আমার কোনো অপ্রাপ্তি নেই: হাসান ইমাম
প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম সোনালি যুগের সিনেমার নায়ক ছিলেন। প্রথম সিনেমা ‘ধারাপাত’ এ নায়ক হয়ে আলোচনায় আসেন ৬০ এর দশকে। এরপর অনেকগুলো সিনেমায় নায়ক হিসেবে কাজ করেন তিনি।
টেলিভিশন নাটকে রয়েছে তার বিশাল অবদান। টানা ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে টিভি নাটকে অভিনয় করছেন তিনি। মঞ্চে নিয়মিত অভিনয় করেছেন এক সময়। এছাড়াও, অসংখ্য বেতার নাটকেও অভিনয় করেছেন।
হাসান ইমাম পেয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, আজীবন সম্মাননাসহ নানা পুরস্কার। এখনো তিনি অভিনয় করছেন।
গুণী এই শিল্পীর আজ ৮৬তম জন্ম দিন। হাসান ইমাম দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেছেন তার ৮৬তম জন্মদিনের ভাবনা।
কিভাবে কাটছে আপনার ৮৬তম জন্মদিন?
হাসান ইমাম: করোনাকাল আসার পর থেকে ঘরেই আছি। জন্মদিনটাও ঘরেই কাটছে। ফোনে সবাই শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। অবশ্য রাত বারোটা এক মিনিটে ছেলে-মেয়েরা সবার আগে উইশ করেছে। আমার ছেলে আছে ওয়াশিংটনে। ছোট মেয়ে আছে টরোন্টোতে। বড় মেয়ে ঢাকায়। ওরা সবার আগে আমাকে জন্মদিনের উইশ করেছে। এ এক অন্যরকম ভালো লাগা। এছাড়াও, পরিচিতজনরা রাত থেকে এখন অবধি ফোনে শুভেচ্ছা জানিয়ে যাচ্ছেন। সবার ভালোবাসা নিয়ে এখনো বেঁচে আছি— এ আমার জন্য পরম পাওয়া।
৮৬ বছরের বর্ণাঢ্য জীবন আপনার, কিভাবে দেখেন এই জীবনটাকে?
হাসান ইমাম: সত্যি কথা বলতে জীবন অনেক সুন্দর। বেঁচে থাকাটা আরও সুন্দর। বেঁচে থাকার চেয়ে সুন্দর আর কিছু হতে পারে না। দেখুন, একটা বিচিত্র জীবন আমি কাটালাম। বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে এখনো বেঁচে আছি। জীবন নিয়ে ধারণা হচ্ছে— মানুষের বয়স বাড়ে, মানুষ বুড়ো হয়, কিন্তু, মন কখনো বুড়ো হয় না। মন চির যৌবনে থেকে যায়।
এদেশে যত মহামারি-দুর্যোগ এসেছে, সব সময়ই মাঠে গিয়ে কাজ করেছি। এখন তো বয়সের কারণে চাইলেও পারব না। তারপরও ঘরে বসে কাছের ও চেনা মানুষদের মধ্যে যারা অসচ্ছল, তাদের সহযোগিতা করতে পারছি। এটাও কম কী।
কোনো পেশা নয়, নিজেকে সব সময় একজন মানুষ মনে করি। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। জীবন মানে কেবল নিজের জন্য নয়, সব মানুষের হয়ে থাকার নামই জীবন।
একটা বিচিত্র জীবন কাটানোর কথা বললেন, ব্যাখা করা যাবে?
হাসান ইমাম: অবশ্যই। আমি কখনো একই পেশায় ছিলাম না। একটা সময়ে ফুটবল খেলতাম। একটা সময়ে ক্রিকেট খেলেছি। পড়ালেখা করেছি ম্যাকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। প্রথম জীবনে চাকরি করেছি দর্শনা চিনি কলে। সেখান থেকে চলে এলাম ব্যাংকে। তারপর টিভি নাটকে। তারপর সিনেমায়। আবার মঞ্চেও অনেকদিন অভিনয় করেছি।
বহু বছর আগেই সিনেমা পরিচালনা করেছি। আবৃত্তি করেছি। গান করেছি। মুক্তিযুদ্ধ করেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্দোলন করেছি। সেজন্যই বলছি, একটা বিচিত্র জীবন আমি পার করেছি। সেই জীবনটা ছিল অর্থময়।
ছেলেবেলার কোন স্মৃতিটা এখনো চোখে ভাসে?
হাসান ইমাম: ছেলেবেলার অনেক স্মৃতিই চোখে ভাসে। একটা শেয়ার করি। সেটা ছিল ১৯৪৩ সালের কথা। তখন দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে। আমার বয়স মাত্র আট বছর। আমাদের বাড়ি থেকে মানুষকে সাহায্য করা হচ্ছে। আমার মা ও অন্যরা অসহায় মানুষদের সাহায্য করছেন। আমাকেও হাতে মগ ধরিয়ে দেওয়া হয় গরিবদের সাহায্য হিসেবে দুধ দেওয়ার জন্য। তখন দেখেছি মানুষ কত অসহায়। ওই বয়সের পর থেকে সারাজীবনের একটা সঞ্চয় হয়— মানুষের জন্য আসলে মানুষ। ওই স্মৃতিটা খুব করে চোখে ভাসে।
নিজের আত্মজীবনী লেখার চেষ্টা করেছেন কি?
হাসান ইমাম: দুই বছর আগে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইটির নাম ‘আকাশ আমার ভরল আলোয়’। পাঞ্জেরী থেকে এসেছে। ওটায় আমার জীবনের নানা কথা আছে। আত্মজীবনী বলব। তবে এটাও বলব, আমার এত অভিজ্ঞতাময় জীবনে একটি বা দুটি বইয়ে আত্মজীবনী লিখে শেষ হওয়ার নয়। আরও লাগবে। বেঁচে থাকলে চেষ্টা করব সামনে আরও লিখতে।
আপনি একসময় রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন, বড় অর্জনও আছে আপনার।
হাসান ইমাম: ঠিক বলেছেন। সেটা ১৯৫২ সালে। অল ইন্ডিয়া ইয়ুথ উৎসবের বরীন্দ্র বিভাগে আমি প্রথম হয়েছিলাম। চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় দ্বিতীয় হয়েছিলেন। তখন সবাই জানতেন আমি ভালো রবীন্দ্রসংগীত জানি। ভেবেছিলাম— গানই হবে আমার সব। কিন্তু, এক সময়ে কঠিন অসুখ হয়। সে কারণে গান বাদ দিতে হয়েছিল। না হলে সবার কাছে হয়ত পরিচয়টা অন্যভাবে হত।
প্রথম এফডিসিতে যাওয়ার কথা মনে আছে?
হাসান ইমাম: খুব মনে আছে। তখন তো প্রধান গেট অন্যদিকে ছিল। এফডিসির ওখানে একটা খাল ছিল। খালের ওপর সাঁকো ছিল। সাঁকো পার হয়ে যেতাম আমরা। প্রথম এফডিসির ভেতরে গিয়েছিলাম ‘ধারাপাত’ সিনেমার শুটিং করার জন্য। সালাহউদ্দিন সাহেব পরিচালক ছিলেন। কত স্মৃতি এফডিসিকে ঘিরে। আমার সময়ের বেশিরভাগ মানুষ আজ নেই। তাদের সঙ্গে এফডিসিতে কত আড্ডা দিয়েছি, কত সুন্দর সময় কাটিয়েছি! সেসব এই বয়সে মনে পড়ে।
কোনো অপ্রাপ্তি কাজ করে আপনার?
হাসান ইমাম: না। আমার কোনো অপ্রাপ্তি নেই। নিজের বিবেক যা বলেছে তা করেছি। সব সময় সততা নিয়ে কাজ করেছি। মানুষ আমাকে এত কিছু দিয়েছেন যে আমার কোনো অপ্রাপ্তি নেই।
জন্মদিনে আপনার চাওয়া কী?
হাসান ইমাম: মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশটাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসা। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ধারণা দেওয়া। তারা যেন মুক্তিযোদ্ধাদের না ভুলে। মানুষ যেন মানুষের জন্য থাকে সব সময়। সংঘাত নয়, শান্তি যেন বিরাজ করে।
Comments