আজ বিশ্ব রক্তদান দিবস

এক ব্যাগ রক্তদানে বাঁচবে একটি প্রাণ

আজ ১৪ জুন বিশ্ব রক্তদান দিবস। থ্যালাসেমিয়া রোগীসহ অগণিত মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচাতে যেসব হৃদয়বান স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন, তাদের দানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং উদ্বুদ্ধ করতে বিশ্বজুড়ে এ দিবসটি পালন করা হয়।

এ দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো— জনগণকে রক্তদানে উৎসাহিত করা, স্বেচ্ছায় রক্তদানে সচেতন করা, নতুন রক্তদাতা তৈরি করা ও নিরাপদ রক্ত ব্যবহারে উৎসাহিত করা। এ দিবস পালনের আরও একটি উদ্দেশ্য দেশের জনগণকে প্রাণঘাতী রক্তবাহিত রোগ এইডস, হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি ও অন্যান্য রোগ থেকে নিরাপদ রাখার জন্য স্বেচ্ছায় রক্তদান ও রক্তের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা।

২০০৪ সাল থেকে ১৪ জুনকে ‘বিশ্ব রক্তদান দিবস’ হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালন করা হচ্ছে। স্বেচ্ছায় ও বিনা মূল্যে রক্তদান করে যারা লাখো মানুষের প্রাণ বাঁচাতে সহায়তা করছেন তাদের লক্ষ্য করেই এই দিবসটি পালিত হয়।

কিন্তু, এবছর করোনা মহামারির সময় থ্যালাসেমিয়া রোগীদের মতো যেসব রোগীর নিয়মিত রক্তের প্রয়োজন হয়, তাদের রক্ত পেতে খুবই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। দেশের প্রায় সবগুলো ব্লাড ব্যাংকে রক্তের মজুদ ফুরিয়ে আসছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় স্বাভাবিক রক্ত সংগ্রহ ক্যাম্পও বন্ধ রয়েছে। ফলে নাজুক হয়ে পড়ছে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের অবস্থা। মানুষের জীবনে যেমন খাদ্যের প্রয়োজন, থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জীবন বাঁচানোর জন্য তেমনি খাদ্যের সঙ্গে সঙ্গে রক্তেরও প্রয়োজন। রক্ত গ্রহণ করেই তাদের সারাজীবন অতিবাহিত করতে হয়। করোনা সংকটে তাদেরকে রক্তের জন্য বেগ পেতে হচ্ছে। বর্তমানে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ রক্তের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। করোনার মাঝে সব রক্তদাতারা ঘরে চুপ করে বসে আছে এমনটি নয়। অনেকে পরিবারকে না জানিয়েও রক্ত দান করছেন।

প্রতি ব্যাগ রক্ত জোগাড় করতে থ্যালাসেমিয়া রোগীসহ অন্যান্য রোগীদের অভিভাবকদের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। রক্ত না দিতে পারলে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের বাঁচানো সম্ভব নয়। কোনো থ্যালাসেমিয়া রোগীর মাসে এক ব্যাগ, কোনো রোগীর দুই ব্যাগ এমনকি তিন ব্যাগ রক্তেরও প্রয়োজন হয়। এসব রোগী ও তাদের অভিভাবকরা করোনা মহামারির পাশাপাশি রক্তের চিন্তায় বিভোর হয়ে আছেন।

রক্ত ছাড়া কোনো মানুষের জীবন কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু, মানবদেহের এই অত্যাবশ্যকীয় উপাদানটির কোনো বিকল্প তৈরি করা সম্ভব হয়নি। মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচাতে প্রায়ই জরুরিভিত্তিতে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয়। শুধু থ্যালাসেমিয়া রোগী নয়, কারো অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, দুর্ঘটনায় আহত, সন্তান প্রসব, অ্যানিমিয়া, হিমোফিলিয়া, অস্ত্রোপচার, রক্তবমি বা পায়খানার সঙ্গে রক্ত গেলেও রোগীর শরীরে রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন পড়ে।

১৮ থেকে ৬০ বছরের যে কোনো সুস্থ মানুষ, যাদের শরীরের ওজন ৪৫ কেজির বেশি, তারা চার মাস অন্তর অন্তর নিয়মিত রক্তদান করতে পারেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী নিরাপদ রক্ত সঞ্চালনের জন্য রক্তদাতার শরীরে হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, এইচআইভি বা এইডস, ম্যালেরিয়া ও সিফিলিস— এই পাঁচটি রক্তবাহিত রোগ আছে কি না, তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত করতে হয়। এসব রোগ না থাকলে তবেই সেই রক্ত রোগীর শরীরে প্রবেশের উপযুক্ত বলে ঘোষণা করা যায়। অবশ্য একইসঙ্গে রোগীর রক্তের সঙ্গে রক্তদাতার রক্তের গ্রুপিং এবং ক্রসম্যাচিং জরুরি।

যে কোনো সুস্থ-সবল মানুষ রক্তদান করলে রক্তদাতার স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি হয় না। এমনিতেই রক্তের লোহিত কণিকাগুলো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চার মাস পরপর নষ্ট হয়ে যায়। তাই অকারণে নষ্ট করার চেয়ে তা স্বেচ্ছায় অন্যের জীবন বাঁচাতে দান করলে মানুষের জীবনও বাঁচানো যায়। সামান্য পরিমাণে রক্তদানের মাধ্যমে একটি জীবন বাঁচানো নিঃসন্দেহে মহৎ কাজ।

নিয়মিত রক্তদান করা একটি ভালো অভ্যাস। রক্তদান করা কোনো দুঃসাহসিক বা স্বাস্থ্যঝুঁকির কাজ নয়। বরং এর জন্য একটি সুন্দর মন থাকাই যথেষ্ট। রক্তদাতার শরীরের কোনো ক্ষতি তো হয়ই না, বরং নিয়মিত রক্তদান করলে বেশ কিছু উপকারও পাওয়া যায়।

শরীরে রক্তকণিকা তৈরির কারখানা হলো অস্থিমজ্জা। নিয়মিত রক্তদান করলে অস্থিমজ্জা থেকে নতুন কণিকা তৈরির চাপ থাকে। এতে অস্থিমজ্জা সক্রিয় থাকে। এতে যে কোনো দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো কারণে হঠাৎ রক্তক্ষরণ হলেও শরীর খুব সহজেই তা পূরণ করতে পারে।

রক্তদানে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে এবং রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রাও কমে যায়। ফলে হৃদরোগ, স্ট্রোক ইত্যাদি মারাত্মক রোগের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। হার্ট ভালো থাকে এবং রক্তদাতা সুস্থ ও প্রাণবন্ত থাকেন। রক্তদানের সময় রক্তে নানা জীবাণুর উপস্থিতি আছে কি না, তা জানতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। ফলে রক্তদাতা জানতে পারেন তিনি কোনো সংক্রামক রোগে ভুগছেন কি না।

মানবিক, সামাজিক ও ধর্মীয়— সব দৃষ্টিকোণ থেকেই রক্তদাতা অনাবিল আনন্দ অনুভব করেন এবং সামাজিকভাবে বিশেষ মর্যাদাও পান। গ্রহীতা আর তার পরিবার চিরদিন ঋণী থাকেন তার জীবন বাঁচানোর জন্য। দাতার জন্য এটা যে কি আনন্দের, তা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়।

বাংলাদেশে প্রায় ৭০ থেকে ৯০ হাজার থ্যালাসেমিয়া রোগীর নিয়মিত রক্তের প্রয়োজন পড়ে। তাদের জীবন ওই সকল মহান রক্তদাতার দানের ওপর নির্ভর করে। অনেক গরিব পরিবারের অভিভাবক তাদের সন্তানদের জন্য রক্ত কিনতে পারেন না। কোনো কোনো পরিবারে দু-তিন জনও থ্যালাসেমিয়া রোগী রয়েছেন। সেজন্য থ্যালাসেমিয়াসহ অন্যান্য রোগীদের জীবন বাঁচাতে রক্তদাতার অবদানকে মূল্যায়ন করতে হবে। পাশাপাশি আরও রক্তদাতা তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করতে সরকার, বেসরকারি সংস্থা, মিডিয়াসহ সবার আরও কাজ করতে হবে।

থ্যালাসেমিয়া রোগীদের পাশে আছে বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি হাসপাতাল, থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল। এসব প্রতিষ্ঠানে রক্তদাতারা নির্ভয়ে রক্ত দিতে পারেন।

এই মহামারি কবে নির্মূল হবে আমরা জানি না। আসুন সবাই আমরা অন্তত এক ব্যাগ রক্ত দান করি। এক ব্যাগ রক্ত দানে বাঁচবে একটি প্রাণ, বেঁচে থাকবে থ্যালাসেমিয়া রোগীরা।

লেখক: প্রভাষক, বরেন্দ্র কলেজ, রাজশাহী; পিএইচডি গবেষণারত এবং প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি হাসপাতাল, ঢাকা।

bodrun.nuha@gmail.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

19m ago