সৌদি আরবে গৃহকর্মী আবিরন হত্যা: সমঝোতা নয়, ন্যায়বিচার চায় পরিবার
সৌদি আরবে বাংলাদেশি গৃহকর্মী আবিরন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তার তিন আসামির কাউকে জামিন দেননি দেশটির আদালত। আদালত এ ব্যাপারে আসামিদের লিখিত জবাব দিতে বলেছেন। অন্যদিকে নিহত আবিরনের পরিবার বলেছে তারা এই ঘটনায় কোনো সমঝোতা চায় না, বরং প্রাণের বদলে প্রাণ চায়। গতকাল বুধবার এই মামলার সবশেষ শুনানি ছিল। আগামী ২০ জানুয়ারি মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন আদালত।
সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং আবিরনের পরিবারের সঙ্গে গতকাল বৃহস্পতিবার কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
খুলনার পাইকগাছার মেয়ে আবিরন ‘পরিবারে একটু স্বচ্ছলতা আসবে’ স্থানীয় দালাল রবিউলের এমন কথায় ঢাকার একটি রিক্রটিং এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন ২০১৭ সালে। ২০১৯ সালের ২৪ মার্চ তাকে হত্যা করা হয়। তবে দীর্ঘদিনেও পরিবার আবিরনের মরদেহ পাচ্ছিল না। পরিবারটি বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির সহায়তায় ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মাধ্যমে ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর তার মরদেহ দেশে আনা হয়। মরদেহের সঙ্গে থাকা আবিরনের মৃত্যুসনদে মৃত্যুর কারণের জায়গায় লেখা ছিল মার্ডার (হত্যা)।
মরদেহ যেদিন আসে ওই দিন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) হয়ে একটি তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করে। কমিশনের অবৈতনিক সদস্য নমিতা হালদারকে এই তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি ২৫ নভেম্বর খুলনার পাইকগাছা উপজেলার রামনগর গ্রামে আবিরনের বাবা আনছার সরদারের বাড়ি সরেজমিন পরিদর্শন করে, এজেন্সি, মন্ত্রণালয়, দূতাবাসসহ সবার সঙ্গে কথা বলে ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দেন।
পরিবারের অভিযোগ, আবিরন যে বাসায় কাজ করতেন, সেখানে মোট আট জন পুরুষ থাকতেন। তারা আবিরনকে যৌন নির্যাতন করতেন। খাবার খেতে না দেওয়া, গ্রিলে মাথা ঠুকে দেওয়াসহ নানান নির্যাতন তো ছিলই। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪০ বছরের বেশি বয়সী আবিরনকে পিটিয়ে, গরম পানিতে ঝলসে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে তাকে খুন করা হয়। সাত মাস সেখানকার এক মর্গে ছিল আবিরনের মরদেহ।
প্রতিবেদনে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) বিভিন্ন স্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি, আবিরনকে হাত বদল করে বিদেশ পাঠানো বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সি, দালালসহ অভিযুক্তদের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরে দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির সুপারিশ করা হয়।
আবিরনকে হত্যার ঘটনায় দালাল রবিউলকে প্রধান আসামি করে ২০১২ সালের মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে দেশেও একটি মামলা হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে খুলনার সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পাশাপাশি এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায় এবং অভিযুক্ত নির্যাতনকারীদের আদালতের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করে মানবাধিকার কমিশন। এরপর আবিরনের পরিবারের পক্ষ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে গত ১৬ ডিসেম্বর থেকে বিচার শুরু হয়। সৌদি আরবে বাংলাদেশি কোনো গৃহকর্মী হত্যার ঘটনায় বিচারের এমন ঘটনার উদাহরণ বিরল। মামলার সর্বশেষ শুনানি ছিল বুধবার।
সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকালে রিয়াদের ক্রিমিনাল কোর্টের ৬ নম্বর আদালতে মামলার শুনানি শুরু হয়। আবিরনের পরিবারের পক্ষ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে রিয়াদে দূতাবাসের প্রথম সচিব মো. সফিকুল ইসলাম ও অনুবাদক সোহেল আহমেদ শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন। শুনানিতে সৌদি আরবের পাবলিক প্রসিকিউশনের প্রতিনিধি আবদুল্লাহ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া এই হত্যার ঘটনায় আটক তিন সৌদি নাগরিক আবিরনের গৃহকর্তা বাসেম সালেমি, তার স্ত্রী আয়েশা আল জিজানি এবং এই দম্পতির ছেলে ওয়ালিদ বাসেম সালেম আইনজীবীসহ কারাগার থেকে ভার্চুয়ালি উপস্থিত ছিলেন।
শুনানির শুরুতে আদালত দূতাবাস প্রতিনিধির কাছে মৃতের ওয়ারিশের পাঠানো পাওয়ার অব অ্যাটর্নি ও রাষ্ট্রদূত কর্তৃক অথরাইজেশন চিঠি আনা হয়েছে কি না, তা জানতে চান। দূতাবাস প্রতিনিধি মৃতের ওয়ারিশদের প্রেরিত পাওয়ার অব অ্যাটর্নি ও অথরাইজেশন চিঠি আদালতে দেন। আদালত সেগুলো যাচাই করে সৌদি বিচার মন্ত্রণালয়ের সিস্টেমে আপডেট করেন। এরপর শুনানি শুরু হয়।
এই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে করা অভিযোগপত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ও ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা এবং হত্যায় সহযোগিতা করার কথা উল্লেখ আছে। এ বিষয়ে আদালত দূতাবাসের প্রতিনিধির কাছে আবিরনের ওয়ারিশদের দাবি জানতে চান। জবাবে দূতাবাস প্রতিনিধি জানান, আবিরনের পরিবার জানের বদলে জান (কেসাস) চান।
আদালত এ ব্যাপারে আসামিদের বক্তব্য জানতে চাইলে আসামিরা মৌখিকভাবে অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং আইনজীবীর মাধ্যমে লিখিত বক্তব্য দেবে বলে জানায়। এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবী পরিবারের কর্তা বাসেম সালেমির জামিন আবেদন করেন। কিন্তু আদালত জামিন আবেদন নাকচ করে তাদের লিখিত জবাব দিতে বলেন।
সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর (শ্রম) মেহেদী হাসান ইতিমধ্যেই মামলার বিস্তারিত চিঠি দিয়ে ঢাকায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিবকে পাঠিয়েছেন। মামলার সর্বশেষ অগ্রগতির বিষয়টি আবিরনের পরিবারকে জানানোর জন্য খুলনার জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর উপপরিচালককে অনুরোধ করা হয়েছে চিঠিতে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনার জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর উপপরিচালক মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা নিয়মিত আবিরনের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। দূতাবাস থেকে যখন যেসব তথ্য ও কাগজপত্র চাওয়া হচ্ছে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগা করে আমরা সেগুলো পাঠাচ্ছি। পরিবারটি আমাদের বলেছে তারা এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়। এ ব্যাপারে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করছি’।
আবিরনের পরিবারের পক্ষে তার বোন রেশমা খাতুনের স্বামী এস এম আইয়ুব আলী পুরো ঘটনার দেখভাল করছেন। তিনি গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, আবিরনকে শুরু থেকেই নির্যাতন করা হয়। মরদেহ যখন দেশে আসে, তা এতটাই বীভৎস ছিল যে দেখার মতো ছিল না। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় তাদের সঙ্গে মিথ্যাচার করেছে দালাল ও এজেন্সি। তারা কোনো সমঝোতা নয় বরং হত্যাকারীদের কঠিন সাজা চান। যাতে আর কোনো আবিরনকে এভাবে মরতে না হয়।
শুধু আবিরন নয়, গত পাঁচ বছরে প্রায় ৫০০ নারীর মরদেহ দেশে ফিরেছে। এর মধ্যে অন্তত ২০০ জনেরই মরদেহ এসেছে সৌদি আরব থেকে। কিন্তু এসব ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে সাজা হয়নি। মানবাধিকার কমিশন আবিরন হত্যার ঘটনায় ৮ দফা এবং বিদেশে নারীদের সুরক্ষায় আরও ৮ দফা সুপারিশ করেছেন, যেগুলোর অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এবং বর্তমানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য নমিতা হালদার গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘৪০ বছরের বেশি বয়সী আবিরনকে পিটিয়ে, গরম পানিতে ঝলসে অর্থাৎ বিভিন্ন নির্যাতন করে খুন করা হয়। তবে এটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলার উপায় নেই। একটি চক্র অনৈতিকভাবে প্রতারণা করে আবিরনদের মতো অসহায়, দরিদ্র নারীদের বিদেশে পাঠাচ্ছে। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া জরুরি। আমরা সেই সুপারিশ করার পাশাপাশি বিদেশে নারী শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়াটি উন্নত করার জন্য সুপারিশ করেছি। কিন্তু সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। দালালসহ সরকারি যেসব কর্মচারী জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো? আবিরন হত্যার ঘটনায় দেশের মামলাটি ফেলে রাখা হয়েছে।’
আবিরন হত্যার সঠিক বিচার হবে এমন আশা প্রকাশ করে নমিতা হালদার বলেন, সৌদি আরবে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছে এ ধরনের নজির কম। তাই আবিরন ন্যায়বিচার পাবেন, সে প্রত্যাশা করা যায়। তবে আর কোনো আবিরন যেন এভাবে না মারা যায় সে ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়াটাও জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
শরিফুল হাসান, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
Comments