সাইকেল মিস্ত্রি থেকে গজল সম্রাট

মেহেদী হাসান। ছবি: সংগৃহীত

উপমহাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তি লতা মঙ্গেশকর তার গান শুনে বলছিলেন, ‘স্বয়ং ঈশ্বর যেন তার কণ্ঠে অবস্থান করেন’। বিখ্যাত গজল শিল্পী জগজিৎ সিং বলেছিলেন, ‘তার মাপের গজল শিল্পী আরেকজন তৈরি হওয়া অসম্ভব’। কিংবদন্তি কাওয়ালি শিল্পী আবিদা পারভীন বলেছিলেন, ‘সঙ্গীতের ভুবনে তিনি এক জীবন্ত টাইটানিকস্বরূপ’।

যার সম্পর্কে এত কথা বলা হচ্ছে, তিনি আর কেউ নন, গজল সম্রাট মেহেদী হাসান। যিনি আজও বিশ্ববাসীকে মোহাবিষ্ট করে রাখছেন তার সুমিষ্ট কণ্ঠের গজলে। শাহেনশাহ-ই-গজলের বেড়ে ওঠা ছিল সিনেমার গল্পের মতো।

গল্পের সেই যাদুকর গায়কের জন্ম ১৯২৭ সালের এই দিনে (১৮ জুলাই) তৎকালীন রাজস্থানের ঝুন ঝুন জেলার লুনা গ্রামে। বাবা ওস্তাদ আজিম আলী খান এবং চাচা ওস্তাদ ইসমাইল খান ছিলেন ধ্রুপদি সংগীতের প্রখ্যাত পণ্ডিত। বাবা-চাচা ছিলেন রাজস্থানের কলওয়ান্ত ঘরানার ধ্রুপদ শিল্পী।

পারিবারিকভাবেই সংগীতের হাতেখড়ি। বরোদার মহারাজার দরবারে প্রথম গান গাইলেন মেহেদী হাসান। প্রায় ৪০ মিনিট তিনি সেই আসরে রাগ বসন্ত পরিবেশন করেন। যা উপস্থিত সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়।

কিন্তু, বেশিদিন থাকা হয়নি রাজস্থানে। ৪৭-এ দেশভাগের জোয়ার লাগে মেহেদীর পরিবারেও। মেহেদী হাসান ২০ বছর বয়সে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে চলে আসেন পাকিস্তানে।

পাকিস্তান আসার পরে পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়ে। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে তিনি স্থানীয় একটি সাইকেলের দোকানে কাজও নিয়েছিলেন। কিন্তু, রেওয়াজে ফাঁকি দেননি।

লাহোরের বেশ কয়টি অনুষ্ঠানে গান গাইলেন। কিন্তু, সাফল্য পেলেন না। দমে যাননি। ১৯৫৭ সালে রেডিও করাচি স্টুডিওতে অডিশনের সুযোগ আসে। অডিশনে গাইলেন ঠুমরি, রাগ খাম্বাজ, পিলু, দেশ, তিলক, কামোদ। মুগ্ধ হলেন রেডিও কর্মকর্তারা। তিনি এ গ্রেডের শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হলেন। যদিও এ গ্রেডের শিল্পীর সম্মানী ছিল ১৫ রুপি; কিন্তু তার সম্মানী করা হলো ৩৫ রুপি। পরিচিতি পেলেন ঠুমরি শিল্পী হিসেবে।

কিন্তু, তিনি তো গজল শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পেতে চান। তাই তিনি সে সময় কিছু কবিতা লেখেন এবং তাতে সুর করেন। একবার রেডিওর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুরোধে পরীক্ষামূলকভাবে দুটো গজল পরিবেশন করেন। আর এতেই ঘুরে দাঁড়ায় তার জীবনের মোড়। ‘ম্যায় হোস ম্যায় থা তো ফির’, ‘রাফতা রাফতা ও মেরি হাসতি কা সামান হো গ্যায়ি’, ‘খুবাকু ফেইল গেয়ি’, ‘মহব্বত করনে ওয়ালে’, ‘দুনিয়া কিসিকে পেয়ার’, ‘জিন্দেগি মে তো সাবহি পেয়ার কিয়া কারতি হে’, ‘বাত কারনি মুঝে মুশকিল’, ‘খুলিজো আঙ্গা ওহ থা’, ‘আব কি বিচরে’সহ অসংখ্য গজল তাকে এনে দেয় গজলের মুকুটহীন সম্রাটের সম্মান।

যতটা সহজ মনে হচ্ছে, ঠিক ততটা সহজ ছিল না। যখন মেহেদী হাসান নিয়মিত গান গাওয়া শুরু করেন, সে সময় ওস্তাদ বরকত আলি খান, বেগম আখতার কিংবা মুকতার বাঈয়ের মতো শিল্পীরা মধ্যগগনে। তাদের মধ্যেও নিজের জায়গা করে নেওয়া ছিল এক বিশাল সাফল্য।

পাকিস্তানি ফিল্মি গানের সর্বকালের সেরা গানগুলো মেহেদী হাসানের গাওয়া। ২৫ হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন তিনি। শুধু কি উর্দু? না, বাংলা গানেও রয়েছে তার স্মরণযোগ্য অবদান।

স্বাধীন বাংলাদেশে মেহেদী হাসান প্রথম আসেন ১৯৮৫ সালে অনুষ্ঠিত সার্ক সম্মেলনে। সে সময় তিনি বাংলাদেশ-পাকিস্তানের যৌথ প্রযোজনায় পরিচালিত ‘জান্নাত দোজখ’ চলচ্চিত্রের জন্য বাংলা গান রেকর্ড করেন। 

তার গাওয়া বাংলা গান ‘হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়’, ‘ঢাকো যত না নয়ন দুহাতে’, ‘তুমি যে আমার’ প্রভৃতি বাংলাদেশের সংগীতের ভাণ্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ।

আজ এই গুণী শিল্পীর জন্মদিন। শুভ জন্মদিন গজল সম্রাট মেহেদী হাসান।

লেখা শেষ করবো আরেক কিংবদন্তি মোহাম্মদ রফির এক মন্তব্য দিয়ে। মেহেদী হাসান সম্পর্কে রফি বলেছিলেন, ‘জনগণের জন্য আমরা গান করি। আর আমাদের জন্য গান করেন মেহেদী হাসান’।

Comments

The Daily Star  | English

Irregularities in RAJUK plot allocation: ACC files case against Hasina, Putul

Putul was named as the first accused, while Hasina was listed as the second accused

18m ago