লকডাউনে নদীর উন্নতি, ধরে রাখা যাবে তো?
আজ ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। পরিবেশ দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘প্রকৃতির জন্য সময়’। কিন্তু, মানুষ কি প্রকৃতিকে সময় দেয়? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেয় না। আবার নিজেদের প্রয়োজনে কখনো কখনো দেয়। যেমন- বাংলাদেশে ইলিশের প্রজনন মৌসুমে সরকার মাছ ধরা বন্ধ করে। এতে মাছের সঠিক প্রজনন হয়। মানুষেরও লাভ হয়। ঠিক সময়ে নদী এবং সমুদ্রে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ে।
কিন্তু, পরিতাপের বিষয় হলো বেশিরভাগ সময় আমরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাই অসতর্ক হয়ে। এতে প্রকৃতির বিরাট ক্ষতি হয়। যা পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ আমরা প্রকৃতিকে দেই না।
নদী কিংবা পুরো প্রকৃতিই একটি জীবন্তসত্ত্বা। মানুষও এরমধ্যে পড়ে। আমরা নিজেরাই লোভের বশবর্তী হয়ে কিংবা অসচেতন হয়ে প্রকৃতির এত ক্ষতি সাধন করে ফেলেছি। ফলে, প্রকৃতি এখন প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে গিয়ে সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়া, ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অতি বর্ষণ-অনাবর্ষণ কিংবা করোনার মতো মহামারি সবই কম-বেশি প্রকৃতি বিনষ্টের ফল।
এবার করোনা মহামারির কারণে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সরকার নিজেদের মতো করে দেশের বেশিরভাগ অঞ্চল ‘লকডাউন’ বা অবরুদ্ধ করে রাখতে বাধ্য হয়েছিল। বাংলাদেশেও দেশের বেশিরভাগ জেলাকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছিল, দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল সরকার। আর এরই মধ্যে দেশের নদীগুলো প্রাণ পেতে শুরু করে। দখল না কমলেও দূষণ কমেছে অনেক।
পরিবেশ অধিদপ্তরের দাবি, করোনা পরিস্থিতিতে নদী দূষণ ব্যাপকভাবে কমেছে। শুধু পানি নয় প্রকৃতির অন্যান্য উপাদানও পরিশুদ্ধ হতে শুরু করেছিল।
আজ দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, লকডাউনের সময়ে বাংলাদেশে বায়ুতে কার্বন নিঃসরণের হার দিনে ২৪ শতাংশ (১৮৩০০০ মে. টন) কমেছে। ভাবা যায়? কিন্তু সরকার আবার অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালু করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। খুলতে শুরু করেছে কল-কারখানা। যদিও করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে শুরু করেছে। ফলে, পরিবেশ আবার আগের মতো দূষিত হতে শুরু করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
অন্যদিকে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ না রেখে পরিবেশ দূষণ ঠেকানোর কোনো উপায় সরকারের কাছে আছে বলে মনে হয় না।
বলছিলাম পরিবেশ অধিদপ্তর দাবি করেছে, এই লকডাউনে নদীগুলোর বেশ উন্নতি হয়েছে। অবশ্য তাদের এই দাবির প্রমাণও মিলেছে নদীর পানি পরীক্ষার মাসিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে।
রাজশাহী বিভাগের পরিবেশ অধিদপ্তরের আঞ্চলিক অফিস বগুড়ার অধীনে রাজশাহী অঞ্চলের ৬টি নদী; পদ্মা, যমুনা, করতোয়া, তিস্তা, ইছামতি এবং বড়াল নদীর ২৬ পয়েন্ট থেকে প্রতিমাসে নদীর পানি নমুনা পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ করে থাকে। দ্য ডেইলি স্টার ২০১৯ এবং ২০২০ সালের মার্চ, এপ্রিল এবং মে মাসের রিপোর্ট সংগ্রহ করেছে। সেগুলো পর্বেক্ষণ করে দেখা গেছে, নদীগুলোর পানির মান সত্যি পরিবর্তিত হয়েছে।
রাজশাহী জেলার সবচেয়ে বেশি দূষিত এবং মৃতপ্রায় নদী হল করতোয়া এবং ইছামতি। এই নদীগুলোতে বছরের বেশিরভাগ সময় ন্যূনতম পানি থাকে না। শহরের (পৌরসভার) ময়লা-আবর্জনা, কৃষিজমিতে ব্যবহার্য সার-কীটনাশক এবং কল-কারখানার বর্জ্য (তরল এবং কঠিন) নদীতে এসে মিশে। ফলে, বছরে সাত মাসের বেশি সময় পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন (dissolved oxygen-DO) এর পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম থাকে। স্থানীয় লোকজনের মতে, এসব নদীর জীববৈচিত্র্য প্রায় ৮০ শতাংশ কমে গেছে গত ২০-৩০ বছরের ব্যবধানে। করতোয়া নদীতে আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। যেটুকু পাওয়া যায় তাও আবার গন্ধে মুখে তোলা যায় না। এ কথা বলছিলেন বগুড়া পৌরসভার মেয়র আইনজীবী একেএম মাহবুবুর রহমান।
২০১৯ সালের মে মাসের শুরুর দিকে বা তার আগের বছরগুলোতে করতোয়া (বগুড়া) এবং ইছামতি (পাবনা) নদীর কয়েকটি পয়েন্টে দ্রবীভূত অক্সিজেন প্রতি লিটারে ৩ মিলিগ্রামের নিচে পাওয়া গেছে। অথচ এ বছরের মে মাসের শুরুর দিকে সেই একই পয়েন্টগুলোতে দ্রবীভূত অক্সিজেন পাওয়া গেছে প্রায় ৩ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে।
এই দুইটি নদীতে পানির পিএইচ (pH) এর মাত্রা সবসময় প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকত। কিন্তু, এবার গত এপ্রিল মাস থেকে পিএইচ (pH) এর মাত্রা ৭ এর উপরে বা কাছাকাছি এসেছে। পিএইচ (pH) পানির অম্লতা এবং ক্ষারের পরিমাণ নির্দেশ করে। পানিতে পিএইচ (pH) ৭ এর কম হলে বুঝতে হবে সেখানে অ্যাসিড বা অম্লতার পরিমাণ বেড়ে গেছে। যা জলীয় বাস্তুতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকারক। এসব কথা বলছিলেন বগুড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের রসায়নবিদ মাসুদ রানা।
এ ছাড়া, সব ধরনের দূষণের পরিমাণ কমে যাওয়ায় প্রত্যকটি নদীর পানিতে তড়িৎপরিবাহিতা (Electrical conductivity-EC) কমে গেছে। এরসঙ্গে নদীগুলোতে দ্রবীভূত কঠিন বস্তুকণাও (Total dissolved solid-TDS) কমে গেছে। পাশাপাশি পানিতে জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় অক্সিজেন (Biological Oxygen Demand-BOD) এর মাত্রা কমে গেছে। এতে করে নদীর পানির গুণগত মান বাড়তে শুরু করেছে। আর এসবই হয়েছে শুধুমাত্র কল-কারখানা বন্ধ রাখার কারণে বলে জানিয়েছেন রসায়নবিদ মাসুদ রানা।
এই যে নদীর উন্নতি হলো, তা ধরে রাখা যাবে কী করে? প্রশ্ন করেছিলাম পরিবেশ অধিদপ্তরের রাজশাহী অফিসের পরিচালক মো. আশরাফুজ্জামানকে। কিন্তু তিনি তার সদুত্তর দিতে পারেননি।
আশরাফুজ্জামান বলেছেন, ‘লকডাউনে নদীগুলোর দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়েছে। দূষণ অনেক কমে গেছে। এই তথ্য মানুষকে জানাতে হবে। এতদিন যেসব শিল্প, কল-কারখানার মালিক অস্বীকার করতেন যে তারা নদী দূষণ করেন না। এখন তো প্রমাণ হয়ে গেল তারা নদী দূষণ করেন। এই দায়ভার তাদেরই নিতে হবে। মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
তিনি আরও জানান, গত দুই বছরে এসব পানি দূষণকারী শিল্প-কল-কারখানার মালিকদেরকে প্রায় ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু, নদী দূষণ বন্ধ করতে পারেননি।
রাজশাহী বিভাগে মাঝারি থেকে বড় শিল্প-কারখানা আছে ৫০-৬০টি। এদের মধ্যে দূষিত বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) নেই ৬-১০টি প্রতিষ্ঠানের। বাকিগুলোর অনেকের ইটিপি প্রয়োজনের তুলনায় ছোট কিংবা মান্ধাতার আমলের। যাদের ইটিপি ভালো আছে তারাও খরচ বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম সময় ইটিপি চালু রাখেন। ফলে, দূষণ বন্ধ করা যায় না বলে জানিয়েছেন এই পরিচালক।
এ ছাড়া, পাবনায় ২০০টিরও বেশি কাপড়ের রং করার কারখানা আছে। বগুড়ায় হালকা যন্ত্রপাতি তৈরির কারখানা আছে আরও ১০০০ এর বেশি। এদের কারোরই ময়লা শোধনাগার নাই। এরা অনেকেই নদী দূষণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।
তাহলে কীভাবে এই নদীগুলোকে বাঁচানো যাবে বা বর্তমানের এই উন্নতিকে ধরে রাখা যাবে? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে পলেসি মেকারদের দায়িত্বের কথা উঠে এসেছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিজবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সরোয়ার জাহান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘করোনার কারণে হয়তো নদীর পানির উন্নতি হয়েছে। কিন্তু, সবকিছু চালু হলে তো আবার পানির অবস্থা আগের মতো হবে। তাই এই সমস্যা সমাধনের জন্য স্থায়ী কোন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। পলেসি মেকারদের ভাবতে হবে। দূষণ ঠেকাতে সরকারকে কৌশল বদলাতে হবে।’
বিশ্বের অনেক দেশেই দূষণকারী প্রতিষ্ঠান সরকারকে টাকা দেয়। যে প্রতিষ্ঠান যত বেশি দূষণকারী পদার্থ উৎপাদন করবে সেই অনুযায়ী সরকারকে টাকা দিবে। সরকার এই টাকা দিয়ে বড় বড় ইটিপি তৈরি করবে। এর দেখাশোনাও হবে সরকারিভাবে। তার আগে শিল্প-কারখানাগুলো তাদের ধরন অনুযায়ী আলাদা আলাদা জায়গায় স্থাপন করতে হবে। তাহলেই কেবল এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। এতে করে প্রকৃতি বা নদ-নদী-জলাধারগুলো আগের জায়গায় ফিরে যেতে পারবে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক।
তাই সময় থাকতে আমাদের কৌশল পরিবর্তন করতে হবে। নদী বাঁচাতে হবে। নদী-নালা না থাকলে আমাদের সেই প্রাগৈতিহাসিক নদী সভ্যতাও বিলীন হবে। নদী ভালো থাকলে আমরাও ভালো থাকতে পারব। দেশে স্বাধীনতার পর থেকে দখল-দূষণে শত শত নদী মারা গেছে। তাই বর্তমানে যে কয়টা নদী আছে তাদের সুস্থ রাখতে হবে। নদী অসুস্থ হলে আমরাও বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত হব।
মোস্তফা সবুজ, দ্য ডেইলি স্টারের নিজস্ব সংবাদদাতা, বগুড়া
mostafashabujstar@gmail.com
Comments