‘যৌবনের দুই চর, দুই চড়ও’
জন্ম কলকাতায়। বেড়ে উঠাও। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি উল্টোরথ ম্যাগাজিনে লিখতেন নিয়মিত। পরে ৫০ এর দশকের শেষ দিকে মুম্বাই যান বিখ্যাত চিত্রনাট্যকার প্রেমানন্দ মিত্রের বদলি হিসেবে কাজ করতে। জীবনে প্রথম চিত্রনাট্য ‘লজ্জাবতী’ মুক্তি পায় ১৯৫৮ সালে। ছবিটি ব্যবসা সফলও হয়।
কিন্তু, তার যশ-খ্যাতি আসে ১৯৬০ সালে মুক্তি পাওয়া ছবি ‘অনুরাধা’র মাধ্যমে। এটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কৃত হয়। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
১৯৬০ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত বলতে গেলে অধিকাংশ হিট ছবির চিত্রনাট্যকার ছিলেন শচীন ভৌমিক।
একে একে প্রায় ৭০টি সিনেমার চিত্রনাট্যের কাজ করেন তিনি। তার আলোচিত ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ক্যারাভান’, ‘আরাধনা’, ‘লাভ ইন টোকিও’, ‘গোলমাল’, ‘দো আওর দো পাঁচ’, ‘কারমা’, ‘কারান অর্জুন’ ও ‘তাল’।
শচীন ভৌমিকের সর্বশেষ কাজ হচ্ছে রাকেশ রৌশন পরিচালিত ‘কৌয়ি মিল গ্যায়া’ ও ‘কৃশ’।
এতো এতো চিত্রনাট্য করলেও জীবনে মাত্র একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন শচীন ভৌমিক। ১৯৭৩ সালে তার পরিচালিত মুক্তি পাওয়া ছবিটির নাম ‘রাজা রানী’। এতে অভিনয় করেছিলেন সে সময়কার আলোচিত তারকা জুটি রাজেশ খান্না ও শর্মিলা ঠাকুর। শর্মিলাকে হিন্দি চলচ্চিত্রে নিয়ে আসেন তিনি।
শর্মিলা ঠাকুর যখন শুধুমাত্র বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেন তখন শর্মিলার মাকে রাজি করিয়ে শচীন বলতে গেলে একক প্রচেষ্টায় তাকে নিয়ে আসেন হিন্দি চলচ্চিত্রে। শুধু নিয়ে এসেই ক্ষান্ত হননি পরিচালককে রাজি করিয়ে ‘আরাধনা’য় পরিচালকের পছন্দ হেমা মালিনীকে বাদ দিয়ে নবাগত শর্মিলা ঠাকুরকে দিয়ে অভিনয় করান। ফলাফল: নায়িকা চরিত্রে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার।
তার পরিচয়ের ব্যাপ্তি হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে হলেও বাংলা ছিল তার মননে, চিন্তায় আর ভাবনায়।
তিনি বাংলা উচ্চারণে হিন্দি বলতেন। যার কারণে সিনেমার সেটে লোকজনের সমস্যা হতো তার কথা বুঝতে। তাই শচীন বাবুকে বলা হতো হিন্দি নয় বরং ইংরেজিতে বলার জন্য।
শচীন ভৌমিক যেখানে হাত দিয়েছেন পেয়েছেন সাফল্য। চলচ্চিত্রের বাইরে তার বড় জগৎ ছিল লেখালেখি। আমার কাছে শচীন ভৌমিক একজন বিখ্যাত রম্য লেখক। যার হাতে শুধু মধু আর যাদু।
তার বিখ্যাত বই শেরশায়রী, বেডসাইড শচীন বা ফর এডাল্টস ওনলি যে কোনো পাঠককে নিয়ে যাবে এক অন্য জগতে।
ফর এডাল্টস ওনলি বইয়ের প্রথম গল্পের শুরুটা উল্লেখ করছি শুধু বুঝানোর জন্য যে কতোটা ঝরঝরে আর বাস্তবসম্মত লেখা, তার গল্প।
‘মদিরা যৌবন আসার আগেই যৌবনের দুই চর চলে আসে। দুই চর বলতে পারেন দুই চড়ও বলতে পারেন। সে দুজন হল একটি ভূত ও একটি ম্যাজিসিয়ান। দেহে ঢুকে পড়ে ভূত, আর মনে এসে ঢোকে সেই জাদুকর। ভূতটা এসে ছেলেদের নার্ভ আর মেয়েদের কার্ভ নিয়ে পিংপং খেলা শুরু করে, আর জাদুকর মশাই মনটাকে নিয়ে যায় এক স্বপ্নের জাদুঘরে। সে ফ্যান্টাসির জগতে নিজেকে মনে হয় ফ্যান্টাসটিক। কখনও কিং মনে হয়, কখনও কিংকং।
সে বয়েসে আমার স্বপ্ন ছিল উত্তম কুমারের বাড়িতে, ক্যাডিলাক গাড়িতে ও সুচিত্রা সেনের শাড়িতে ঢোকার। স্বপ্ন ছিল হেমন্ত মুখার্জির কণ্ঠ, তারাশঙ্করের চরণ, রবিশঙ্করের অঙ্গুলি, নেহেরুর হস্ত, সোফিয়া লোরেনের স্তন, এলিজাবেথ টেলরের নিতস্ব স্পর্শ করার। স্বপ্ন ছিল দেখবারও— প্যারিসের ইফেল টাওয়ার আর ল্যুভর মিউজিয়াম, লন্ডন শহর, রাশিয়ার ইলিয়া এরেনবুর্গ, মায়কোভস্কী ও টিউব ট্রেনের স্টেশন, আমেরিকার স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, মেরিলিন মনরো, হলিউড, এলভিস প্রেসলে আর স্মার্ট কিংকোল, স্পেনের ষাঁড়ের লড়াই, মিশরের পিরামিড আর জাপানের গাইসা মেয়ে, আগ্রার তাজমহল, বীরভুমের শান্তিনিকেতন, সিংহগড়ের ভগ্নস্তুপ আর বৈজয়ন্তীমালার নগ্নরূপ— এই সবকিছুই দেখবার ইচ্ছে হত। সে এক অদ্ভুত বয়েস। সব যৌবনবতী মেয়েই যেন বাসনার সোনা, সব নারীর জানুসন্ধির ক্ষেত্রই যেন তীর্থক্ষেত্র। সেই বয়েসে, মধ্যবিত্ত ঘরের সাধারণ একটি ছেলের ফ্যান্টাসির জগতে আরও একটা স্বপ্ন গুনগুন করে। আমার অন্তত করত। যখনই চৌরঙ্গীর গ্র্যাণ্ড হোটেলের সামনে দিয়ে হেঁটে গেছি, ভাবতামকখনও কি ঢুকতে পারব গ্র্যাণ্ডে?’
লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে। তাই তার আরেকটি মেধার পরিচয় দিয়ে লেখার ইতি টানবো। যৌবনে প্রেমে পড়েছে আর বাঙ্গালি কোনো ছেলে গুনগুনিয়ে গায়নি রাহুল দেব বর্মনের সুর ও কণ্ঠে ‘মনে পরে রুবী রায়, কবিতায় তোমাকে’ গানটি, এরকম প্রেমিক খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। এই গানটির গীতিকার কিন্তু শচীন ভৌমিক।
১৯৩০ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন এই গুণী মানুষটি। আজ তার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন শচীন ভৌমিক।
Comments