্রতি দুটি হিসাবে প্রতি মাসে ২৫ লাখ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

তবে, সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকে কর্তৃপক্ষ মনে করছে একসঙ্গে ৫০ লাখ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া যেতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়ার চার থেকে ১২ সপ্তাহ পরে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হলে তা বেশি কার্যকর হয় বলে আমরা বিভিন্ন উত্স থেকে পরামর্শ পেয়েছি।’

জাতীয় দলের ক্রিকেটার, ফুটবলার এবং হকি খেলোয়াড়দের প্রথম পর্বে ভ্যাকসিন দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘সেক্ষেত্রে আমরা একযোগে ৫০ লাখ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়ার পরিকল্পনা করছি। এতে করে ভ্যাকসিনের যে বিপুল চাহিদার চাপ, তা থেকেও কিছুটা মুক্তি পাওয়া যাবে।’

কারা ভ্যাকসিন পাবে না

প্রাথমিকভাবে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় এনে বাকি ২০ শতাংশ মানুষকে হার্ড ইমিউনিটির জন্য পরিকল্পনা করেছিল সরকার। তবে, এই সংখ্যা কমে যেতে পারে।

সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, ১৮ বছরের কম বয়সীদের ভ্যাকসিন না দেওয়ার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে দেশের ১৭ কোটি মানুষের প্রায় ৩৭ থেকে ৪০ শতাংশ এই বয়স গ্রুপ রয়েছে।

এ ছাড়াও, সতর্কতা হিসেবে প্রথম পর্বে প্রায় ৫০ লাখ অন্তঃসত্ত্বা নারীকে এই ভ্যাকসিন দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।

যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাদেরও টিকা দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন এক কর্মকর্তা। তিনি জানান, আন্তর্জাতিক প্রোটোকল অনুসারে, যারা সংক্রামিত হয়েছিলেন তাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ায় ভ্যাকসিনের প্রয়োজন নেই।

গতকাল শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন চার লাখ ৬৫ হাজার ২৭৯ জন।

ভ্যাকসিন ক্রয়ের পরিকল্পনা

বিদ্যমান ইপিআই কোল্ড চেইনের উপযোগী ভ্যাকসিনগুলোই ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

উন্নত দেশগুলোতে ফাইজার-বায়োএনটেকের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন জরুরি ব্যবহার হচ্ছে। এই ভ্যাকসিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনও পেয়েছে। তবে, এগুলো মাইনাস ১১২ থেকে মাইনাস ৭৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে সংরক্ষণ করতে হয়, যে ব্যবস্থা বাংলাদেশে নেই।

একারণেই বাংলাদেশ জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যবহারের জন্য সম্প্রতি যুক্তরাজ্য এবং ভারতে অনুমোদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশের বেক্সিমকোর সঙ্গে তিন কোটি অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন প্রতি ডোজ পাঁচ ডলার দরে কিনতে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই করেছে সরকার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ছয় কিস্তিতে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন দেশে আসবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রথম কিস্তির ৫০ লাখ ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, কোভ্যাক্সের আওতায় যে ভ্যাকসিন বাংলাদেশ পাবে, তা মে মাসের আগে আসছে না। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশের জন্য এই সুবিধার ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে। যা প্রায় ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ। এগুলোর প্রতি ডোজের জন্য সরকারকে ব্যয় করতে হবে এক দশমিক ছয় ডলার থেকে দুই ডলার পর্যন্ত।

Comments

The Daily Star  | English

Money launderers spreading propaganda abroad: Shafiqul

The CA's press secretary said during the ousted Awami League era, the biggest looting in the world history took place in Bangladesh

1h ago