বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মন্দা কাটানোর পরিকল্পনা কী?
সেবারের বসন্ত ছিল অন্য বছরের মতোই। ক্রিসমাসের আগে কীভাবে বিক্রি বাড়ানো যায়, তা নিয়ে যথারীতি আমরা বিজনেস কনফারেন্স করলাম। নভেম্বরের দিনগুলোতে আমাদের প্রতিষ্ঠান ওলওর্থের কর্মীদের সবচেয়ে ব্যস্ত দিন যায়। উৎসব উপলক্ষে প্রচুর অর্ডার থাকে। ২০০৮-এর সময়গুলোও ব্যতিক্রম ছিল না।
ব্রিটেনের বিভিন্ন অঞ্চলে ৮১৫টি ব্রাঞ্চ ছিল, যেগুলোর মাধ্যমে শিশুদের খেলনাসহ অন্যান্য সামগ্রী আমরা বেচতাম। আমাদের কোম্পানির ব্র্যান্ড মূল্য ছিল বেশ আকর্ষণীয়। যদিও ব্যাংক ঋণ ছিল ৩৮ কোটি পাউন্ড। কিন্তু, ব্যবসার অবয়বের তুলনায় এ ঋণ অস্বাভাবিক কিছু নয়।
হঠাৎ শুনলাম আমাদের কোম্পানির শেয়ারের দাম পড়ে গেছে। কারণ, নাকি অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছে। মন্দা কী তা আমি জানতাম না। লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পণ্য কেনা বন্ধ করে দিলো। এর জের ধরে ওলওর্থের ঋণ পরিশোধ অনিয়মিত হয়ে গেল। যেসব পাইকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আমরা পণ্য কিনতাম তারা বাকি দিতে অস্বীকৃতি জানাল।
২০০৮-এর ২৬ নভেম্বর লিভারপুলে আমাদের কোম্পানির প্রথম শাখা বন্ধ হয়। আর ২০০৯-এর জানুয়ারির মধ্যে পুরো প্রতিষ্ঠানই নাই হয়ে গেল। ঝড় শুরু হওয়ার দুই মাসের মধ্যে চাকরিহারা হলো ২৭ হাজার কর্মী। ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি অতীতে অনেক প্রতিষ্ঠানকে কিনে নিয়েছিল। কিন্তু ভালো ব্যবসা ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানকেও মন্দা নিমিষেই ভূপাতিত করে দেয়, যা আমার কাছে ছিল এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি’র কাছে এভাবেই নিজের বিবর্ণ অভিজ্ঞতার তুলে ধরেন ওলওর্থের প্রাক্তন ম্যানেজার আর্ল মার্চান। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে বেতন বাবদ বছরে আমার আয় ছিল ২০ হাজার পাউন্ড। চাকরি হারানোর বছরখানেক পর সৌভাগ্যক্রমে নতুন কাজ পাই। ১০ বছর পরে এসে আমার বেতন এখনও ওই ২০ হাজার পাউন্ডের মতোই। মূল্যস্ফীতি হিসাবে আনলে আমার বেতন উল্টো কমেছে।
ওই মন্দার পর ব্রিটেনের উৎপাদনগতি আগের পর্যায়ে আর পৌঁছাতে পারেনি। যদি পণ্যের উৎপাদন সামগ্রিকভাবে না বাড়ে তাহলে দক্ষ কর্মীরও বেতন বাড়ার কোনো সুযোগ নেই। মার্চানের মতে, ওই ১০ বছর ছিল তার হারিয়ে যাওয়া একটি দশক।
২০০৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হওয়া মন্দা নিয়ে মার্চানের কোনো ধারণাই ছিল না। সেখানে কয়েক বছর ধরে বাড়ির দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে গেল। ব্যাংকগুলো ঋণগ্রহীতার টাকা ফেরত দেওয়ার ক্ষমতা বিবেচনা না করেই ধার দেওয়া শুরু করল। এক পর্যায়ে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বাড়ির দাম অনেক বেড়ে গেল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি বাড়ি ভাড়া দিয়ে এক বছরে যে পরিমাণ ভাড়া বাড়িওয়ালা পায়, তা দিয়ে ওই বাড়ির বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে।
কৃত্রিমভাবে এই বাড়ির দাম বাড়ানোর খেলা যথারীতি এক সময় থেমে গেল। এর জের ধরে বাড়ি নিয়ে ব্যবসা করা ব্যক্তিরা পথে বসে গেলেন। ওইসব বাড়ির দলিল বন্ধক রেখে তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। পরে ওই সম্পত্তি দখল করল ব্যাংক। কিন্তু, বিক্রি করতে গিয়ে দেখা গেলো তাদের দেওয়া ঋণের চেয়ে বাড়ির দাম অনেক কম।
এর জের ধরে ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা খেলাপি হলো। ফলে আমানতকারীদের টাকাও ব্যাংক পরিশোধ করতে পারল না। বন্ধ হয়ে গেল শত শত ব্যাংক।
কিন্তু ব্রিটেনে তো সে ধরনের পরিস্থিতি তো তৈরি হয়নি। তারপরও সেখানে অনেক ব্যাংক ও ওলওর্থের মতো নাম করা কোম্পানি কেন বন্ধ হলো? বিশ্বায়নের এই সময়ে প্রত্যেকটি দেশ পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। যদি যুক্তরাষ্ট্রের লোকজন কেনাকাটা বন্ধ করে দেয়, তাহলে আমাদের পোশাক খাত সংকটে পড়তে বাধ্য। আবার আমাদের দেশের রপ্তানি হওয়া পণ্যের টাকা ওই যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকের মাধ্যমে এখানে আসে। যদি ওই ব্যাংক বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আমাদের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোও সেই টাকা আদায় করতে পারবে না। আবার এখানকার ব্যাংকও সঙ্কটে পড়বে।
গোটা দুনিয়া এখন করোনাভাইরাসের মহামারিতে আক্রান্ত। এই ভাইরাস সব দেশকে অচল করে দিয়েছে। তেমনি অর্থনৈতিক মন্দাও মহামারির মতো। এটি এক দেশ থেকে আরেক দেশে প্রচণ্ড গতি নিয়ে প্রবেশ করে। ১৯৩০-এর মহামন্দা থেকে শুরু করে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বড় অর্থনৈতিক সঙ্কটগুলোতে তাই হয়েছে।
কিন্তু, মহামারির জের ধরে সৃষ্ট এবারের মন্দার ধরন সম্পূর্ণ ভিন্ন, যা বিশ্ব আগে কখনও প্রত্যক্ষ করেনি। কারণ, মন্দকালীন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ছোট পরিসরে অব্যাহত রাখা যায়। কিন্তু, এবার সবধরনের উৎপাদনই বলতে গেলে স্থবিরতায় পড়েছে।
২০০৭-এর মন্দা আমাদের অর্থনীতিকে তেমন একটা স্পর্শ করতে পারেনি। ওইসময় আমাদের আমদানি-রপ্তানির পরিসর ছোট ছিল। আবার মন্দা আক্রান্ত দেশগুলোতে আমাদের রপ্তানি করা পণ্যের চাহিদাতেও ভাটা পড়েনি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো দীর্ঘমেয়াদে কোনো সঙ্কটে পড়েনি। ফলে রেমিট্যান্স কমার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
কিন্তু, এবার সর্বগ্রাসী মন্দার আঘাতে আমরা এর মধ্যেই পর্যুদস্ত। যদি এই সঙ্কটকে যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে না পারি, তাহলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আমাদের যা অর্থনৈতিক অর্জন, সব উবে যেতে পারে।
কিন্তু আমাদের প্রস্তুতি কী? প্রত্যেকটি মন্দার ইতিহাস বলে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখে তা মোকাবিলা করার জন্য। যদি ওই প্রতিষ্ঠান তা করতে ব্যর্থ হয় তাহলে সঙ্কট সর্বগ্রাসী রূপ নেয়।
১৯৩০-এর মহামন্দার দিকে তাকানো যেতে পারে। মাইকেল ফ্রিডম্যানসহ অনেক অর্থনীতিবিদ ওই মন্দাকে ভয়াবহ রূপ দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের সমালোচনা করেছেন। তাদের মতে ওই মন্দার কারণে যে মূল্য সংকোচন (ডিফ্লেশন) তৈরি হয়েছিল তা মোকাবিলা করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি পর্যাপ্ত অর্থ বাজারে সরবরাহ করেনি।
১৯২৯ সালে সেপ্টেম্বরে শেয়ারবাজার পতনের জের ধরে ওই সঙ্কটের সূত্রপাত হয়। এর আগের বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের লোকজন ব্যাপকভাবে ভোগবাদী হয়ে উঠে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিজেদের বাড়ি বন্ধক রেখেও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে থাকে। পুঁজিবাজার পতনের জের ধরে তা গড়ায় ব্যাংকিং সংকটে। ১৯২৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ঋণাত্মক হয়ে ১ দশমিক ১৫ শতাংশে পৌঁছায়। ১৯৩২ সালে তা আরও ঋণাত্মক হয়ে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে গিয়ে ঠেকে।
এই মূল্যসংকোচনের মানে হচ্ছে মানুষের ক্রয়ক্ষতা কমে যাওয়া। এতে উৎপাদিত পণ্যের দাম কমে যায়। পরিশেষে পণ্য উৎপাদনকারী কারখানাগুলোতে জ্বলে উঠে লালবাতি। এই মন্দা থেকে বের হয়ে আসার জন্য ১৯৩৩ সালে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস বাজারে ব্যাপকভাবে টাকা সরবরাহ করার পরামর্শ দেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সরকার কেইনসের ওই নীতি ১৯৩৪-৩৫ সালের দিকে প্রয়োগ শুরু করে।
১৯৩৯ সালের দিকে মন্দার রেশ কমলেও এর প্রকোপ পুরোপুরি বন্ধ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করেও মন্দায় আক্রান্ত হয় বিশ্ব। কিন্তু, সেবারের ইনফ্লেশন আর ডিফ্লেশনের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। উদাহরণ হিসেবে ব্রিটেনের কেস স্টাডি আনা যেতে পারে। কারণ, দুই যুদ্ধে নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিল দেশটি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পাঁচ বছর আগে ব্রিটেনে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছিল ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। আর যুদ্ধের পাঁচ বছর পর মূল্য সংকোচন বড় রূপ নিয়ে দশমিক ৬ শতাংশে গিয়ে ঠেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও একই অবস্থা। যুদ্ধের পাঁচ বছর আগে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। আর পাঁচ বছর পর তা কমে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। মূলত যুদ্ধের খরচ মেটানোর জন্য ব্রিটিশ সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ নেয়। ওই টাকা বাজারে প্রবেশ করার পর মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। যুদ্ধের পর পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ায় মানুষে কেনার ক্ষমতা হ্রাস পায়।
কিন্তু, ২০০৭ সালে শুরু হওয়া মহামন্দার পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। ওই সময় অর্থনৈতিক সঙ্কট তীব্র রূপ নিলেও ডিফ্লেশন বা ইনফ্লেশনের প্রভাব সেভাবে পরিলক্ষিত হয়নি। কারণ, মন্দা আক্রান্ত প্রত্যেকটি দেশ ব্যাপকভাবে বাজারে টাকা সরবরাহ করে। কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং-এর মতো মন্দা মোকাবিলার সূত্রগুলো ওই সময় মডেল হিসেবে দাঁড়ায়। এর মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ট্রেজারি বিল-বন্ড কিনে বিভিন্ন দেশের সরকার ব্যাপকভাবে বাজারে টাকার জোগান দেয়।
ট্রেজারি বিল-বন্ড হচ্ছে এক ধরনের সরকারি দলিল, যেটার মাধ্যমে সরকার ঋণ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকে। ফলে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সাময়িক ডিফ্লেশনে পড়লেও তা অল্প সময়ের মধ্যে কেটে যায়।
আমাদের দেশের অর্থনীতিবিদরা ইতিমধ্যে চলমান মন্দা প্রতিরোধের উপায় হিসেবে টাকা ছাপানো বা এর জোগান নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়ে পড়েছেন। কেউ বলছেন, টাকা ছাপাতে হবে আবার কেউ এর বিপক্ষে। মজার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে টাকা ছাপানোর কথা বলেই দিয়েছে। এই বিষয়টিও অনেকে ধরতে পারছেন না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ৭৮ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে ৫০ হাজার কোটি টাকা পুনঃঅর্থায়ন হিসেবে ব্যাংকগুলোর কাছে সরবরাহ করা হবে। এর মানে হচ্ছে, প্রথমে ব্যাংকগুলো ঋণগ্রহীতাকে টাকা দিবে, এরপর তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নিয়ে নেবে। নির্দিষ্ট মেয়াদ পরে ব্যাংকগুলোকে ওই টাকা আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ফেরত দিতে হবে।
পুনঃঅর্থায়নের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সরবরাহ করা এই টাকার নাম হচ্ছে রিজার্ভ মানি (আরএম)। অর্থনীতি যখন স্বাভাবিক থাকে তখন এই আরএম বেশ শক্তিশালী। কেন? ধরছি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক লাখ টাকা পুনঃঅর্থায়নের মাধ্যমে ব্যাংকে সরবরাহ করল। ব্যাংকটি ওই টাকা ঋণ দিল কোনো ব্যবসায়ীকে। ঋণের টাকায় তিনি বেতন দিলেন কর্মীদের। বেতনের একটা অংশ খরচ করার পর বাকি টাকা তারা ব্যাংকে আমানত হিসেবে জমা রাখলেন। ব্যাংক সেই টাকা আবার ঋণ দিল অন্য কোনো ব্যবসায়ীকে। তিনি ওই টাকা দিয়ে অন্য কোনো উৎপাদকের কাছ থেকে কাঁচামাল কিনলেন কারখানার উৎপাদনের জন্য। ওই উৎপাদক লাভের একটা অংশ আবার ব্যাংকে জমা রাখলেন। ফলে এই এক লাখ টাকা বাজার থেকে ব্যাংকে ঘুরতে থাকে। এর ফলে তৈরি হয় নতুন অর্থ। এটাকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় মানি মাল্টিপ্লায়ার। স্বাভাবিক সময়ে আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে এক লাখ টাকার সমপরিমাণ আরএম সরবরাহ করলে তা পাঁচগুণের কাছাকাছি অর্থ তৈরি করে।
বাজারে এই আরএম সরবরাহ করাই হচ্ছে টাকা ছাপানো বা নতুন টাকা সৃষ্টি করার উদ্যোগ নেওয়া। প্রতিবছর মনিটরি পলিসি প্রণয়ন করার সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে আরএম সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে। কিন্তু, মন্দার সময় এসব টার্গেট এলোমেলো হয়ে যায়। যেমন, এখন যেসব আরএম সরবরাহ করা হচ্ছে, তা সব ওই মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার বাইরে।
মন্দার সময় এই মানি মাল্টিপ্লায়ারের ভূমিকাও কমে যায়। কারণ, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে টাকার গতিশীলতা কমে যায়। এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বাজারে আরও টাকার জোগান দিতে হয়। যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের দেশগুলো এখন দিচ্ছে।
ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক (ইসিবি) ইতিমধ্যে ৭৫০ বিলিয়ন ইউরোর (এক ইউরো সমান ৯২ দশমিক তিন টাকা) সমপরিমাণ বিল-বন্ড কেনার ঘোষণা দিয়েছে। সেখানকার অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন, এর পরিমাণ এক লাখ কোটি ইউরো পর্যন্ত গড়াতে পারে। এরপরও ওই অঞ্চলের জিডিপি ১২ শতাংশ পর্যন্ত সংকুচিত হতে পারে চলতি বছর। শুধু তাই নয়, ব্যাংকগুলো যদি ঋণ দেয়, তাহলে ইসিবি তাদের উল্টো ভর্তুকি দিবে দীর্ঘ মেয়াদী পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের আওতায়। কোনো ব্যাংক যদি ১০০ টাকা ঋণ দেয়, তাহলে ওই ঋণের টাকা তো তাকে দেওয়া হবেই এবং এর বাইরে দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে এক শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দেওয়া হবে। এই ঘটনা ইসিবি’র ইতিহাসে প্রথম। এভাবে তিন লাখ কোটি ইউরো ঋণ দিবে ওই অঞ্চলের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
একভাবে বলা যায়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এখন বাজারকে টাকার বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। যাতে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা যায়।
বিশ্ব অর্থনীতির গতিশীলতার অন্যতম সূচক তেলের দাম ভালোভাবে পড়েছে। কারণ, কারখানা চলছে না, গাড়ি ও উড়োজাহাজ বন্ধ। তেলের চাহিদা বা এর মূল্য না বাড়া পর্যন্ত চলমান মূল্যসংকোচনের ঝড় অর্থনীতির ওপর চলতেই থাকবে।
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদের মতে, এবারের মন্দার বিরুদ্ধে অন্যতম লড়াই হচ্ছে মূল্য সংকোচন নিয়ন্ত্রণ করা। আমরা সবসময় মূল্যস্ফীতিকে ভয় করি। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে আতঙ্কিত হয়ে যাই। স্বাভাবিক সময়ে বিশ্বের সব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান লক্ষ্য থাকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু, চলমান মন্দা এর বিপরীত চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। শুধুমাত্র খাবার ও প্রয়োজনীয় ওষুধ ছাড়া অন্য সব পণ্যের দাম পড়ে গেছে।
সব মূল্যস্ফীতি খারাপ নয়। যখন একটা দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকে, তখন মূল্যস্ফীতিও কিছুটা বাড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা সরবরাহের অন্যতম লক্ষ্য থাকে জিডিপি বা দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অবারিত রাখার জন্য এর সমপরিমাণ টাকা সরবরাহ করা। জিডিপি বাড়লে মানুষের কর্মসংস্থানও বাড়ে। ফলে মূল্যস্ফীতি খুব একটা সমস্যা হিসেবে দাঁড়াতে পারে না।
অন্যবারের মতো চলতি মন্দায়ও মানুষ টাকা খরচ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। কারণ, তারা তো ঘরের বাইরেই যেতে পারছে না। ফলে ইউরোপসহ সব জায়গায় ডিফ্লেশন বড় রূপ নিচ্ছে।
আমাদের দেশের অনেক অর্থনীতিবিদ আশঙ্কা করছেন, অন্য দেশের মতো এখানে টাকার জোগান দিলে মূল্যস্ফীতি হতে পারে। কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ব্যাপক লোকের চাকরি ইতিমধ্যে চলে গেছে। যাদের থাকবে তাদের অধিকাংশের মজুরী কমেছে বা কমানো হবে। আমাদের হাতে যদি টাকাই না থাকে, তাহলে পণ্য কিনব কিভাবে?
এক কথায় এখন আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও উৎপাদনশীল খাতে টাকা সরবরাহের পরিমাণ অনেক বাড়াতে হবে। পাশাপাশি অভুক্ত গরিব মানুষের হাতে সরাসরি টাকা সরবরাহ করতে হবে। সরকার ইতিমধ্যে নগদ দুই হাজার কোটি টাকা সরবরাহের ঘোষণা করেছে। এটা যথেষ্ট নয়। এর পরিমাণ বাড়িয়ে অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা করতে হবে। এর মাধ্যমে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। এতে পণ্যের চাহিদা তৈরি হবে। পাশাপাশি বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলো লকডাউনের পর খোলা হলে গতি পাবে।
বিশ্বের নামকরা অর্থনীতিবিদদের মধ্যে একমাত্র ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ডের প্রাক্তন চিফ ইকোনমিস্ট অলিভিয়ার ব্লানচার্ড আগামীতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা করছেন। যদিও তিনি মূল্যসংকোচনকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
ব্লানচার্ডের মতে, এখন সব রাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে। মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার কারণে এর উদ্ভব। পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক হতে থাকবে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে পলিসি রেট বাড়ানোর উদ্যোগ নেবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যখন বাণিজ্যিক ব্যাংক টাকা ধার করে তখন একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদ দিতে হয়, এটাকেই বলা হয় পলিসি রেট। আমানত বা ঋণের সুদহার নির্ধারণ করার সময় এই রেটকে ভিত্তি হিসাবে ধরে ব্যাংকগুলো। পলিসি রেট বাড়লে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ কমিয়ে দেয়। তখন বাজারে টাকার সরবরাহ কমে যায়।
ব্লানচার্ড বলছেন, পলিসি রেট বাড়ানো হলে সরকারের ব্যাংক ঋণের বোঝা আরও বাড়বে। এতে বিল-বন্ডের সুদহারও বাড়বে। বেশি টাকা দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকে বিল-বন্ড কিনতে চাইবে না সরকার। তখন সরকারের চাপে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি পলিসি রেট কমায়, তখন হাইপার ইনফ্লেশন আঘাত হানতে পারে অর্থনীতিতে।
মন্দা পরিস্থিতিতে টাকা সরবরাহ করার জন্য বিভিন্ন রকমের অর্থনৈতিক মডেল আছে। বিশ্বে যতগুলো মন্দা এখন পর্যন্ত হয়েছে, তাদের প্রত্যেকটির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। ফলে প্রত্যেক মন্দায় নতুন মডেল আবিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। কিন্তু আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ধরনের উদ্যোগ এখনও নেয়নি। এই ধরনের কর্মসূচি থেকে প্রতিষ্ঠানটি অনেক দূরে।
ব্যাংকিং সেক্টরের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি শুধুমাত্র পুনঃঅর্থায়ন কর্মসূচির মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রেখেছে। লকডাউনের চলতি সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধিকাংশ কর্মকর্তার হাতে কোনো কাজ নেই। কারণ, তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক মন্দা মোকাবিলায় কার্যকর কোনো টিম গঠন করেনি। এই মুহূর্তে উচিৎ দেশের অর্থনীতিবিদদের নিয়ে একটা প্যানেল গঠন করা। তাদের পরামর্শ শোনা এবং দেশের অর্থনীতির সঙ্গে খাপ খায় এই রকম একটা মডেল প্রণয়ন করা। সময় অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে না পারলে ১৯৩০-এর মহামন্দার মতো পরিস্থিতি হতে পারে।
ইতিপূর্বে সৃষ্ট প্রত্যেকটি মন্দায় বিভিন্ন দেশের ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবারও তা হতে পারে। কিন্তু, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগই নেয়নি। গত বছরের মুনাফা থেকে যে ডিভিডেন্ড ব্যাংকের পরিচালক ও বিনিয়োগকারীদের দেওয়া কথা, সেটা কিছুদিনের জন্য অন্তত স্থগিত করা উচিত ছিল।
কিন্তু ব্যাংক পরিচালকদের বাধার মুখে সেটাও কেন্দ্রীয় ব্যাংক করতে পারছে না। তাছাড়া দুনিয়াজুড়ে মন্দা মোকাবিলায় যা হচ্ছে, এর উল্টো পথে হাঁটছি আমরা। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শেই সব দেশে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন হচ্ছে। কিন্তু এখানে বিপরীত। কেন?
ফরাসি দার্শনিক মিচেল ফুকোর হিস্ট্রি অব সেক্সুয়ালিটি: অ্যান ইন্ট্রোডাকশন বইয়ে যে কথাগুলো বলা হয়েছিল, তা আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সবার জন্য প্রযোজ্য।
ফুকোর মতে, জ্ঞান ও ক্ষমতা পরস্পরের সঙ্গে ভীষণভাবে সম্পর্কিত। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের ক্ষমতার উৎস হচ্ছে জ্ঞান। আর এই জ্ঞান আর ক্ষমতা দিয়ে রাষ্ট্রের কর্তারা সত্য বিনির্মাণ করেন নিজেদের স্বার্থে। সত্যের কোনো শাশ্বত রূপ নেই। ক্ষমতাসীনরা আইনের মাধ্যমে তা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করে। যেমন, ব্যাংকের পরিচালকরা সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তোয়াক্কা না করে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যাংক কোম্পানি আইন দিব্যি বদলে দিয়েছেন। একেই বলে ক্ষমতা। কিন্তু, জ্ঞান ও ক্ষমতার ইতিবাচকতাকেও সমর্থন দিয়েছেন ফুকো।
আজ কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেন বারবার পরাজিত হচ্ছে? ফুকোর জ্ঞান ও ক্ষমতা তত্ত্বের ইতিবাচকতা আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য ভীষণ প্রযোজ্য।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বস্তরের কর্মকর্তারা যাতে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস বা ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের মতো গণমাধ্যমের আর্টিক্যালগুলো নিয়মিত পড়তে পারেন সে জন্য প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিদের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিল থেকেই এই পত্রিকাগুলোর গ্রাহক ফি বহন করতে পারে। কেননা, তাবৎ বিশ্বের মনিটরি ইকোনমি বা কর্পোরেট বিজনেসের নতুন তত্ত্বগুলো এখানে আলোচিত হয়।
সমাজের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররাই ব্যাপক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে চড়াই-উৎরাই পার হয়ে এই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চাকরি পান। কিন্তু চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই তাদের সেই মেধার ঝলক কমতে থাকে। কারণ, তাদের মেধা বিকশিত করার উদ্যোগ নেয় না প্রতিষ্ঠানটি। এতো প্রতিকূলতার পরও এর বেশ কিছু কর্মকর্তা ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজ জীবনের অনেক কিছু ত্যাগ স্বীকার করে মেধার চর্চা করেন, যা আমাদের আশার আলো দেখায়।
কাগজ-কলমে আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। বাস্তবেও এটি যাতে প্রতিফলিত হয়, সেজন্য এখনই উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ। যাতে ব্যাংক মালিক ও মন্ত্রণালয়ের ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারেন আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। কারণ, অর্থনৈতিক সঙ্কটে এরাই জাতির ভরসা। এরাই নিয়ে আসবেন মন্দা মোকাবিলার নতুন মডেল।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দিকে তাকালে আমরা দেখব কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর সরকারের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব একটি স্বাভাবিক বিষয়। গত বছর আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান জেরোমি পাওয়েলকে নির্দেশ দিলেন পলিসি রেট কমানোর জন্য, যাতে বাজারে আরও টাকা আসে। কিন্তু পাওয়েল মূল্যস্ফীতিকে মাথায় রেখে তুড়ি মেরে সেই নির্দেশনা উড়িয়ে দেন।
অত দূরে যাওয়ার দরকার নেই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে নজর দিতে পারি। দেশটির প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন ২০১৬-এ ঘোষণা দিলেন তিনি দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য ওই দায়িত্বে থাকবেন না। কারণ, তার মূল্যস্ফীতি কমানোর পদক্ষেপকে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা নোংরাভাবে আক্রমণ করেছিলেন। এর জের ধরে ওই লোভনীয় পদে তিনি আর থাকেননি। এরপর ওই পদে এসেছিলেন অরজিত প্যাটেল। মজার বিষয় হচ্ছে, তিনি দায়িত্বে থাকার মাঝপথেই ২০১৮-এর ডিসেম্বরে পদত্যাগ করেন। কারণ, মোদি সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনে আঘাত করেছিল। আমরা এখনও জানি না কতটা পথ পেরুলে একজন রাজন বা প্যাটেলের মতো ব্যক্তি পাব যিনি আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শক্তিশালী কর্মকর্তাদের বুকে আগলিয়ে রেখে সব ধরনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে অহর্নিশ লড়াই করবেন।
এ কে এম জামীর উদ্দীন: সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার
Comments