বিষাক্ত বাতাসে বসবাস
সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে ২০১৯ সালে প্রাণ হারিয়েছেন ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ মানুষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় দেশের বায়ু ক্রমশ বিষাক্ত হয়ে উঠছে।
‘স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার ২০১৯’ প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুঝুঁকির কারণ হিসেবে বায়ুদূষণকে চতুর্থ স্থানে রাখা হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ, তামাকের ব্যবহার ও অপরিমিত খাদ্যের পরই বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।
গত বছর বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বজুড়ে ৬৭ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন’র প্রকাশিত প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়াকে বায়ুর দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত অঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এক গবেষক জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ আউটডোর পিএম ২.৫ স্তরে থাকা শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে।
২০১৭ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ুদূষণের কারণে ওই বছর বাংলাদেশে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
এতে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশিকা অনুযায়ী বায়ুদূষণের মাত্রা কমাতে পারলে বাংলাদেশের মানুষের আয়ু প্রায় ১.৩ বছর বাড়তে পারে।
সর্বশেষ সমীক্ষা অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়ায় গত বছর বায়ুদূষণের কারণে ২১ লাখেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন। এর মধ্যে ভারতে ১৬ লাখ ৭০ হাজার, পাকিস্তানে ২ লাখ ৩৫ হাজার ৭০০ ও নেপালে ৪২ হাজার ১০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সর্বোচ্চ আউটডোর পিএম ২.৫ স্তরে থাকা শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও নেপাল রয়েছে।
পিএম ২.৫ বা দূষণকারী সূক্ষ্ম বস্তুকণার মধ্যে জৈব ও অজৈব কণা- ধুলোবালি, পরাগ রেণু, কালো ধোঁয়া, ধোঁয়া ও ড্রপলেটের উপস্থিতি থাকে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতের শতভাগ জনগোষ্ঠী এমন অঞ্চলে বাস করে, যেখানকার বাতাসের মান ডব্লিউএইচও এয়ার কোয়ালিটি গাইডলাইনে থাকা পিএম ২.৫ স্তরের চাইতেও বেশি।
নবজাতকের ওপর বায়ুদূষণের বৈশ্বিক প্রভাব নিয়ে এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাড়ির বাইরে ও ভেতরকার ক্ষুদ্র বস্তুকণার কারণে জন্মের প্রথম মাসে প্রায় ৫ লাখ শিশুর মৃত্যু হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘শিশু মৃত্যুর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জ্বালানী ব্যবহারের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা দক্ষিণ এশিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকাতে সবচেয়ে বেশি।’
বাংলাদেশে নবজাতক মৃত্যুর ২০ শতাংশ বা ১০ হাজার ৫০০ শিশু মৃত্যুর সঙ্গে বায়ুদূষণের সম্পর্ক রয়েছে। এর মধ্যে ৬২ শতাংশ মৃত্যুর পেছনে বাড়ির ভেতরকার বায়ুদূষণ দায়ী।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, দূষণের প্রধান উত্স হলো গৃহস্থালির জ্বালানী, নির্মাণকাজের ধুলোবালি, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ইটের উৎপাদন, পরিবহন ও ডিজেলচালিত সরঞ্জাম।
ঝুঁকির মুখে জনস্বাস্থ্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুদূষণ গবেষক অধ্যাপক আবদুস সালাম জানান, দেশে বায়ুদূষণ বাড়ছে। এদিকে, দূষণ কমানোর জন্য কোনো কার্যকর ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না।
কয়লা শিল্প দিনদিন আরও প্রসারিত হচ্ছে ও যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না নিয়েই নির্মাণ কাজ চলছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে। আপনি যদি ক্যান্সার এবং সিওপিডি (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ) আক্রান্ত রোগীদের পরিসংখ্যান যাচাই করেন তাহলে দেখবেন, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এর মূল কারণই হলো দূষিত বাতাস।’
বাংলাদেশ লাং ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক মো. রাশিদুল হাসান জানান, এক দশক ধরে ফুসফুসের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আট বছরের কম ও ৪৫ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা যদি বাতাসের মানের উন্নতি করতে ব্যর্থ হই, তবে দুর্ভোগ আরও বাড়বে। মানুষ সাধারণত বাড়িতে বা কর্মক্ষেত্রে দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করে থাকেন। ফলে, আমরা বাড়ির অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণের অতিরিক্ত ঝুঁকির মধ্যে আছি।’
এই দুই বিশেষজ্ঞের পর্যবেক্ষণ বিশ্বব্যাপী গবেষণা ফলকে নির্দেশ করে। গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপের পরেই বায়ুদূষণ দ্বিতীয় শীর্ষ স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে যে, বায়ুদূষণ ও কোভিড-১৯ এর মধ্যে যোগসূত্রগুলো এখনো জানা যায়নি। তবে, বায়ুদূষণ, হার্ট ও ফুসফুসের রোগগুলোর মধ্যে সংযোগের স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে।
বায়ুদূষণে কোভিড বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার সর্বাধিক দূষিত অঞ্চলগুলোতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বাড়াতে পারে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার সর্বাধিক দূষিত দেশগুলোতে বায়ুর গুণগতমানের ক্ষেত্রে গত এক দশকে খুব কম বা তেমন কোনো টেকসই অগ্রগতি হয়নি।
মুক্তির পথ?
অধ্যাপক সালাম জানান, নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের মানুষ সবচেয়ে ক্ষতিকর বাতাসে বাস করেন।
তিনি বলেন, ‘দুই সিটি কর্পোরেশন ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে এই মাসগুলোতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
আবর্জনা পোড়ানো বন্ধ করলে বায়ুদূষণ প্রায় ৩০ শতাংশ কমবে বলে জানান তিনি।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে পরিবেশ অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশে বায়ুদূষণের ঝুঁকির কথা স্বীকার করেন।
তিনি বলেন, ‘সরকার ইটভাটা চালানো বন্ধ ও কংক্রিট ব্লক প্রচারের মতো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে এর সুবিধা পেতে আরও কয়েক বছর সময় লাগবে।’
দ্য ডেইলি স্টারকে পাঠানো একটি ই-মেইলে হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউটের ড. পল্লবী পান্ত লিখেছেন, ‘বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বায়ুদূষণের উচ্চস্তরে আছে, যা মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে। বায়ুদূষণকে আমলে নিয়ে নীতি-নির্ধারকরা বাংলাদেশের বায়ুর মানের উন্নয়নের জন্য ক্লিন এয়ার অ্যাক্টের খসড়াসহ সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করছেন।’
তিনি জানান, পরের কয়েক বছর ধরে বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্প, ইটভাটা, বর্জ্য পোড়ানো ও যানবাহনসহ বায়ুদূষণের উত্সগুলোকে কেন্দ্র করে এই প্রচেষ্টা অব্যাহত ও প্রসারিত করা জরুরি।
গ্লোবাল পাবলিক হেলথ অর্গানাইজেশন ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিসের সিনিয়র এপিডেমিওলজিস্ট ডা. সুমি মেহতা বলেন, ‘যেহেতু এশিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকার দ্রুত নগরায়ণ অঞ্চলগুলোতে বায়ুদূষণ বাড়তে চলেছে, এর ফলে দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্ট এবং কার্ডিওভাসকুলার অসুস্থতাসহ অন্যান্য রোগ আরও বাড়িয়ে তুলবে। তবে ভালো খবর হলো, আমরা জানি কীভাবে দূষণের সব প্রধান উত্সগুলোকে বিবেচনা করতে হয়। এই তথ্যগুলি পরিষ্কারভাবে আমাদেরকে দেখাচ্ছে যে, দূষিত বাতাস মোকাবিলায় দ্রুত ও কার্যকরী ব্যবস্থা জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’
আগা খান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল হেলথ অ্যান্ড ডেভলপমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডা. জুলফিকার ভট্ট জানান, স্টেট অফ গ্লোবাল এয়ারের প্রতিবেদনটি মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, বায়ুদূষণ কেবল একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি জনস্বাস্থ্যেরও একটি বড় সমস্যা।
তিনি বলেন, ‘বার্তাটি খুবই স্পষ্ট। বাইরে ও বাড়িতে- বাতাস দূষণমুক্ত করতে আমাদের জরুরি ও টেকসই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। দক্ষিণ এশিয়া, যেখানে মা ও শিশুরা উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ীভাবে বাস করেন, সেখানে এটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।’
Comments