রানা শিকদার ও একজন ডা. সিনথিয়া

রানা শিকদার ও ডা. সিনথিয়া গুহ। ছবি: সংগৃহীত

রানা শিকদার একজন প্রবাসি কর্মী। সিঙ্গাপুরে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে খেয়ে না খেয়ে পরিবার ও দেশের জন্য টাকা পাঠান। তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। জীবনের শেষ কটা দিন দেশে পরিবারের সঙ্গে কাটাতে চান। কিন্তু টাকার অভাবে সিঙ্গাপুর থেকে আসতে পারছেন না।

রানা শিকদারের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য আনতে ২০০৮ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগে আগে চলে যান সিঙ্গাপুর। কাজ পান শিপইয়ার্ডে। দেশে কিছু করবেন বলে ২০১৫ সালে একেবারে ফিরে আসেন। অবশ্য এর মধ্যে একাধকিবার দেশে এসেছিলেন, বিয়ে করেছেন, একটা ছেলে সন্তানও হয়েছে তার। দেশে এসে এলাকায় কাপড়ের দোকান দিয়েছেন। টিকতে পারেননি। পরে দিয়েছেন মুদি দোকান। তাও টিকল না। অর্থকড়ি যা ছিল সব শেষ। ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আবার পাড়ি জমালেন সিঙ্গাপুরে। কাজ করতে লাগলেন শিপইয়ার্ডে।

চলতি মাসের শুরুর দিকে হঠাৎ রানার পেটে ব্যথা আর বমি হয়। যান চিকিৎসকের কাছে। ওষুধ খেয়ে ব্যথা কমায় আবারও ছুটেন কাজে। সপ্তাহখানেক না যেতেই আবার ব্যথা, বমি। এবার ভর্তি হতে হলো হাসপাতালে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেল তার পাকস্থলীতে ক্যানসার। চিকিৎসকেরা জানালেন, একেবারে শেষ পর্যায়ে ক্যানসার। তাদের আর কিছু করার নেই।

‘মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মা আর ছেলের মুখটা ভেসে উঠল মনে’, বললেন ৩২ বছর বয়সী রানা। তিনি এই প্রতিবেদককে বললেন, ‘ডাক্তারদের বললাম, যেহেতু বাঁচব না, তাই জীবনের শেষ কটা দিন পরিবারের সঙ্গে কাটাতে চাই’। কিন্তু, ততদিনে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। বিমান চলাচল বন্ধ। ‘ভেবেছিলাম, জীবনে হয়তো আর কোনো দিনই ছেলের মুখটা দেখতে পাব না। সারাক্ষণ কান্না করতাম’, বলেন রানা।

সিঙ্গাপুরের হাসপাতালের চিকিৎসক সিনথিয়া গুহ হঠাৎ রানার জীবনের গল্প শুনলেন। বললেন, ‘দেখি কী করা যায়।’ সিনথিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘রানার শেষ ইচ্ছাটা (দেশে ফেরা) আমি জানতে পারি ১৫ মে। এক বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগাযোগ করতে বললেন। যোগাযোগ করি, কিন্তু আশানুরূপ সাড়া পাইনি। এক পর্যায়ে হাসপাতালের একজন নার্স প্রস্তাব করেন, আমরা ক্রাউডসোর্সিংয়ের মাধ্যমে রানার জন্য ফান্ড তৈরি করতে পারি।’

‘জানতে পারলাম ১০ জুনের আগে স্বাভাবিক ফ্লাইট চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যাবে। আমি দ্রুত একটা মেডিকেল ইভাকুয়েশন কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা জানায়, যদি সিঙ্গাপুরের স্থানীয় কেউ দায়িত্ব নেয়, তবে তারা রোগী ঢাকায় পৌঁছে দেবে। টাকা পরে দিলেও হবে। এরপর দ্রুত যোগাযোগ করি সিঙ্গাপুরের মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স সেন্টারে। তারা অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে। আমরা ক্রাউডসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ফান্ড জোগাড়ের পুরো ব্যাপারটা তাদের বুঝিয়ে দেই’- এক নিশ্বাসে বলে গেলেন সিনথিয়া।

চিকিৎসক সিনথিয়া জানান, যখন সব মোটামুটি গুছিয়ে আনা হচ্ছে, তখন বাংলাদেশ হাইকমিশন রানার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে বলল। সিনথিয়া বাংলাদেশে রানার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে হাইকমিশনে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেন। এরপর হাইকমিশন বলল, করোনা পরীক্ষার ফলাফলও জমা দিতে হবে। তাও দেওয়া হয়। এর পর এক শুক্রবার বাংলাদেশ হাইকমিশন জানায়, রানাকে বাংলাদেশের কোন হাসপাতাল গ্রহণ করবে তা তাদের জানাতে এবং ওই হাসপাতালের একটা চিঠি হাইকমিশনে পাঠাতে।

ক্যান্সারে আক্রান্ত রানাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকায় আনা হয় ২২ মে। ছবি: সংগৃহীত

সিনথিয়িা বলেন, ‘সৌভাগ্যবশত, আমি বাংলাদেশে প্রায় ছয় বছরের মতো ক্যানসারের ওপর কাজ করেছি। তাই সেখানে আমার পরিচিত ডাক্তারদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালযয়ে (বিএসএমএমইউ) যোগাযোগ করি। তারা রানাকে গ্রহণ করতে রাজি হয় এবং একটা চিঠিও পাঠায়।’

ডা. সিনথিয়া বলেন, ‘হাইকমিশনে ওই চিঠি জমা দেওয়ার পর তারা জানায়, বিশেষ বিমান অবতরণের জন্য সিভিল এভিয়েশনের অনুমতি লাগবে। আবার বাংলাদেশে যোগাযোগ করে অনুমতি জোগাড় করি। সবশেষে ২২ মে রাতে আমরা রানাকে তার জন্মভূমিতে, পরিবারের কাছে পাঠাতে সক্ষম হই।’

কেন এতটা ঝামেলা নিলেন— জানতে চাইলে সিনথিয়া বলেন, ‘রানার চাওয়া তো খুব বেশি কিছু না। শুধু জীবনের শেষ কয়টাদিন পরিবারের সঙ্গে কাটাতে চেয়েছেন তিনি। মানুষ হিসেবে যদি এইটুকু না করতে পারতাম, তবে নিজেকে অপরাধী মনে হতো।’

রানাকে বিশেষ বিমানে বাংলাদেশে পাঠাতে খরচ হয় ৪৮ হাজার সিঙ্গাপুর ডলার বা ৩১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। আর রানারজন্য ডা. সিনথিয়ারা যে তহবিল গঠন করেছিলেন মাত্র ৭২ ঘণ্টায় তাতে জমা পড়ে ৬০ হাজার সিঙ্গাপুর ডলার বা ৩৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

বিএসএমএমইউ হাসপাতালের অনুমতি নিয়ে ২৩ মে দুপুরে নারায়ণগঞ্জে নিজ বাড়িতে চলে যান রানা শিকদার। আছেন পরিবারের সান্নিধ্যে।

Comments

The Daily Star  | English

BNP won't form govt alone even if it wins 200 seats: Khasru

The 31-point proposal was formulated collectively by 42 parties, including the BNP, says the BNP leader

12m ago